ফ্রান্টজ ফানোঁ (১৯২৫-১৯৬১) তাঁর "A Dying Colonialism" গ্রন্থে (১৯৬৫) নারীদের পর্দা নিয়ে খুবই কালজয়ী কিছু প্রামাণ্য-পর্যবেক্ষণ এবং মনোবিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন৷
ফরাসী দখলদারদের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার বিপ্লবীদের প্রতিরোধ যুদ্ধে নারীরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এ নারীরা বিপ্লবের প্রাথমিক অবস্থা পর্যন্ত পর্দায় আবৃত ছিলেন। এরা নাম 'হাইক' (Haik/Hayek)। ঢিলেঢালা কাপড় যা পুরো শরীর আবৃত করে দেয়, কখনো মুখ খোলা থাকে। আমাদের দেশের বোরখার সঙ্গে অনেকটা মিল আছে।
ভূমি ও সম্পদ লোপাটকারী ফ্রান্সের সরকার, বুদ্ধিজীবী, আমলা, পুলিশ ও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও নিপীড়ন যন্ত্র "নারীদের দখলের মাধ্যমে আলজেরিয়া দখল" করার পরিকল্পনা করলো।
ফানোঁ বলেন, নারীদের প্রথাগত ইসলামী বা সাংস্কৃতিক পোশাক বা ইজ্জত-মানের যে ধারণা তা থেকে মুক্ত করে তাকে ফরাসী বা ইউরোপীয় চেরাগায়ন (European Enlightenment) দ্বারা ফরাসী মূল্যবোধের ফেরিওয়ালা বানাতে চাইলো ফ্রান্স।
এতে আলজেরিয়ার পরিবারের অভ্যন্তরে ফরাসী বিরোধী যে মানসিকতা উৎপাদন হয় সেটি উধাও হবে এবং এ নারীর বলয়ের সন্তান-জামাই ফরাসীপন্থী হবে--বলে দখলদারদের ভাবনা ছিল৷
ফানোঁ এ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় 'Algeria Unveiled' এ আলাপ করেন যে, নারীদের পর্দার বাইরে আনার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ছিলো গভীর।
প্রথাগত ধারণার পর্দা নারীদের ভেতর তীব্র উপনিবেশবিরোধী একটি প্রতিরোধ শক্তি (Resistance Power) উৎপাদন করতো৷
শত বছর ধরে আলজেরিয় নারী তার ধর্মীয় পর্দা প্রথা টিকিয়ে রেখে ফরাসী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ব্যাপারে প্রতিরোধ জিইয়ে রেখেছে৷ ফানোঁর ভাষায় ফ্রান্সের কথিত নারীমুক্তির বাণীকে '...Rejection of the values of the occupier" তত্ত্বে আলজেরিয়ার নারীরা বয়কট করেন !
যেই না আলজেরীয় নারীর পর্দা খোলার চেষ্টা ফ্রান্স করেছে সে ফরাসীদের প্রতি আরো বিক্ষুব্ধ হয়েছে।
কারণ, নারী পর্দার মাধ্যমে তার ভেতরের সৌন্দর্যকে রহস্য হিসেবে তুলে ধরে অন্যকে দ্বিধায় রেখে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতো, ফ্রান্টজ ফানোঁ বলতে চান।
অপরের ইচ্ছায় নিজেকে প্রদর্শন না করে সে পুরুষের নিকট দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতো।
এটিই নারীর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ার ছিল।
কিন্তু আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে আলজেরিয়ান নারী পর্দা খুলে কাজ করতে ঘরের বাইরে এসেছেন৷
সাইকিয়াট্রিস্ট ফানোঁ তাদের মনোবিশ্লেষণ করে দেখেন, এ নারীরা তাদের প্রথাগত পর্দা হারিয়ে বাহ্যিকভাবে 'এমপাওয়ার্ড' হলেও ভেতরে 'ইনসিকিউরড' ফিল করছেন।
এমন কী অনেকেই স্বপ্নে নিজেদের ধর্ষিত বা ক্ষতবিক্ষত হতে দেখতেন।
তবু তারা জীবন-জীবিকার তাগিদে পর্দার স্বাভাবিক রূপটি ছেড়ে পশ্চিমা পোশাক পরেছেন৷ ফানোঁর ভাষায় এটি 'সাংস্কৃতিক বদল' (Cultural Mutation)।
ফানোঁ বলেন, ইউরোপীয় নারী আলজেরীয় নারীর এই আমূল পরিবর্তনে সংকোচ বোধ করতেন এবং আলজেরীয় নারী নিজের ভেতরের সেই 'রেজিস্ট্যান্স পাওয়ার' খুঁজতেন।
কেউ কেউ নিজ পোশাক হারিয়ে, ফরাসীদের সঙ্গে চাকরি করে 'অপরাধবোধ' অনুভব করে বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উপায় খুঁজতেন (বাংলাদেশের 'গেরিলা' চলচ্চিত্রে এমন এক নারী শিল্পীকে আমরা দেখি)।
১৯৫৪ সালে আলজেরিয়া বিপ্লবীরা ফরাসীদের তাড়াতে ঐক্যবদ্ধ মানসে বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম শুরু করলে নারীদের মধ্যে যারা পশ্চিমায়নের শিকার হলেন তারা নিজেদের ভেতরের রেজিস্ট্যান্স পাওয়ারটিকে ফিরে পাওয়ার বা প্রয়োগের সুযোগ পেলেন।
তারা যেহেতু পর্দা ছেড়েছেন, তাই ফরাসীরা তাদের সহজেই চেকপোস্ট অতিক্রম করতে দিতো।
এ সুযোগে তারা অস্ত্র, গ্রেনেডের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের নানা তথ্য এনে দিতেন।
কোনো এক নারী গ্রেফতার হওয়ার পর ফরাসীরা এটি টের পেয়ে যায় যে, পরিকল্পিত 'সাংস্কৃতিক আগ্রাসন' বুমেরাং হয়ে তাদের জন্য গর্ত খুঁড়েছে।
এরপর ফরাসী পোশাক গ্রহণ করা আলজেরিয়ার নারীদের ওপর ব্যাপক তল্লাশী শুরু হয়৷
তার রেজিস্ট্যান্স এবিলিটিকে শত্রু ডিকোড করে ফেলেছে দেখে আলজেরিয়ার নারী আবার 'কালচারাল মিউটেশন' করলো। কীভাবে?
ঠিক এই সময়ে এসে আলজেরিয়ার নারীরা পুনরায় সেই প্রথাগত আলজেরিয়ান পর্দায় চলে গেলেন।
তারা রেজিস্ট্যান্স পাওয়ার ফিরে পেতে পর্দাকে শরীরের অপরিহার্য অংশ করে নিলেন।
এই পর্দার আড়ালে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, রসদ, গোলা, বারুদ, বোমা বা গ্রেনেড বহন করে নিতেন।
এখন তাদের শরীরকে আর ইউরোপীয় স্টাইলে গঠন করার তাড়না নাই, আবার চেকপোস্টে সন্দেহের তীরও হ্রাস পাচ্ছে।
ফাঁনোর কথায়:
In the beginning, the veil was a mechanism of resis-tance, but its value for the social group remained very strong. The veil was worn because tradition demanded a rigid separation of the sexes, but also because the occupier was bent on unveiling Algeria.
In a second phase, the mutation occurred in connection with the Revolution and under special circumstances.
The veil was abandoned in the course of revolutionary action. What had been used to block the psychological or political offensives of the occupier became a means, an instrument.
(ফানোঁ, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা-৬৩)
ফানোঁ নারীর শরীরের সঙ্গে পর্দার সম্পর্ককে দেহের দ্বান্দিক তত্ত্ব (Dialectic of the Body) হিসেবে পাঠ করেন৷ পর্দার মিউটেশনকে ফানো বিপ্লবের হাতিয়ার (means of revolution) হিসেবে দেখেন।
ফানোঁ বলেন, পর্দা খুললে পশ্চিমা বাটখারায় শরীরকে চিকন বানাতে হতো, পুনরায় পর্দা গ্রহণ করায় এর বিপরীত মাপের শরীরও গঠন করতে হয়।
ফাঁনোর ভাষাটি দেখেন:
The Algerian woman's body, which in an initial phase was pared down, now swelled. Whereas in the previous period the body had to be made slim and disciplined to make it attractive and seductive, it now had to be squashed, made shapeless and even ridiculous. This, as we have seen, is the phase during which she undertook to carry bombs, grenades, machine-gun clips.
(ফানোঁ, ১৯৬৫, পৃষ্ঠা-৬২)
তিনি বলেন, আলজেরিয়ার নারীরা পর্দা গ্রহণ, ফরাসী পোশাক গ্রহণ এবং পুনরায় পর্দার আওতায় আসার তিনটি ধাপ তাদের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অনিবার্য অনুসঙ্গ ছিলো।
ফরাসীরা যে আজকেও পর্দার নানা ধরন যেমন--হিজাব, নেকাব, বোরখা বিরোধী আইন পাশ করে এর ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে আলজেরিয়ার বিপ্লবের মাধ্যমে পরাজিত ঔপনিবেশিক ফরাসী দেশের ইতিহাসের পাতায়।
আর আলজেরিয়ায় এখনো সেই 'হায়েক' ফিরিয়ে আনার আন্দোলনও হয় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে এই পর্দার ভূমিকার কথা স্মরণ করে।
নারী ও পর্দার এই বিচিত্র পরিবর্তিত সম্পর্ক দেখে খুন, ধর্ষণ, গণহত্যাকারী দখলদার ফরাসীরা সেই সময়ে ভালো রকম দ্বিধান্বিত হয়।
নারীদের বিপুলসংখ্যক অংশগ্রহণের কারণে আলজেরিয়ার মহাবিপ্লব সফল হয় এবং ফরাসী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সে সময়ের বিদ্যমান কাঠামোই ভেঙে পড়ে।
বিপ্লবের শক্তিবলে মহাসংকটে পড়ে ১৯৫৮ সালে বাধ্য হয় ফরাসীরা নতুন রিপাবলিক গঠন করতে।
এর কিছুদিন পর আলজেরিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট দিতেও তারা রাজি হতে বাধ্য হয়।
দখলদার ফরাসীদের তত্ত্বাবধানে আলজেরিয়ার সেই ঐতিহাসিক গণভোটের ফলাফল জানেন?
১৩২ বছর আলজেরিয়া দখল করে, লুট করে, খুন-ধর্ষণ করে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে দালাল তৈরি করার পরেও ১৯৬২ সালের গণভোটে ৬ লক্ষ ভোটের মধ্যে মাত্র ১৬,৫৩৪ টি ভোট পড়ে 'ফরাসী দখল' এর পক্ষে!
ঠিক দেখেছেন--মাত্র ১৬ হাজার ৫ শত ৩৪ টি ভোট পায় ফ্রান্স।
৯৯.৭২% নাগরিক স্বাধীন আলজেরিয়ার পক্ষে গণভোটে রায় দেয়৷ তারপর এক মুক্ত স্বাধীন আলজেরিয়ার জন্ম হয় 'মাগরিবে'।
আফসোস! ফানোঁ এর এক বছর আগেই এ পৃথিবী ত্যাগ করেন! আলজেরিয়া তাঁকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়।
ফ্রান্সের মত বৃহৎ শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী দখলদারের বিপক্ষে আলজেরিয়ার বিপ্লবে বিজয় সম্ভব হয়েছিল নারীদের জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত করার কারণে৷
এজন্যই নারীদের বৃহৎ সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা গেলে সেটি ইতিহাসে সুমিষ্ট ফলাফল এনে দেওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
অতএব, নারী, তার দেহ, তার সংগ্রাম এবং পোশাক গ্রহণকে কেবল একচোখে পাঠ না করে একে বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে দেখার সুযোগ রয়েছে৷
নারী, তার লড়াই, তার দেহ ও পোশাককে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণে অধ্যয়ন করলে ইতিহাসের ক্রিটিক্যাল এবং অনন্য রূপ দেখা যাবে---এ প্রামাণ্য ফ্রান্টজ ফানোঁ আমাদের সামনে রেখে গেছেন 'একটি মৃতপ্রায় উপনিবেশবাদ' গ্রন্থটিতে।
0 Comments