সহজ সরল প্রকাশভঙ্গী;প্রতিটি বাক্যই যেন একেকটি পটভূমি;সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্ম মানুষের বাস্তব জীবনের জীবন্ত প্রস্ফুটন:
এই হচ্ছে একজন
আহমদ ছফার লেখার বিশেষত্য।
১৯৪৩ সালের ৩০জুন জন্ম হয়েছিল এই সাহিত্যদিশারীর।
প্রথাগত সামাজিক অসঙ্গতি,সমাজতন্ত্রের বর্তমান পেক্ষাপট ও ভবিষ্যত্ বিশ্বব্যবস্থা,বামপন্থীদের জনসাধারণ থেকে বিচ্যুতির নিগূঢ় কারণসমূহ,সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত,মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনায় অভাবনীয় নিপুণতা দেখিয়েছেন আহমদ ছফা ।
আজকে আমরা যে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদকে পেয়েছি তিনিতো আহমদ ছফারই নিজহাতে গড়া ।
উপন্যাস এর প্রকৃত সৌন্দর্য যদি কেউ পেতে চায় তবে তাকে অবশ্যই আহমেদ ছফার উপন্যাস পড়তে হবে ।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত 'সূর্য তুমি সাথী'বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতম ধারার সৃষ্টি করেছে।
আহমদে ছফা গদ্য কবিতায় নতুনত্ব এনেছেন।তাঁর
'লেনিন ঘুমোবে এবার '
বিষয়বস্তু ও শব্দচয়ন উভয় দিক থেকে বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে ।
'দুঃখের দিনের দোহা'ও 'একটি প্রাচীন বটের কাছে প্রার্থনা'কাব্যে নতুনত্বের অন্যতম ধারক ।
আহমদ ছফার একটি অসামান্য কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি সমালোচনাকে শৈল্পিক ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত করেছেন।
অন্যের সাহিত্যকর্মের স্বার্থকতা ও ব্যর্থতার গঠনমূলক সমালোচনাও যে একটি সাহিত্য-এ সত্য আহমদ ছফাই আবিষ্কার করেছিলেন ।
আহমদ ছফার আরেকটি পরিচয় তিনি একজন সফল প্রাবন্ধিক ।তাঁর
'জাগ্রত বাংলাদেশ' ও
'উপলক্ষের লেখা 'দুটি অতুলনীয় প্রবন্ধ গ্রন্থ ।
'বাঙালি মুসলমানের মন'প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৃতাত্বিক বিবর্তন পর্যালোচনা করে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন ।
আহমদ ছফা অনেক বেশি পরিমান রাজনীতি সচেতন সাহিত্যিক।রাজনীতিকে চোরের মত পাশ কাটিয়ে যাওয়াকে তিনি জনগণের সাথে প্রতারণা বলে মনে করতেন।সমসাময়িক লেখকেরা যেখানে প্রকাশ্যে রাজনীতিকে এড়িয়ে গেছেন অথবা কোন না কোন রাজনৈতিক বিচ্যুত আদর্শের সাথে যুক্ত হয়েছেন ,সেখানে আহমদ ছফা নিজ ব্যক্তিত্বে অটুট ছিলেন।তাঁর রচনা কোন প্রতিবন্ধকতা ও পাশবিকতা অথবা রাজনৈতিক লাঠিয়ালদের ভয়ে ভীত হয়নি ।যদি কোন পাঠক তাঁর দুঃসাহসিক ও অভূতপূর্ব উপন্যাস
'অলাতচক্র 'পড়ে তবে আহমদ ছফার মাহাত্ম ও অবস্থান অনেকখানি বুঝতে পারবে ।
তিনি ১৯৭৫ সালে 'জল্লাদ সময়'কাব্য প্রকাশ করে তত্কালীন রাজনৈতিক অবস্থার ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণকারীদের কঠোর ধিক্কার জানান ।
আহমদ ছফা রচিত 'ওঙ্কার'হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ।
মানুষের স্বাভাবিক কথাবার্তাও যে সাহিত্য হতে পারে আহমদ ছফার সাক্ষাত্কারগুলো না পড়লে তা বোঝা যাবেনা ।
অনেক জটিল বিষয়,বিতর্কিত ব্যক্তি ও তাদের কর্ম,চলতি রাজনীতি,ধর্ম ও দর্শন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে প্রতিটি সাক্ষাত্কারকে একেকটি সাহিত্যকর্ম হিসেবে রেখে গেছেন আহমদ ছফা ।জীবিত থাকতেই তাঁর সাক্ষাত্কারগ্রন্থ'আহমদ ছফা বললেন...'প্রকাশিত হয় ।
একজন সফল অনুবাদক হিসেবেও আহমদ ছফা নিজেকে পরিচিত করে গেছেন ।
গ্যেটের বিখ্যাত 'ফাউস্ট' অনুবাদ করেন তিনি ।
'তানিয়া'তাঁর আরেকটি অনুবাদ শিল্প ।
কখনো তথাকথিত প্রগতিবাদী দুশ্চরিত্র নাস্তিক,কখনো প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রহারা আস্তিক-
মানবতার জন্য হুমকীস্বরূপ এই উভয় গোষ্ঠীর তীব্র বিদ্রুপকারী হচ্ছেন আহমদ ছফা ।
এর জন্য তাঁকে কথনো 'মৌলবাদী'অথবা কখনো 'নাস্তিক 'উভয় দলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
তবে আহমদ ছফা অপরাজিত ছিলেন ।
ধর্মান্ধ অথবা ধর্মবিমুখ উভয়গোষ্ঠীই আজ পতনের শেষ পর্যায়ে-
আহমদ ছফার বিশ্লেষণের বাস্তবতা এটি ।
ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত আহমদ ছফা এক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন ।
জীবনের শুরুর দিকে সাম্যবাদ ছফাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে।এমনকি চট্রগ্রামে একবার কম্যুনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ট্রেনের লাইন উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমৃত্যু গর্ববোধ করেছেন আহমদ ছফা।
১৯৬৭ সালে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের পরেই অধিকাংশ সাহিত্য রচনা করেন ।
প্রবল আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আহমদ ছফা বেঁচে থাকতে কারো প্রত্যয়ন অথবা নিন্দার তোয়াক্কা করতেন না ।
কলকাতার তথাকথিত বাঙালি বাবুদের এদেশপ্রীতি যে 'কেবল নিজেদের বইয়ের কাটতি বাড়ানো ' আহমদ ছফাই তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন ।
কারো তোষামুদি করেননি কখনো ।
নিজকর্মের স্বীকৃতি সময় ও প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন আহমদ ছফা ।তাই 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমী থেকে দেওয়া 'সাদত আলী আখন্দ 'পুরস্কার সানন্দে প্রত্যাখান করেছিলেন,যদিও মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পুরস্কারটি প্রত্যাখানের কোন সুযোগ ছিলনা ।
২০০১ সালের ২৮ জুলাই বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী এই প্রবাদপুরুষের জীবনাবসান ঘটে ।
২০০২ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয় ।
অতুতোভায় এই কলমসেনার লেখাগুলো বেশি করে প্রকাশ ও প্রচারে কেন যে খুব উদাসীন আমাদের প্রতিটি সরকার গঠনকারী দলগুলো তা এখনো আমাদের বোধগম্য নয় !
'আমার নির্ভীকতা ও সততা একদিন তরুনরা নিজ থেকেই খুঁজে নেবে'এই সত্য বিশ্বাস করতেন আহমদ ছফা ।
আহমদ ছফার সেই বিশ্বাসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ।
পুনশ্চ:[অনেকদিন থেকে আহমদ ছফাকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা পোষণ করছিলাম।নানা নষ্ট ঝামেলা,ক্লাসের চাপ,ঘুমের দৌরাত্ম প্রভৃতি কারণে আর লেখাটি হয়ে ওঠেনি ।
টুংগীপাড়া হচ্ছে,আমার মতে জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমি !তাই এখানে থেকেই আহমদ ছফাকে নিয়ে একটি ছোট্র 'সমালোচনা 'লিখলাম ।জানিনা কতটুকু পেরেছি,তবে চেষ্টার অন্ত ছিলনা ।
লেখাটির উদ্দেশ্য একটাই,
আহমদ ছফার সৃষ্ট অসাধারণ শিল্পকর্ম সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি,তাদের মাঝে যারা এখনো তাঁর লেখা পড়েনি ।
''যে আহমদ ছফা পড়েনি,
সে অনেক পড়েছে,তবে কিছুই জানেনি ।''-ফিরোজ হোসেন(আমার খুব কাছের একজন সাহিত্যানুরাগী ভাই,যিনি ফজলে নূর তাপসের অফিসে কাজে যোগ দিয়ে টাকানুরাগী হতে চেষ্টা করছেন ।)
সবাইকে ধন্যবাদ]
0 Comments