পূর্বকথা
বৃহত্তর বাংলাদেশ ছিল পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা নিয়ে।
সেই বাংলাদেশ যদি ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভক্ত হয় তখন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতো তবে বাংলাদেশর আয়তন আজ কয়েক গুণ বেড়ে যেত।
দেশবিভাগের সময় বাঙালি নেতা ও কর্মীরা নিশ্চিত ছিলেন যে তাদের পূর্বপুরুষদের বিচরণ করা ভূখণ্ড তাদেরই অংশে পড়বে। কিন্তু ধূর্ত কংগ্রেস, অসভ্য ইংরেজ ও স্বার্থপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের কারণে বাংলাদেশ হারায় তার অতীত ভূখণ্ড।
ইতিহাস বলে খ্রীস্টপূর্বেও যখন সাম্রাজ্যবাদী আলেকজাণ্ডার ভারতের বিশাল অংশ দখল করে নেয়, তখন পূর্ববাংলার গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া-টুঙ্গিপাড়াকে রাজধানী করে এক সমৃদ্ধ জাতি আলেকাজান্ডারকে বঙ্গে আক্রমণের সিদ্ধান্ত থেকে সরতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশি বাঙালিরা ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, দখলদার পাকিস্তানকে তাড়িয়েছে। কিন্তু নিজেদের ভূখণ্ড এখনো ফিরে পায়নি।
১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান হয় তাতে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের লাভ হয়, ক্ষতি হয় বাংলাদেশের। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক যে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতবর্ষে তিনটি (প্রকৃতপক্ষে একাধিক রাষ্ট্র। অর্থাৎ জাতিভিত্তিক 'states'। এখানে আলোচনার সুবিধার্তে তিনটি লিখলাম) দেশের কথা বলেছিলেন সেই 'তৃতীয় দেশটি' আমাদের বাংলাদেশ অথচ তার মূল ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ ভারত বিভক্তের সময় ভারতবর্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বাঙালি জাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মওলানা ভাসানীও চেয়েছিলেন বৃহত্তম এক বাংলাদেশ, শেরে বাংলা চেয়েছিলেন বৃহত্তম বাংলাদেশ, আবুল হাশিম চেয়েছিলেন অখণ্ড বাংলাদেশ, সোহরাওয়ার্ফী-মওলানা আকরাম খাঁ নিজের রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ বিভক্তি ঠেকাতে চেয়েছিলেন।
আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে সমধিক পরিচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় যুবক থাকার পরেও কলকাতাকে বাংলাদেশের অখণ্ড ভূখণ্ড বলে সভা সমাবেশ করেছিলেন।
দুঃখের বিষয়, ১৯০৫ সালে যে কলকাতার ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণবাদীরা মায়ের অঙ্গহানীর অজুহাতে বঙ্গভঙ্গ এর বিরোধীতা করে, সেই গোষ্ঠীই ১৯৪৭ সালে ইংরেজ ও পাকিস্তানী অসুস্থদের সঙ্গে আঁতাত করে বাংলাদেশ বিভক্ত করে। এবার ‘মায়ের’ অঙ্গচ্ছেদে মোটেই তাদের জাত চলে যায়নি। এই অঙ্গচ্ছেদ করতে 'বাংলার রেনেসাঁস' এর ঠিকাদার শিক্ষিত বর্ণহিন্দুরা কলকাতায় মহাগণহত্যা চালায় ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট! আলাদা ভূখণ্ডের দাবিতে মুসলমানদের অহিংস প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসে কলকাতাকেন্দ্রীক বর্ণবাদী হিন্দুত্ববাদীদের জঘন্য রূপটি তপন রায়চৌধুরী তাঁর 'বাঙালনামা' গ্রন্থে উল্লেখ করেন। কলকাতার বাবুগিরির আড়ালে কী পরিমাণ শ্রেণি ও সম্প্রদায় ঘৃণা ছিল সেটি নির্মোহ দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তপন রায়চৌধুরী সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরেছেন৷
বঙ্গবন্ধুর ভাষায় দেশ বিভাগ ভারত বিভাগ নয়, তা যেন বাংলাদেশ বিভাগ
বাংলাদেশের ভাগে কলকাতাকে আনতে দেশ ভাগের সময় সোচ্চার ছিল পূর্ব বঙ্গের মানুষ। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৭৩ পৃষ্ঠায় চোখ বুলালে সে সময কলকাতার প্রতি আমাদের ন্যায্য অধিকারের স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘‘১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হল ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবেনা। বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে। মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বর্ধমান ডিভিশন আমরা না-ও পেতে পারি। কলকাতা কেন পাব না? কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বাংলাদেশ ভাগ করতে হবে বলে জনমত সৃষ্টি শুরু করলো। আমরাও বাংলাদেশ ভাগ হতে দেব না, এর জন্য সভা করতে শুরু করলাম। আমরা কর্মীরা কি জানতাম যে, কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ মেনে নিয়েছে এই ভাগের ফর্মুলা? বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা। আজ দেখা যাচ্ছে, মাত্র আসামের এক জেলা-তাও যদি গণভোটে জয়লাভ করতে পারি। আর বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। কলকাতার কর্মীরা ও পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা এসে আমাদের বলতো, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমাদের কপালে কি হবে খোদাই জানে!সত্যই দুঃখ হতে লাগলো ওদের জন্য। গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া হবেনা।’’
(তথ্যসূত্র:লেখক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পুস্তক: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ৭৩, প্রকাশের সাল: প্রথম প্রকাশ ২০১২, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৬, প্রকাশনী: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।)
কলকাতা নিয়ে ইংরেজ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পশ্চিম পাকিস্তানী অংশের ঐতিহাসিক বেঈমানী
তিনি লিখেছেন, ‘‘১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করা হল ভারতবর্ষ ভাগ হবে। কংগ্রেস ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়েছে এই জন্য যে, বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব ভাগ হবে। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানে আসবেনা।’’
মানে যখনই পাকিস্তান ও ভারতের নেতারা নিজেদের স্বার্থের নিশ্চয়তা পেয়েছে তখনই ভারতবর্ষ ভাগ করতে রাজি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের বিশাল অংশ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে হিন্দুস্তান এবং বিনিময়ে পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের বিশাল অংশ পাচ্ছে পাকিস্তানী কুকুরেরা। তো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের কি হবে?
ভারত ভাগ বলে যা হচ্ছে তা তো আসলে বাংলা ভাগ। শেখ মুজিবের ভাষায় আসলে ‘বাংলাদেশ ভাগ’। মুজিবের ভাষ্যটি লক্ষ্য করুণ, ‘‘বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও ভারতবর্ষে থাকবে।
মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ও মুসলিম লীগ নেতারা বাংলাদেশ ভাগ করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করলেন।’’
লক্ষ্য করে দেখেন, বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘বাংলাদেশের কলকাতা এবং তার আশপাশের জেলাগুলিও’, অর্থাৎ এই কলকাতা ছিল বাংলাদেশের ভূখণ্ড যা পশ্চিম পাকিস্তানীরা ভারতীয়দের কাছে দিয়ে দিতেছিল ইংরেজদের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু তো তাঁর এ বইয়ে আরো জানালেন, পাহাড়ি অঞ্চলসহ পুরো দার্জিলিং পূর্ব পাকিস্তানে আসার কথা। এমন কি পশ্চিমবঙ্গের শিয়ালদহ পর্যন্ত। বাংলাদেশ কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বে নয়, 'বাংলাদেশ হিসেবে আলাদা দাবি করেছিল তার ভূখণ্ড'। এ কারণেই পার্বত্য অঞ্চল প্রাচীন বাংলাদেশ হিসেবে পূর্ববঙ্গেরই অংশ। আর আমরা আসামের করিমগঞ্জ, শিয়ালদহ, দার্জিলিং, ত্রিপুরা, বনগাঁ সব হারালাম!
![]() |
এমন ছিল কি বৃহত্তর বাংলাদেশের চিত্র? ছবি / ইন্টারনেট। |
তো কলকাতার মুসলিমরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সঙ্গেই আসতে।একইভাবে বিহারের বিরাট অংশ চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অংশ হতে।
ত্রিপুরা ও আসামের লোকতো আমাদের আত্মীয়ই। এমন কি আজকের রোহিঙ্গা সংকটেরও উদ্ভব হতো না, কারণ রোহিঙ্গা মুসলমানরা চেয়েছিল আরাকান পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হোক পাকিস্তানে। সেই সময় যদি ইংরেজ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পশ্চিম পাকিস্তানী অংশ ঐতিহাসিক বেঈমানী না করতো তবে আজকের বাংলাদেশের ্মানচিত্র অনেক বড় হতো। বাংলাদেশ উপমহাদেশে দিল্লিকেন্দ্রীক মাতুব্বরিকে থোড়াই কেয়ার করতো!
‘বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে’
আমাদের অর্থনীতি দিয়ে কলকাতাকে ঐশ্বযূমন্ডিত করে সাজানো হয়। অথচ সেই কলকাতাই আমাদের থাকবেনা।
ক্ষোভে বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘‘ কলকাতার কর্মীরা ও পশ্চিমবঙ্গের কর্মীরা এসে আমাদের বলতো, তোমরা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, আমাদের কপালে কি হবে খোদাই জানে!সত্যই দুঃখ হতে লাগলো ওদের জন্য। গোপনে গোপনে কলকাতার মুসলমানরা প্রস্তুত ছিল, যা হয় হবে, কলকাতা ছাড়া হবেনা।’’।
এমনই ছিল কলকাতার দাবি।
বঙ্গবন্ধু আরেকটি দারুন তথ্য আমাদের দিয়েছেন আর সেটি হচ্ছে, দেশ বিভাগের সময় ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলও ভারতের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
অথচ ধর্মের ভিত্তিতে যদি দেশ ভাগ হয় তবুও বাংলাদেশই পায় এসব জেলা।
বাঙ্গালি জাতির পিতার ভাষায়, ‘‘আর বাংলাদেশে মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলি কেটে হিন্দুস্থানে দেওয়া হবে। আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম।’’ এই হচ্ছে আমাদের জমি হারানোর, ভূখণ্ড হারানোর, ভূমি লোপাটের দুঃখজনক ইতিহাস। এ কারণে কেউ যখন দেশ ভাগ নিয়ে কেঁদে কেটে লোক দেখানো বুক চাপড়ায় আমি তখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলি:
দেশ বিভাগ মানে হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বুদ্ধিবৃত্তিক লোপাট। দেশ বিভাগ ভারত ভাগ নয়, দেশবিভাগ মানে ইংরেজ ও ইংরেজের দালাল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদীদের এক হয়ে বাংলাদেশ বিভাজন করা।
মাউন্টব্যাটেন, র্যাডক্লিফ, কংগ্রেস ও জিন্নাহর ভণ্ডামী
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘‘এই সময় বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল একসাথেই থাকবেন। জিন্নাহ রাজি হলেন না, নিজেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়ে বসলেন। মাউন্টব্যাটেন সম্বন্ধে বোধহয় তাঁর ধারণা ভাল ছিলনা। মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করার চেষ্টা করলেন। যদিও র্যাডক্লিফকে ভার দেওয়া হল সীমানা নির্ধারণ করতে, তথাপি তিনি নিজেই গোপনে কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে একটা ম্যাপ রেখা তৈরি করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। ...জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল হোক, এটা আমরা যুবকরা মোটেও চাই নাই’’
(তথ্যসূত্র:লেখক: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পুস্তক: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা: ৭৪, প্রকাশের সাল: প্রথম প্রকাশ ২০১২, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৬, প্রকাশনী: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড)
ক্ষমতালোভী আলী জিন্নাহ !
উপরের দলিলটি দেখে আমার জিন্নাহর মুখের উপর থুথু ফেলতে মন চায়।
এই বদমাশ বাঙালির প্রতি কেবল ১৯৪৭ সালের ভাষা নিয়েই বিরূপ ছিলনা, তার আগে থেকেই বাংলাদেশি বাঙালির অধিকারের প্রতি সে ছিল উদাসীন।
কায়েদে আযম নামের এই কায়েমী স্বার্থপরের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা দখল। গভর্নর হওয়ার খায়েশ। সে কারণেই সম্ভবত পাকিস্তান করে। কারণ কংগ্রেসের ক্ষমতালোভী নেহরু ও সরদার প্যাটেলের সাথে সে ভারতের ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে পারবেনা, কিন্তু নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের ক্ষমতা সে অচিরেই দখল করতে পারবে।
তার উদ্দেশ্য ছিল গভর্নর হওয়া, পাকিস্তানের মুসলমানদের অধিকার দেখা নয়। না হলে বাংলাদেশের এত বড় অংশ ভারতের সাথে নেয়ার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সে কোন ভূমিকা নিলনা কেন?
বাংলাদেশের মানচিত্র পাল্টাতে কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র
বঙ্গবন্ধু আরেকটি ঐতিহাসিক দলিল উল্লেখ করেন। অনেকে ভারত বিভাগের জন্য এককভাবে মুসলমানদের দায়ি করেন। অথচ ভারতীয় কংগ্রেস সেসময় ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে ভারত বিভাগ চেয়েছিল।
তিনি কংগ্রেস ও ইংরেজদের আঁতাত বিষয়ে লেখেন,‘‘এই সময় বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন তলে তলে কংগ্রেসকে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল একসাথেই থাকবেন।’’
্মাউন্টব্যাটেনের ্এই খায়েশের বিরুদ্ধাচারণ করেন জিন্নাহ। তিনিও পাকিস্তানের গভর্নর হতে চান। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ যে বিশাল ভূখণ্ড হারাচ্ছে তা এই ক্ষমতালোভীরা কেউই গুরুত্ব দিলোনা।
বঙ্গবন্ধু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের সামনে হাজির করেন।
অনেকেই আমাদের মধ্যে কংগ্রেসকে ভারত ভাগের দায় থেকে মুক্ত করতে চান র্যাডক্লিফের উপর দায় চাপিয়ে।
‘শঙ্খচিল’ নামের প্রোপাগাণ্ডা চলচ্চিত্রে যেমন গৌতম ঘোষরা বয়ান হাজির করেন, দেশ ভাগ যেন ঈশ্বরের অমোঘ কিছু। আসলে তা নয়। দেশ ভাগও ছিল স্বার্থপরদের মাট দখলের রাজনীতি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, র্যাডক্লিফের সাথে কংগ্রেসের গোপন যোগাযোগ ছিল বলে অনেকে তখন ধারণা করতেন। এটা সত্য হতে পারে। কারণ র্যাডক্লিফের ভন্ডামীতে পূর্ববাংলা তার বিপুল পরিমাণ জায়গা হারায়। একই সাথে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরেও অনেক অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে পড়েনি। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু র্যাডক্লিফের অপকর্মের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণাকে তাঁর আত্মজীবনীতে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর কলমে সেটি এসেছে এভাবে:
যদিও র্যাডক্লিফকে ভার দেওয়া হল সীমানা নির্ধারণ করতে, তথাপি তিনি নিজেই গোপনে কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ করে একটা ম্যাপ রেখা তৈরি করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা।
৩৩ কোটি টাকা অথবা কলকাতা কিছুই পেলাম না...
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাসের জন্য আবুল মনসুর আহমদ প্রণীত গ্রন্থগুলো নির্ভরযোগ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
তাঁর সবেচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’। এ গ্রন্থে আবুল মনসুর আহমদ কলকাতা রক্ষার জন্য ‘কলকাতা রক্ষা’ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেন। তিনিও লেখেন যে, দেশ ভাগের ফলে বাংলাদেশ তার ভূখন্ড হারিয়েছে। তিনি এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন,
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃত্ব মাত্র ৩৩ কোটি টাকার জন্যও কলকাতা ছেড়ে দেয় (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা:২০৩) অথচ দেশ ভাগের পর ভারতবর্ষের নেতা বা সরকার বাংলাদেশের প্রাপ্য ৩৩ কোটি টাকা দেয়নি।
এছাড়া কলকাতায় থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিরাটাংশ ছিল পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের। কিন্তু সেই সম্পদও ফিরিয়ে দেয়নি। যদি সিরাজুদ্দেীলা থেকে শুরু করা হয় তবে কলকাতা, উড়িস্যা ছিল বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু দেশ ভাগের ফলে পাঞ্জাবী ও নয়াদিল্লীপন্থীরা লাভবান হলো, বাঙালি হলো ক্ষতিগ্রস্ত। বাংলাদেশ হারালো তার দুই তৃতীয়াংশ ভূখন্ড।
‘ম্যাপ চার্ট ও স্ট্যাটিসটিকস দিয়া কলিকাতা পূর্ব বাংলায় থাকার যুক্তি দিতেছিলাম’
দেশ বিভাগের ফলে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার না পাওয়ার ব্যাপারে আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থে বলেন, ‘‘...পার্টিশনে পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হইয়াছে। রেফারেন্ডামে বিপুল মেজরিটি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও সিলেটের করিমগঞ্জ ভারতের ভাগে ফেলা...পক্ষপাতমূলক অবিচার।... দেশ বিভাগে রেডক্লিফ পাকিস্তানের প্রতি যতই অন্যায় করিয়া থাকুন কেন, কলিকাতার উপর পাকিস্তানের দাবি অগ্রাহ্য করা সহজ ছিলনা। এট।...বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ যুক্তভাবে তখন 'কিপ ক্যালকাটা (কলিকাতা রাখ)' আন্দোলন চালাইতেছিল। সবগুলি মুসলিম সংবাদপত্রেই আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন ম্যাপ চার্ট ও স্ট্যাটিসটিকস দিয়া কলিকাতা পূর্ব বাংলায় থাকার যুক্তি দিতেছিলাম। মুসলিম ছাত্রলীগ মিছিল ও জনসভা করিতেছিল। হক সাহেব পর্যন্ত এই আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ও বেংগল পার্টিশন কাউন্সিলের মেম্বর সুহরাওয়ার্দী সাহেব দার্জিলিং-এ গভর্নর সার আর. জি ক্যাসি সাহেবের সহিত আলোচনা কয়িয়া আমাদেরে এইরূপ আভাস দেন: চব্বিশ পরগণার বারাকপুর, বারাসাত, ভাংগর ও বশিরহাট পূর্ব-বাংলার ভাগে ফেলিয়া এবং কলিকাতা ও দার্জিলিং উভয় শহরকে উভয় বাংলার কমন শহর ঘোষণা করিয়া বাংলা বাটোয়ারা করিতে গবর্নর রাযী হইয়াছেন এবং সেই মতে ঊর্ধ্বতন মহলে প্রভাব বিস্তার করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। ‘’
(তথ্যসূত্র: গ্রন্থ: আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, লেখক: আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা: ১৯৯-২০১, প্রকাশনী: খোশরোজ কিতাব মহল প্রকাশনী, প্রকাশের সাল: ১৯৯৫।)
কলকাতাকে বাংলাদেশের সঙ্গে রাখার আন্দোলনে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দি
আবুল মনসুর আহমদের ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে দেখা যায়, কলকাতার উপর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের দাবি ছিল। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগ মিছিল করছিল যেটি বঙ্গবন্ধু তাঁর গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।
কলকাতাকে বাংলাদেশের সঙ্গে রাখার আন্দোলনে শেরে বাংলা ও সোহরাওয়ার্দি
আবুল মনসুর আহমদের ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে দেখা যায়, কলকাতার উপর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের দাবি ছিল। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগ মিছিল করছিল যেটি বঙ্গবন্ধু তাঁর গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরো কিছু নাম উল্লেখ করে কলকাতার প্রতি আমাদের ঐতিহাসিক দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। আবুল মনসুর আহমেদের ভাষায়,‘‘...বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী ও বেংগল পার্টিশন কাউন্সিলের মেম্বর সুহরাওয়ার্দী সাহেব দার্জিলিং-এ গভর্নর সার আর. জি ক্যাসি সাহেবের সহিত আলোচনা কয়িয়া আমাদেরে এইরূপ আভাস দেন: চব্বিশ পরগণার বারাকপুর, বারাসাত, ভাংগর ও বশিরহাট পূর্ব-বাংলার ভাগে ফেলিয়া এবং কলিকাতা ও দার্জিলিং উভয় শহরকে উভয় বাংলার কমন শহর ঘোষণা করিয়া বাংলা বাটোয়ারা করিতে গবর্নর রাযী হইয়াছেন এবং সেই মতে ঊর্ধ্বতন মহলে প্রভাব বিস্তার করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছেন।’’
দেখেন, এই বর্ণনায় স্পষ্ট আমাদের মহান নেতা সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক বাংলাদেশের ভূখন্ড বৃদ্ধির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় এই ইতিহাসের চর্চা এখন? বরং বিজেপির কোন ইতিহাস জ্ঞানহীন আবার বাংলাদেশের খুলনা পর্যন্ত দাবি করে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে কেচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসবে। কলকাতা ও আসাম যে মাউন্টব্যাটেন ও র্যাডক্লিফের সাথে আঁতাত করে নিয়ে নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে ঐতিহাসিক সন্দেহ এখনো অবিচল রয়েছে।
সিলেটের করিমগঞ্জ গণভোটে বাংলাদেশর ভূখণ্ড: কিন্তু কোথায় তা?
আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘‘পার্টিশনে পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হইয়াছে। রেফারেন্ডামে বিপুল মেজরিটি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও সিলেটের করিমগঞ্জ ভারতের ভাগে ফেলা...পক্ষপাতমূলক অবিচার।’’
সিলেটের করিমগঞ্জ গণভোটে বাংলাদেশর ভূখণ্ড: কিন্তু কোথায় তা?
আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘‘পার্টিশনে পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হইয়াছে। রেফারেন্ডামে বিপুল মেজরিটি পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও সিলেটের করিমগঞ্জ ভারতের ভাগে ফেলা...পক্ষপাতমূলক অবিচার।’’
এটা কেমন বিচার হলো? গণমভোটে যারা বাংলাদেশের সঙ্গে মিসতে চাইলো তাদের কেন অন্য দেশের সাথে যুক্ত করা হলো?
এই ঐতিহাসিক জোচ্চুরি ও বাটপারির ব্যাপারে কেন ইতিহাসবিদরা আওয়াজ তোলেনা?
১৯৪৭ এ তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলোনা সরদার প্যাটেল, গান্ধী, নেহেরু ও কংগ্রেসের দুরভীসন্ধির জন্য
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, দেশ বিভাগের সময় তাঁদের দাবি ছিল আগে বৃহত্তর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ত্ব দিয়ে একটি গণভোটের সুযোগ দিতে হবে। সেই বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নেবে তারা হিন্দুস্তান না পাকিস্তানের সঙ্গে মিশবে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪)।
সেই বাংলাদেশ যদি স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাও মেনে নিতে হবে বলে পূর্ববঙ্গের মানুষের দাবি ছিল বলে জাতির পিতা উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু এসব বিষয়ে কথাগুলো লেখার সময় ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের আয়তন অনেক বৃহৎ।
আত্মজীবনীর ৭৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন,‘‘..এই ফর্মুলা (বাংলাদেশ ভাগ না করে স্বাধীন ও সার্বভৌম করে গণপরিষদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেয়া) নিয়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু দিল্লিতে জিন্নাহ ও গান্ধীর সাথে দেখা করতে যান।
শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোন আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা কোন ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন,‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই। মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বা্বুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথা স্বীকার করেছিলেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৭৪)
১৯৪৭এ-ই উদ্ভব হতো বাংলাদেশের!
বঙ্গবন্ধুর এই বর্ণনা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে জিন্নাহ পর্যন্ত তখন হিন্দুস্তান, পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ তাতে বাংলাদেশ তার নিজস্ব বিপুল ভূখণ্ড পেয়ে যেত্। তাতে করে বঙ্গপসাগরের উপর বিশাল কর্তৃত্ব চলে আসতো কেবল বাংলাদেশের হাতে। অন্য দিকে যদি আসাম ও ত্রিপুরা বাংলাদেশের সঙ্গে যু্ক্ত হতো তবে বাংলাদেশ হতো এ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র।
শরৎ বসু নিজে লিখে গেছেন যে জিন্নাহ তাঁকে বলেছিলেন, মুসলিম লীগের কোন আপত্তি নাই, যদি কংগ্রেস রাজি হয়। ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা কোন ফর্মুলা মানতে পারবেন না। শরৎ বাবু কংগ্রেসের নেতাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল তাঁকে বলেছিলেন,‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই। মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহেরু কোন কিছুই না বলে শরৎ বাবুকে সরদার প্যাটেলের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর মিস্টার প্যাটেল শরৎ বা্বুকে খুব কঠিন কথা বলে বিদায় দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে এসে শরৎ বসু খবরের কাগজে বিবৃতির মাধ্যমে এ কথা বলেছিলেন এবং জিন্নাহ যে রাজি হয়েছিলেন এ কথা স্বীকার করেছিলেন। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৭৪)
১৯৪৭এ-ই উদ্ভব হতো বাংলাদেশের!
বঙ্গবন্ধুর এই বর্ণনা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যে জিন্নাহ পর্যন্ত তখন হিন্দুস্তান, পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস তাতে সাড়া দেয়নি। কারণ তাতে বাংলাদেশ তার নিজস্ব বিপুল ভূখণ্ড পেয়ে যেত্। তাতে করে বঙ্গপসাগরের উপর বিশাল কর্তৃত্ব চলে আসতো কেবল বাংলাদেশের হাতে। অন্য দিকে যদি আসাম ও ত্রিপুরা বাংলাদেশের সঙ্গে যু্ক্ত হতো তবে বাংলাদেশ হতো এ অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র।
১৯৭১ সালে আমাদের ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ দিতে হতোনা। কিন্তু সেটি ওরা হতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর এই বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারছি যে, শরৎ বসু বলেছিলেন জিন্নাহ এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন যদি কংগ্রেস রাজি হয় এই শর্তে। সে মতে বাংলার ভুখণ্ড হারানোর জন্য এককভাবে জিন্নাহকে দায়ী করার জায়গা থেকে সরে এসে আমরা গান্ধীর নিরবতা, নেহেরুর দুরভীসন্ধি ও সরদার প্যাটেলের স্বার্থবাদী অবস্থানকে দায়ি করতে পারি। এটাই বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। তিনি যখন বর্ণনা করেন, তখন নিরপেক্ষ হয়েই বর্ণনা করেন এবং যা ঘটেছে কেবল তাই। সে কারণে দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতার ইতিহাস চর্চায় আমার কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’। আফফোস, আজ এই মহান নেতা আমাদের মাঝে নেই। একাই একটি জাতির অনুপ্রেরণা হয়ে স্বাধীনতা এনে দিলেন অথচ দেশটি গরীব-দুঃখীর জন্য গড়ে যেতে পারলেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা যে প্রিয় নেতাকে হারিয়েছি সেই নেতার শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হয়নি। প্রবল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলনে ইতিহাস সচেতন। তিনি থাকলে আজ বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, সমগ্র পৃথিবীর একটি পরাশক্তি থাকতো। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ভারতে কিছু সময়ের জন্য নেমেছিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘আমার দেশ থেকে কবে আপনার সৈন্য ফিরিয়ে আনবেন?’।
আজ আর কথা বাড়াবোনা। আজ ১৪ আগস্ট ২০১৭। ১৯৪৭ সালের এই ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগ হয়। সেই দেশ বিভাগে প্রাচীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য কিছু ভূখণ্ড আমরা হারিয়েছি। এই যুগে ইতিহাস চর্চা খুব কম দেখা যায়। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাস সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের যত বেশি চর্চা হবে তত বাংলাদেশীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পাবে। নিজের দেশের পণ্য ক্রয়ের মানসিকতা তৈরি হবে, নিজের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। ঐতিহাসিক সত্য যত বেশি উন্মোচিত হবে ততই দেখা যাবে বাংলাদেশের সোনালী অতীত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা যে প্রিয় নেতাকে হারিয়েছি সেই নেতার শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব হয়নি। প্রবল দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলনে ইতিহাস সচেতন। তিনি থাকলে আজ বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, সমগ্র পৃথিবীর একটি পরাশক্তি থাকতো। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে ভারতে কিছু সময়ের জন্য নেমেছিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘আমার দেশ থেকে কবে আপনার সৈন্য ফিরিয়ে আনবেন?’।
শেষ কথা
আজ আর কথা বাড়াবোনা। আজ ১৪ আগস্ট ২০১৭। ১৯৪৭ সালের এই ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগ হয়। সেই দেশ বিভাগে প্রাচীন বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য কিছু ভূখণ্ড আমরা হারিয়েছি। এই যুগে ইতিহাস চর্চা খুব কম দেখা যায়। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাস সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের যত বেশি চর্চা হবে তত বাংলাদেশীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পাবে। নিজের দেশের পণ্য ক্রয়ের মানসিকতা তৈরি হবে, নিজের সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। ঐতিহাসিক সত্য যত বেশি উন্মোচিত হবে ততই দেখা যাবে বাংলাদেশের সোনালী অতীত।
যে অতীত আমাদের, যে ইতিহাস আমাদের, যে সংগ্রাম আমাদের, তাঁর পুনর্জাগরণ দরকার লাল ও সবুজের বিজয়ের জন্য। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।