সর্বশেষ

বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা কেনো? | ভারতীয়দের যা জানা ভীষণ জরুরি | Bangladesh-India Relations

প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক আমরা চাই। কিন্তু যেকোনো রাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণ অন্য রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে৷ আর এই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির পরিবেশে আলু পোড়া দিয়ে নানা গোষ্ঠী নিজ নিজ মত-পথ-স্বার্থের সপক্ষে গণসম্মতি/বা অসম্মতি আদায় করতে চেষ্টা করে। 

ভারতকে— বিশেষ করে ভারতের ক্ষমতাসীন ও উগ্র জনতাকেও বুঝতে হবে—ইতিহাস সংবেদনশীল। ইতিহাস বিষয়ে বলতে হলে সাবধানে কথা বলতে হবে। তা না হলে সম্পর্ক শীতল হয় বা এতে ফাঁটল ধরে।

ভারতকে ভাবতে হবে যে সৌরভ গাঙ্গুলি, শচিন, যুবরাজ, লক্ষণ, দ্রাবিড়, জহির খান, আজাহার উদ্দিন, শেওয়াগ, কাইফ, ইউসুফ-ইরফান পাঠান, অজিত আগারকার প্রমুখের খেলা দেখে বাংলাদেশে তাদের বিশাল সমর্থক ছিলো সেই সমর্থন কেন হ্রাস পেলো? এর পিছনে বাংলাদেশের উগ্র ভারতীয় সমর্থকদের ভূমিকাও আছে, কিন্তু তার তেল-জ্বালানিতো ভারত থেকে আসে বলেই ধরা যায়। সেটি থামানোর জন্য কি ভারতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কোনো ভাবনা আছে? ভাবতে হবে। 

একই কথা বাংলাদেশের মানুষের প্রতিও প্রযোজ্য। আপনি যখন আপনার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন তখন অপর দেশ বা জাতির ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া সীমা যেন অতিক্রম না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। 

বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ২০২৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের পরাজয়ে উল্লাস করা বাংলাদেশীদের যেভাবে দেখিয়েছে সেটি ইন্টারনেটের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয়দের জন্য উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর উপলক্ষ্য হতে পারে— এটি আগেই ভাবা দরকার ছিলো। 
২।
একটি কথা ভুলে গেলে অন্যায় হবে। 
এ দেশের সমস্ত অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকই বাংলাদেশের প্রেমিক তা নয়। তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উগ্র পাকিস্তানেরও সমর্থক। আবার, উগ্র ভারতেরও সমর্থক রয়েছে। এ সমর্থন কিন্তু নিরীহ নয়৷ খেলার মধ্যে রাজনীতি আনবেন না--এটাও এই শ্রেণিটির রাজনীতিই৷ 
অর্থাৎ, পাকিস্তান করেনা এ সমর্থক যেমন অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক ছিলো, তদ্রুপ ক্রিকেটে ভারতের মোড়লগিরি এবং বাংলাদেশের দর্শকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাসহ নানা কারণে অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক ছিলো। কিন্তু আমাদের মিডিয়ায় কাজ করা সঙবাতিকরা 'চেরি পিক' করে ভারতের ব্যাপারে ভীষণ বিদ্বেষ প্রকাশ করছে যারা এমন অনেকের বক্তব্যও প্রচার করেছে। 

এটি ভারতবর্ষের উগ্র মুসলমানবিদ্বেষীরা আবার 'বাংলাদেশের প্রধান বয়ান' (Dominant Narrative) হিসেবে অপপ্রচার করে। এতে বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষী উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাই অংশ নেয় অধিক। এর কারণ বাংলাদেশ ও মুসলমান-বিদ্বেষী মনোভাব পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের প্রায় সর্বত্র ভোটের রাজনীতিতে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গোষ্ঠী কিন্তু এবার বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পুজো হওয়ায় রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারেনি। তারা ফায়দাটি লুটলো তাইলে কীভাবে? এই ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে। 

তথ্য নৈরাজ্যের (Information Disorder) এই সময়টিতে মানুষ কিন্তু বস্তুনিষ্ঠতা ও তথ্যের সত্যতার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। তারা নিজের আবেগ ও অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে তথ্য গ্রহণ বা বর্জন করে। একে ইংরেজিতে নাম দেওয়া হচ্ছে Post-truth অবস্থা। এমন অবস্থায় মূলধারার গণমাধ্যমের একটি বড় ভূমিকা থাকে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ঠ্যাকানোর জন্য। আমার মনে হয়, সময়টিভিসহ বাংলাদেশের মূলধারার অধিকাংশ গণমাধ্যম 'চেকপোস্ট' হিসেবে দায়িত্ব পালনে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত কারণে গাফিলতি করেছে। 

৩। 
ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বন্ধু রাষ্ট্র। কিন্তু আন্তঃদেশীয় নদীর পানিবৈষম্য, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড এবং অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে আমাদের দেশের মধ্যে ভারতের 'দাদাগিরির' ব্যাপারে একটি সাধারণ নেতিবাচক গণমানস গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর উগ্র আরএসএস কর্তৃক ভারতীয় মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করা, গরু নিয়ে রাজনীতি, কাশ্মীরের ওপর অবিচার, এনআরসি এর নামে ভারতীয় মুসলমানদের তাড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা, বাবরি মসজিদের জায়গায় সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতা, ২০২০ এ প্রকাশ্যে দিল্লিতে মুসলিম নিধন, মোদির বাংলাদেশে আসার প্রতিবাদে বাংলাদেশে সংঘর্ষ এবং তাতে প্রাণহানী, ফারাক্কা বাঁধ, বিজেপি নেতাদের অখণ্ড ভারতের অলীক কল্পনার সপক্ষে উগ্র সম্প্রসারণবাদী বক্তব্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদানে ভার‍তের আপত্তি, সার্ক বন্ধ করে দেওয়া, এবং সর্বশেষ অবৈধ ইসরায়েলের খুনী বাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনের গাজার ওপর ভয়াবহ জাতিনিধন ও গণহত্যায় ভার‍তের সমর্থন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব জন্ম দেয়। এর দায় বেশিরভাগ ভারতের। একে রাজনৈতিক বিজ্ঞানে বলে 'বুমেরাং' (Blowback) অর্থাৎ ভার‍তের নীতি বা কর্মের ওপর ভিত্তি করে এই বিরোধ তৈরি হয়েছে। এটি এককভাবে বাংলাদেশের মানুষের দায় নয়। এককভাবে যেহেতু ভারতের বা বাংলাদেশের নয়, সেহেতু বৃহৎ প্রতিবেশি হিসেবে ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক কর্মীদের দায়িত্বশীল আচরণ থাকা জরুরি। কারণ, ভারতের হিজিমনির প্রতিহিজিমনি যৌক্তিক কারণেই তৈরি হওয়া সহজ।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে ক্লাসে আমাদের শিক্ষক শেখ আদনান ফাহাদ স্যার একটি কথা বলতেন যে, ভারতকে বুঝতে হবে যে, এই অঞ্চলে কেবল বাংলাদেশই তার অকৃত্রিম বন্ধু। অন্যদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতো দীর্ঘসময় ভালো নয়। কিন্তু এই কথাটা ভারতের অনেকে বোঝে না৷ 

আর এ কারণেই তারা কথায় কথায় ১৯৭১ এর সহযোগিতার খোটাটি দিয়ে আমাদের ওপর তাদের প্রভুত্বকে জায়েজ করতে চায়৷ ১৯৭১ এর মুক্তির লড়াইয়ে ভারতের অসামান্য অবদান আমরা অস্বীকার করিনা, কিন্তু এককভাবে আমাদের চিরকাল ঋণী করতে চাওয়া এই বয়ানের প্রতিবয়ানও তো রয়েছে। সেটি ভারতীয়দের মধ্যে স্বীকার করার প্রবণতা খুবই কম বা একেবারে বিরল। 

৪। 
পাকিস্তানী অত্যাচার, অবিচার ও দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য আমরা যুদ্ধ করি৷ এই যুদ্ধটি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সশস্ত্র রূপ ধারণ করে, কিন্তু এ যুদ্ধের শুরু তো সেই ১৯৪৭ সালেই যখন শেরে বাংলা, বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাই বৃহৎ বাংলাদেশ গঠন করতে চেয়েছেন৷ সেই সময় কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা আর মুসলিম লীগের উর্দুভাষী কুচক্রী ও নির্বোধদের কারণে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি৷ কিন্তু লড়াই সেই সময় থেকেই শুরু হয়। সলিমুল্লাহ খান - Salimullah Khan এর মতে, পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন। আমি অবশ্য মনে করি স্বাধীনতা আন্দোলন আরো আগের, সেই ১৭৫৭ সালের পর থেকে ফকির সন্ন্যাসী, তিতুমির, সাঁওতাল বিদ্রোহ, শরিয়ত উল্লাহ, প্রীতিলতা প্রমুখ যে লড়াই শুরু করেন তার থেকে৷ কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে মুসলমানদের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের নিকট পরম শ্রদ্ধেয় সিরাজ উদ দৌলা প্রমুখের ব্যাপারে বিজেপিপন্থী অপপ্রচার সেলের অপমানজনক অপপ্রচারণা বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে।
 
আমাদের স্বাধীনতার একটি উল্লেখযোগ্য তারিখ ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ। অর্থাৎ মূল কথা ১৯৭১ সালের আগেই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ এই পুরো সময়টিতে বঙ্গবন্ধু, ভাসানীসহ বহু নেতা স্বাধীনতার জন্য বাঙ্গালী জাতিকে প্রস্তুত করেন। এর পরিণতি ১৯৭১ সালের ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।  

এ যুদ্ধটি ভারতের বয়ানে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ—ঠিক পাকিস্তানের বয়ানের হুবহু রূপ। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে এ যুদ্ধ তো নিজেদের স্বাধীনতার যুদ্ধ—মুক্তিযুদ্ধ। ভারত এ মুক্তিযুদ্ধে পার্শ্বচরিত্র। এ যুদ্ধের নায়ক বাংলাদেশের বাঙ্গালী জাতি। বাঙ্গালী সামনে লড়াই করেছে, রক্ত ও ইজ্জত দিয়েছে, ভারত আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, প্রশিক্ষণে সহায়তা করেছে। তারা যুদ্ধের লড়াকু মজলুম নায়ক জাতির বন্ধু, প্রভু নয়। 

এ যুদ্ধের খলনায়ক পাকিস্তানী দখলদার ও খুনীরা। দুঃখের বিষয় খলনায়ক ও পার্শ্বনায়ক মিলে মূল নায়কের বিপরীত বয়ানকে একসঙ্গে সমর্থন করছে। 

ভারতের চলচ্চিত্রে দীর্ঘদিন ধরে এই অপবয়ান সেলাই করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটি নিয়ে আমাদের দেশের রাজনীতিক থেকে সাংস্কৃতিক কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে বুদ্ধিজীবী এবং বিশেষ করে গণমাধ্যমে কোনো সুস্পষ্ট প্রতিবাদী অবস্থান নাই। বাংলাদেশের একটি গণমাধ্যমে 'পিপ্পা' এর পর্যালোচনায় আমি বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তৃক সম্পদ ও অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার আলাপ করায় এটি প্রকাশের জন্য ভারতের ক্রিটিক সরাতে বলছে।  আমার বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান এই ভারত ও পাকিস্তানের চশমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখার অপবয়ানের বিরুদ্ধে।  

৫। 
তাহলে ভারতীয়দের খোটার জবাবটা আসলে কী? বলছি। শুনুন। 
ভারতীয়রা আমাদের জন্য উপকারী--এই সিদ্ধান্ত বা উপপাদ্য নিঃসন্দেহে সত্য। কিন্তু এই উপপাদ্য পূর্ণ নয়, এটি আংশিক সত্য৷ পূর্ণাঙ্গ সত্য উপপাদ্যটি হবে: বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের জন্য উপকারী। 
এর বিপরীত কী? পরস্পরের সুসম্পর্ক মজবুত না হলে উপকারী সত্তা কিন্তু টেকসই হবেনা। ভারত বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে এটি ধ্রুব সত্য। এ সাহায্য 'স্বার্থে বা নিঃস্বার্থে' কী না সেই আলোচনায় না গিয়ে আমি ভূরাজনৈতিকভাবে এই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথভাবে লাভবান হওয়ার হিসাব কষবো। 

মুক্তিযুদ্ধে মজলুম জাতি অপর জাতির সহায়তা নিতেই পারে। এ সহায়তা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকাও তার মুক্তিযুদ্ধে নিয়েছিল--ফরাসীদের থেকে। কোনো মুক্তিযুদ্ধ এককভাবে সম্ভব নয়। 

ফ্রানৎস ফাঁনোর লেখায়ও দেখবেন ফরাসীদের বিরুদ্ধে  আলজেরিয়ার বিপ্লবে সিরিয়া, মরক্কো থেকে সহায়তা করা হয়। 

তো ভারত আমাদের সহায়তা সেই সময়ের পৃথিবীর বাস্তবতায় করেছিল। পাকিস্তান ছিলো চীন-আমেরিকাপন্থী, ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী। আমেরিকার ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন কেউই চায়নি। স্বাভাবিকভাবেই ভারত বাংলাদেশের সমর্থন করে। আর ১৯৪৭ সালের দগদগে ক্ষত তো আছেই৷ পাকিস্তানের পরাজয় মানে ভারতেরই জয় আর সেটি যদি ন্যায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙে ফেলার মাধ্যমে আনা যায় তাহলে তা সোনায় সোহাগা! সেটিই পিপ্পা চলচ্চিত্রে ব্রিগেডিয়ার মেহতা ও ইন্দিরা গান্ধী বলেন—তবে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। 

আমাদের ভারতীয় দাদা-দিদি-ভাই-বোনদের এটা মনে রাখা জরুরি যে, হ্যাঁ আমরা বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু এটি ভূরাজনৈতিকভাবে ভারতকে সংহত করেছে। 

একবার ভাবেন—দুই পাশে দুইটা পারমাণবিক অস্ত্র সংবলিত পাকিস্তান (যার মধ্যে পূর্বপাকিস্তান একেবারে ভারতের কলিজার ভেতরে)—ভার‍তের জন্য মোটেই সুবিধাজনক হতো না। ফলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম কেবল বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দেয় তা নয়—১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ভারতকেও তার জাত শত্রুর আসন্ন পারমাণবিক বোমা বহনকারী ক্ষেপণাস্ত্র থেকে নিরাপদ করে। 

এভাবে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নয়, তা ভারতেরও স্বস্তিকর ক্ষণ। ভারতের মানুষের মধ্যে ইতিহাসের এই নির্মম সত্য মেনে নেওয়ার প্রবণতা একেবারেই কম। তাদের নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশের প্রতি ঐতিহাসিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা শিখতে হবে। 

আর একটু প্রাচীন ইতিহাসে গেলে দেখা যাবে বাংলাদেশই আলেকজান্ডারের কবল থেকে ভারতকে রক্ষা করেছে। আলেকজান্ডার যে বীরের ভয়ে ভারত ছেড়ে পালিয়েছেন সেই মহাবীর এই পূর্ববঙ্গের এক মহান বীর। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় গঙ্গাহৃদয় মহারাজ্যের রাজধানী ছিল—প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের অনেকেই বলেন। 

দিল্লিতে ক্ষমতায় বসা মুঘল-আফগান যেই হোক তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই জারি রাখে বাঙ্গালী --বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙ্গালী। এর প্রাচীন নাম 'বুলগাকপুর'--বিপ্লবের দেশ। বেদের ঐতরেয় আরণ্যকেও এই ভূখণ্ডের অনার্য বিপ্লবীরা আর্য বহিরাগতদের থামিয়ে দিয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। 

সুতরাং বাংলাদেশেকে সৃষ্টি করা জাতীয় অশিক্ষিত শুভেন্দু মার্কা কথাবার্তার আদতে ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নাই৷ ঐ তত্ত্বে গুরুত্ব দিয়ে এই তর্কে গভীরভাবে অংশ নিলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশই মূলত ভারত বা পাকিস্তানকে তৈরি করেছে, কারণ আমাদের শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের 'লাহোর প্রস্তাব'ই তো ভারত আর পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ভিত্তি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি বাঙ্গালী মুসলমান কাজী নজরুল ইসলাম সবার আগে ব্রিটিশদের তাড়ানোর কথা বলে 'ব্রিটিশ ভগবানেরও  বুকে পদচিহ্ন' এঁকে দিতে চেয়েছেন। তাই না? এ কারণে অধ্যাপক ড. আজফার হোসেন বলেন: নজরুল সবার আগে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। 

*বিশেষ আলাপ: এটি ফেসবুকে লেখার পর এখানে দিলাম।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জয় মানে ভারতেরই জয়, এ শর্তের ওপর ভিত্তি করে হোক আর যেভাবেই হোক ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটি আমাদের। বাংলাদেশের বাঙ্গালী জাতি মুক্তিযুদ্ধের নায়ক, ভার‍ত নায়কের সহযোগী, পাকিস্তান নরপিচাশ খুনী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিলো, ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারালো পাকিস্তানী জালেমদের কবলে অথচ ভারত এ যুদ্ধকে পাকিস্তানের মতই 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ' হিসেবে পাঠ করে! বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে সহযোগী পার্শ্বচরিত্র আর খলনায়কের বয়ান এক কেনো হবে?

ইতিহাসের এই সংবেদনশীল অংশটি ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনীতিক-শিল্পী-সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে গঠিত সমাজ ন্যায্যভাবে পাঠ করছেন না৷ আর এর প্রতিধ্বনি ভারতের জনসাধারণের উগ্র একটি অংশের মধ্যে প্রবলভাবে দেখা যাচ্ছে। এরা ভুলে যায় যে বাংলাদেশের সহযোগিতা ছাড়া সীমান্তবর্তী স্বাধীনতাকামী প্রদেশগুলোর অস্থিতিশীলতা ভারত কোনোদিন থামাতে পারতো না। এর ভুলে যায় বাংলাদেশ ছাড়া পুরো এশিয়ায় ভার‍তের আর কোনো বন্ধুরাষ্ট্র নেই। এরা ভুলে যায় অখণ্ড ভারতের কল্পিত শরবত ইতিহাসের কোনোকালেও পূর্ববাংলার মানুষ খায়নি। দিল্লিকে চ্যালেঞ্জ করেই প্রতিটি কালে, প্রতি যুগে বাংলা তার নিজের প্রভাব প্রতিপত্তিসহ টিকে ছিলো। ভবিষ্যতেও ইন শা আল্লাহ থাকবে। ..) 


৬। 
এখন, 'ভারত থেকে আমাদের সব পণ্য আসে'— এই খোটাটার ব্যাপারে আলাপ করি। এ বিষয়ে আমার অবস্থান আগে পরিষ্কার করি। যারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বা তারও আগে থেকে চেনেন তারা জানেন, আমি একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতাম। আমার সেই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিলো: বাজারে প্রচলিত দুই বা ততোধিক সমজাতীয় পণ্যের একটিও যদি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য থাকে আমরা সেটি কিনবো। এই নীতিতে আমি বিদেশী পণ্য বর্জনের পক্ষে। 

তারপরও আমরা ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পণ্য ব্যবহার করি। আমাদের সংকটের সময় করতে হয়। এই পণ্যগুলো কিন্তু এমনিতে খাতির বা পিরিতে আমাদের কোনো রাষ্ট্র দেয় না। আমরা এগুলো ন্যায্যমূল্যের ক্রয় করি। তাই ভারত আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য করে এতে আমরাও লাভবান হই, তারাও লাভবান হয় এটিই আসল সত্য। এটি একপাক্ষিক বিষয় নয়। 

ভারতীয়দের এটি মনে করিয়ে দিতে হবে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই আর্থিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের বাজারই ভার‍তের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত সবচেয়ে বড় বাজার। জনসংখ্যার বিচারে এই বাজার পুরো পশ্চিম ইউরোপীয় বাজারের চেয়েও বড়। এই বাজারে অনেকটা একচেটিয়া ব্যবসা করে ভারতের ব্যবসায়ীরা (চীনের ব্যবসায়ীরাও করে, তবে তাদের পরিবহণ খরচ আছে, ভারতের তা নেই)। বাংলাদেশ পণ্য না কিনলে ভারতের ব্যবসায়ীদের ক্ষতির বিষয়টিও ভারতীয় বন্ধুদের মনে রাখা উচিত। কেবল অপরকে খোটা না দিয়ে নিজেদের নির্ভরতাটিও মনে রাখা উচিত। 

আর, বাংলাদেশ কিন্তু ভুটান বা নেপালের মত সাগরবিহীন নয়। আমাদের রয়েছে বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের মালিকানা। অর্থাৎ কাতার, নেপাল, ভুটানের মত বাংলাদেশের বিকল্প বাণিজ্যের পথ বন্ধ নয়। পাশাপাশি, মিয়ানমার তো আছেই বাণিজ্যের জন্য। এ কারণে আমি ভারত বা মিয়ানমার কারো সঙ্গেই বাণিজ্যের পথ বন্ধ করার পক্ষে নই। আমাদের বিকল্প পথ খোলা রেখে অপরকে বোঝাতে হবে আমি পুরোপুরি তোমার ওপর নির্ভরশীল নই। আমার আকাশ ও জলের মতই স্থলেও তোমার বিকল্প আছে—ভারত ও মিয়ানমারকে এটি জানাতে হয়। 

৭। 
এটি গেলো আমাদের পণ্য আসার ব্যাপারে আলাপ। বাংলাদেশের থেকে কি ভারতে পণ্য যায় না? অবশ্যই যায়৷ আমাদের ইলিশ, শাড়িসহ অনেক পণ্যেরই ভারতে ব্যাপক চাহিদা আছে৷ যদিও ভারত তার সংরক্ষণবাদী নীতির কারণে এটি প্রকাশ করে না--কিন্তু আমাদের দেশের পণ্য এবং সংস্কৃতির আলাদা গুরুত্ব ভারতে আছে৷ আমাদের ইলিশ ওদের ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ইলিশ ছাড়া পুজোই তো হয় না, কিন্তু গরু কিন্তু আমাদের ধর্মের আবশ্যক কিছু না। বরং ওরা গরু রপ্তানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের গরুর খামারিদের বিশাল উদ্যোগ ফের জমজমাট হয়। একইভাবে কৃষিপণ্যসহ যে পণ্য ভারত আটকে রেখেছে সেই পণ্যেই বাংলাদেশ স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। 

ভূমির গঠন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সেতুবিন্দু হওয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ স্বনির্ভর। তাকে আটকে রাখলে ভারতেরই ক্ষতি। এ কারণে, বাংলাদেশে পণ্য পরিবহণ বন্ধ করলে ভারতের ব্যবসায়ীদের চাপেই সে দেশের সরকারকে পড়তে হয়। অতএব খোটা দেওয়ার চিন্তা বাদ দেন৷ আমরা উদার বলে পালটা খোটা দেইনা। আমাদেরও তো বলার অনেক কথা আছে। 

ভার‍তের লেখকদের ভাত জোটেই কিন্তু বাংলাদেশে বই বিক্রি করে। ভার‍তের বিভিন্ন চ্যানেল চলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ও দর্শকদের ওপর ভিত্তি করে। ভারতীয়দের চলচ্চিত্র ও গানের বড় বাজার বাংলাদেশে। একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, মধ্য ও উত্তর ভারতের উগ্ররা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ভাষার পার্থক্য থাকায় লাগতে পারছেনা, এই লাগালাগির কাজটি বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত বর্ণহিন্দুরাই করছে। এরাই ১৯৪৬ সালে মুসলিম নিধন করা ভয়াবহ কলকাতা গণহত্যার এ যুগের গেরুয়া শিবসেনা। এরা ভুলে যায় কলকাতাসহ আধুনিক পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম, ত্রিপুরার উন্নয়ন ঘটেছে পূর্ববঙ্গের সম্পদ ও পূর্ববঙ্গের মানুষের শ্রম ও ঘামের ফসল দিয়ে! কেন ৫০% এর অধিক জনসংখ্যা মুসলিম থাকার পরেও আজ কলকাতায় মুসলমান নাই সেই আলোচনার কিছুটা 'বাঙালনামায়' অক্সফোর্ড শিক্ষক তপন রায়চৌধুরী আর হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে জয়া চট্টোপাধ্যায়ের বইয়ে কিছুটা আলাপ আছে। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী', আবুল মনসুর আহমদের 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর', আবুল হাশিমের 'আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি', সলিমুল্লাহ খানের 'উৎসর্গ' প্রভৃতি গ্রন্থও পড়তে পারেন।

৮। 
বাংলাদেশে বৈধ অবৈধভাবে কম করে ১০ লাখের ওপরে ভারতীয় নাগরিক কাজ করে জীবীকা নির্বাহ করছে । বিশেষ করে গার্মেন্টসসহ আইটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বহু ভারতীয়দের দেখা যায়। ভিন্ন প্রসঙ্গ তবে বলে যাই, এসব আয় করের আওতায় আছে কী না সেটিও আলাপ করতে হবে৷ বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পের থেকে ভারতীয়রা লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে সরাসরি পণ্য আসায় সবচেয়ে স্বল্প খরচে ভারতীয় পণ্য পরিবহণ হয়। 

অন্যদিকে ভার‍তের পূর্ব অংশ মূল ভারতের সঙ্গে শক্তিশালীভাবে যুক্ত থাকাটা পুরোটাই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য ও অস্ত্র পরিবহণ করার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের নিতেই হবে। ইতোমধ্যে আমাদের স্থল বন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ট্রাঞ্জিটের মাধ্যমে একেবারে প্রায় বিনামূল্যে ভার‍ত তার বিভিন্ন প্রদেশে পণ্য পরিবহণ করছে। গঙ্গা, ফেনীসহ বিভিন্ন নদীর পানিও ভারত ভাগের অংশের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। এসব বিষয়ে ভারতীয়দের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মানসিকতা তৈরি হওয়া জরুরি। পরস্পরকে সম্মান করলেই সবার উপকার। অসম্মানে অপকার।

৯। 
এবার আসি ভারতীয়দের সামাজিক মাধ্যমের একটি পপুলার ভুল বয়ানের ব্যাপারে। ২৪ নভেম্বর ২০২৩ বিবিসি বাংলায় ' বিশ্বকাপ ফাইনালে ভার‍তের হারে প্রতিক্রিয়া ঘিরে 'বয়কট বাংলাদেশ' ডাক পশ্চিমবঙ্গে' শীর্ষক খবরও করে। 
খবরে হিন্দুত্ববাদীদের অপপ্রচার সাফল্যের সঙ্গে প্রচার করে অমিতাভ ভট্টশালী, কোথাও বাংলাদেশের দর্শক বা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য নাই। থাকলে বুঝতে পারতো ভারতীয়দের অপপ্রচার কেন ভুয়া। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দর্শকদের অপমান এবং বাংলাদেশের কোনো ম্যাচে ভারতীয়দের সমর্থন না থাকা এবং নির্লজ্জের মত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সমর্থন দেওয়া, বাংলাদেশের টাইগার শোয়েবের বাঘ ছিঁড়ে তাকে অপমান করা যে ভারতীয়দের ব্যাপারে বাংলাদেশের কট্টর ভারতপন্থী সমর্থককেও ক্ষুব্ধ করেছে সেটি বিবিসির সংবাদে সূক্ষ্মভাবে অমিতাভ ভট্টশালী এড়িয়ে গিয়েছে। 

দার্জিলিংসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে নাকি বাংলাদেশের পর্যটকদের ভ্রমণে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে ভারতীয়রা। বাংলাদেশের সমর্থকদের একটি অংশের (পুরো বাংলাদেশ নয়। পুরো বাংলাদেশে ভারতীয় ক্রিকেট দলের এখনো বিশাল সমর্থক রয়েছে) অস্ট্রেলিয়ার সমর্থক হয়ে উল্লাসের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এই অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে অনেক উগ্র হিন্দুত্ববাদীই হাতে তালি দিচ্ছে। তবে আমার বিশ্বাস ভারত সরকার আত্মঘাতী এই সিদ্ধান্ত কখনোই নেবেনা। তাও কিছু ফেসবুকার ও ইউটিউবার এটি প্রচার করছে!
কিন্তু এরা জানেই না অথবা জেনেও না জানার ভাণ করে ঘুমাচ্ছে যে, এতে বাংলাদেশেরই বরং লাভ। 

বিবিসিতে কী বলছে?

এ নিয়ে সর্বশেষ যে তরজা চলছে, তা শুরু হয় দার্জিলিংয়ের রায়োপোরাস তাকসাং নামের হোটেলটির একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে।


ওই হোটেলটির মালিক মি. রাম সরকার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “বিশ্বকাপে ভারত হারার পরে বাংলাদেশিদের একাংশ যেভাবে আনন্দোৎসব করছেন, উচ্ছাস প্রকাশ করছেন, তা দেখে ভারতীয় হিসাবে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। খেলাতে হার-জিত তো থাকেই কিন্তু এ তো জাতি বিদ্বেষের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তারা।“

“সেজন্যই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম। আমাদের এখানে এসে থাকবেন, আবার গালাগালিও দেবেন, দুটো তো একসঙ্গে চলতে পারে না। সব কিছুর একটা সীমা থাকা দরকার,” বলছিলেন মি. সরকার।

তার দাবী, তার হোটেলে নিয়মিতই বাংলাদেশি পর্যটকরা আসতেন।

বিবিসির এই সংবাদটি অপপ্রচার এবং ভট্টশালী এটিকে প্রচার করেছে কারণ সেও ঐ উগ্রদের দলে। কারণ, বাংলাদেশীরা ওখানে ফ্রিতে থাকেনা, টাকা দিয়ে থাকে ও খায় এবং বাংলাদেশীদেরও গালিগালাজ করে উগ্র ভারতীয়রা। 

বাংলাদেশের ভ্রমণপিয়াসীদের বা টাকাওয়ালাদের পয়সাগুলো বাংলাদেশেই থেকে যাবে৷ এতে ক্ষতি হবে ভার‍তের পর্যটন শিল্পের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-কলকাতাসহ বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর ব্যবসায়ীদের। 

একইভাবে বিভিন্ন হোটেল ব্যবসায়ী, রেস্টুরেন্টওয়ালা, কাপড়ের দোকানদার, খাবারের দোকানদারসহ প্রায় সব শ্রেণির ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে বাংলাদেশীদের ঘোরা বন্ধ হবে? না। তারা বরং ঐ টাকা দেশে রাখবে বা বিশেষ করে নেপাল-ভুটানে উড়িয়ে আসবে। ক্ষতিটা কার হবে? বাংলাদেশের কিছুতেই না। 

মিথিলার স্বামী সৃজিত যে ইন্দিরা গান্ধী আর ডালমিয়াকে ডাকলো এক্সে, এটিও তার ইতিহাসজ্ঞান না থাকার কারণে। ইন্দিরা আর ডালমিয়ার লাভের কথা ভাববেনা? ও হ্যাঁ, আইপিএলে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের না নেওয়া বা বিপিএলের ব্যাপারে ভার‍তের নাক সিঁটকানোও বাংলাদেশের মানুষের পছন্দ নয়। 
বিবিসি'র সংবাদটির দিকে আরেকবার তাকাই। আনন্দবাজারের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক রূপক সাহা বলছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি না যে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ভারতের পরাজয়ে এভাবে উল্লসিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে বহু মানুষ আছেন যারা ভারতীয় ক্রিকেট আর ক্রিকেটারদের ভক্ত। একটা ছোট অংশ ভারতের পরাজয়ে এভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করছেন।' এ কথা সত্য নয়। বাংলাদেশে ভার‍তের অনেক সমর্থক আছে, কিন্তু ভার‍তের দাদাগিরি ও আনন্দবাজারি ছোটলোকীর কারণে এ ভক্তরা আর আগের মত সমর্থন করছেন না। 

তবে রূপকের পরের মন্তব্য একেবারে নির্লজ্জ গাঁজাখুরি। 

“এরকম একটা আশা হয়তো তাদের মনে জেগেছিল যে বাংলাদেশ সেমি ফাইনাল বা ফাইনালে খেলবে। কিন্তু তারা চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতা ঢাকতেই নানা আজগুবি তত্ত্ব আর ভারত বিরোধী কথা ছড়ানো হচ্ছে,” বলছিলেন মি. সাহা।


বিবিসির এই সংবাদে রূপক এই গাঁজাখোরের মত 'ব্যর্থতা তত্ত্ব' না দিলেও পারতো। বাংলাদেশের মানুষ রূপকের মত ভার‍তের নাগরিকদের এই বদমায়েশীতে পূর্ণ আচরণের কারণেই বিরক্ত। কেবল সেমিফাইনালে না খেলতে পারার জন্য এমন কেন করবে? ২০১৫ বিশ্বকাপে ভার‍তের খবরদারি, মুসলিম বিদ্বেষ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিরঞ্জিত নাক গলানোর কথা মনে থাকেনা কেন আনন্দবাজারি রূপকের?

সবচেয়ে বিরক্ত হলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক মাধ্যম বিশ্লেষক উমাশঙ্কর পাণ্ডে নামের শিক্ষকের অশিক্ষিত বক্তব্য শুনে। তিনি বলছেন, “বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যেরকম বাজে খেলেছে, তাতে ওদের সমর্থকদের হতাশ হওয়ারই কথা। একবারও উল্লাস করতে পারেন নি তারা। একটাই সুযোগ এসেছিল তাদের সামনে যখন ভারত পরাজিত হল। এদের একটা অংশ রাজনৈতিক ভাবে ভারত-বিরোধী, যারা বাংলাদেশের যে কোনও সমস্যায় ভারতের দোষ খোঁজেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ হিসাবে ভারত বাড়তি সুবিধা আদায় করে ম্যাচগুলোতে জিতেছে।“

এইসব মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ক্রমাগত দেখতে দেখতেই এবার ভারতীয় বাঙালীরাও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছেন, ব্যাখ্যা তার।

অথচ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে যাতে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দায় রয়েছে। কেবল খেলা নয়, যেকোনো বিষয়েই অনলাইন পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে ছোট করে কথা বলে ভারতীয়রা। এর প্রতিক্রিয়ায়ই বাংলাদেশীদের মধ্যে পালটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বাংলাদেশীদের 'কাংলাদেশী'সহ নানা কিছু বলে (বাংলাদেশী অনেকেও গোমূত্রখোর বলে পালটা জবাব দিয়েছে) ভারতীয় উগ্র অংশ ছোট করেছে। ফেলানীসহ শত শত বাংলাদেশীদের বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। এসব মাথায় না রাখলে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব কেন বেড়ে যাচ্ছে তা নির্মোহ দৃষ্টিতে বোঝা যাবে না।

১০।
ভারতীয়দের বুঝতে হবে তাদের যে বিশাল লাভজনক 'স্বাস্থ্য অর্থনীতি' (Health Economy) গড়ে উঠেছে এর প্রধান বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশের রোগীরা ভারতে চিকিৎসা নিতে যায়, এই চিকিৎসা কিন্তু ফ্রি নয়। পকেটের টাকা খরচ করে সেবা গ্রহণ করে। ভারতের চিকিৎসকদের প্রতি শর্তহীনভাবে আমরা কৃতজ্ঞ কিন্তু আমাদের তো ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার বাণিজ্যিক লাভ বা ঔষধশিল্পের লাভে ভূমিকা রয়েছে, তা না? সেই সত্য ভারতীয়দের স্বীকার করতে হবে। 

এ ছাড়া প্রতিটি রোগীর আত্মীয়-স্বজন বা গাইড চিকিৎসা নিতে গিয়ে হোটেলে থাকে, রেস্টুরেন্টে খায়, ঘুরে বেড়ায়, কেনাকাটা করে। বাংলাদেশের মানুষের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যায় কই? ভার‍তের মানুষের পেটে ও পকেটে। করোনা ভাইরাসের দুই বছর বাংলাদেশের মানুষ ভারতে যায়নি বলে ভার‍তের অনেকের খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকার কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা আমরা শুনেছি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ ভারতের নাগরিকদের নিকট থেকে অর্থের বিনিময়ে সেবা গ্রহণ করে, ফ্রি নয় এবং ভারতীয়রাও সমানভাবে বা অধিক উপকৃত হয়। কেন তবে কথায় কথায় খোটা? 
এই খোটা কেবল ছোটলোকী তা নয়, বরং এর মধ্যে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কীভাবে প্রতিটি দেশ পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল সেই সত্যকে অস্বীকার করার অশিক্ষাও রয়েছে। 

১১।
আলাপের শেষে চলে এসেছি। ভার‍তের সাধারণ মানুষের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ-বিদ্বেষ নাই। বরং এই ক্ষোভটি যারা ভারতকে একটি আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে খেলার মাঠ থেকে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জোর করে চাপাতে চাচ্ছে সেই ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক অংশের প্রতি। বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক দর্শক এখনো ভার‍তের ভক্ত—এটাই সত্য। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের ভেবে বের করতে হবে কোন ভুল কীর্তি বা সিদ্ধান্ত বা রাজনীতির কারণে বাংলাদেশের এই অগণিত দর্শকরা ভারতের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। 
বাংলাদেশের দর্শকদের প্রতি আমার অনুরোধ কেবল অন্ধ বিরোধিতা বা অন্ধ ভালোবাসা প্রদর্শন না করে গঠনমূলক সমালোচনা বা সমর্থন করতে হবে। 

ভারতের সাংস্কৃতিক দাসত্ব বরণ করে, ভারতের চলচ্চিত্রের বয়ান মুখস্ত গিলে, হিন্দি গেয়ে ও বলে ভারতের আধিপত্যকে পরাজিত করা যাবে না। 

তীব্র জাতীয়তাবোধ ছাড়া কিছুতেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং অর্থনৈতিক দাপটসহ অন্যান্য আধিপত্যবাদ মোকাবেলা করা যাবে না৷ নিজের দেশের, নিজের জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও পণ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

কেবল খেলার মধ্যে বিপুল উন্মাদনা আসলো অথচ নিজের ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতি ও পণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশ বা জাতিরটাকেই অগ্রাধিকার দিলেন—তাহলে আপনি জাতীয়তাবোধ ধারণ করলেন না। 

অনুরোধ, মনে রাখবেন:

হৃদয়ে দিল্লি, কলকাতা, বা ইসলামাবাদের প্রতি প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য গভীর প্রীতি থাকলে আপনি শতভাগ বাংলাদেশকে ভালোবাসতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশকে ভালোবাসতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাক অধিক। 

বাংলাদেশে ভারতপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, চীনপন্থী, রুশপন্থী, সৌদিপন্থী, আমেরিকাপন্থীসহ বহুপন্থী আছে—আমার পুরোনো সেই কথাটি জানিয়ে যাই—কিন্তু, দুঃখজনক তবে সত্য যে, বাংলাদেশে খাঁটি বাংলাদেশপন্থী একেবারেই কম।
বাংলাদেশে যেদিন বাংলাদেশপন্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে সেদিনই লাল-সবুজের বিজয় নিশান উড়বে। এর আগে আমাদের বাংলাদেশকে সবার উপরে রাখার আলোচনা জারি রাখতে হবে। হিন্দুত্ববাদী ও পাকিস্তানপন্থীদের অপবয়ানকে প্রতিরোধ করতে জারি রাখতে হবে বাঙ্গালীর জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার প্রতিটি প্রতিবয়ান।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments