খাঁটি চিন্তক বা চিন্তাযোদ্ধা কে?
আমার মতে, মানুষ ও সমস্ত প্রাণ-প্রকৃতির অধিকার নিয়ে নিঃসংকোচে সমস্ত স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যিনি ক্ষতিকর ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত, সাম্যবাদী এবং তথ্যভিত্তিক সত্য কথা বলেন তিনিই খাঁটি চিন্তক, চিন্তাযোদ্ধা। মজহার বলেন 'ভাবুক'। অনেকেই বলেন 'বুদ্ধিজীবী'।
গ্রামসি 'কারাগারের রোজনামচা'য় কাছাকাছি সংজ্ঞায় একে বলেছিলেন Organic Intellectual এবং আমাদের দেশের 'ইনঅর্গানিক' ভেজাল একাডেমিশিয়ানরা একে অনুবাদ করেন 'জৈব বুদ্ধিজীবী' বা বেশি হলে 'জন/গণবুদ্ধিজীবী' নামে! এ নিয়ে উস্তাদ সলিমুল্লাহ খান - Salimullah Khan প্রায়ই গোস্বা করেন।
২।
তো এই খাঁটি আর ভেজাল চিহ্নিত করতে আমার প্রিয় ইহুদি পণ্ডিত নোয়াম চমস্কির একটি সংজ্ঞা আমি ব্যবহার করি। চমস্কি ১৯৬৭ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি The New York Review of Books এ প্রকাশিত The Responsibility of Intellectuals নিবন্ধে বলেন:
It is the responsibility of intellectuals to speak the truth and to expose lies
সরল বাংলা তরজমায় কী হয়?
বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হচ্ছে সত্য বলা এবং মিথ্যাকে উন্মোচন করা।
সংস্কৃত শব্দ দায়িত্ব কিন্তু দায় এর সঙ্গে যুক্ত। অভিধানেই পাবেন, কোনো কাজের ভালো-মন্দের দায়, এই কাজের ঝুঁকি গ্রহণ, দায়িত্ব গ্রহণ ইত্যাদি। দায়িত্ব যার দায়ও কিন্তু তার।
বুদ্ধিজীবীর এ কারণে কেবল এসি রুমে বসে থাকাই কাজ নয়, কেবল স্লাইড রিডিং পড়াও কাজ নয়, কাজ নয় কেবল বড় বড় প্যাঁচের শব্দ বলে নিজেকে জাহির করাও।
প্রকৃত বুদ্ধিজীবী কেবল বুদ্ধিব্যবসায় নিয়োজিত থাকবেননা। তার কাজ সব ধরনের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতি, পুঁজি এবং মুনাফার প্রভাব থেকে চিন্তার খাঁটি স্রোতকে প্রবহমান রাখা। সেটি না রাখলে তিনি আর খাঁটি চিন্তক নন, তিনি প্রচলিত অর্থে বুদ্ধি ব্যবসায়ী হতে পারেন—খাঁটি চিন্তাযোদ্ধা নন।
৩।
এ রকম একজন ভেজাল বুদ্ধিজীবী জার্মানীর জার্গন হ্যাবারমাস (জার্মান উচ্চারণ এমন নয়)। 'জনপরিসর' (Public Sphere) ধারণার জন্য খ্যাত। সম্প্রতি ১৩ নভেম্বর ২০২৩ এই লোক ইসরায়েলের গনহ%৳ত্যার সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে জার্মান ভাষায় কোর্স করায় কিছুটা বুঝতে পারি তাদের ভাষা।
'নরমেটিভ অর্ডারস ডট নেট' ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আধুনিক ফ্রাঙ্কফুর্ট ইশকুলের নামকরা পণ্ডিতদের এই বিবৃতিটি দেখে আমি খুবই বিব্রত হয়েছি!
মনে হচ্ছে, এ ব্যক্তিসমষ্টি তো কোনো ক্রিটিক্যাল থিংকার নন, কোনো অর্গানিক ইনটেলেকচুয়াল নন—ইনারা ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধীদের সেই এন্টিসেমেটিক বাণিজ্যের পুনরুৎপাদন করছেন।
ইহুদি তাত্ত্বিক এবং এ পৃথিবীর অন্যতম সেরা চিন্তক নরম্যান ফিংকেলস্টেইন 'হলোকস্ট বাণিজ্যের' যে তথ্য হাজির করেছেন অবৈধ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হ্যাবারমাস সেই বাণিজ্যেরই একজন পাতিবিক্রেতা আকারে হাজির হলেন!
৪।
হ্যাবারমাস কী বিবৃতি দিয়েছেন?
'Principles of solidarity' শিরোনামে প্রথমেই এই হ্যাবারমাসসহ আরো তিন তাত্ত্বিক যথাক্রমে নিকোল ডাইটেলহফ, রেইনার ফর্সট, ক্লস গুন্থার দখলকৃত ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর ওপর চলমান ইসরায়েলের গণহত্যার পক্ষে সংহতি জানান।
এরপর ল্যাখেন 'The current situation created by Hamas‘ extreme atrocity and Israel’s response to it...' অর্থাৎ বর্তমানে ৭ অক্টোবর ২০২৩ এর পর যে বর্বরতা ইসরায়েলি রক্ষী বাহিনী আইডিএফ চালাচ্ছে সেটির জন্য দায়ী মূলত গাজায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হামাস সংগঠন! কিন্তু এই সংকটের সূচনাবিন্দু কিন্তু ১৯৪৮ এর আগে থেকে ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী ইহুদিদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনীদের জাতিগতভাবে নির্মূল করে তাদের ভূমি ও সম্পদ দখল করা থেকে। আরো আগে গেলে ১৯১৭ সালের ২ মে ঘোষিত বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে। আরো আগে গেলে ১৮৯৬ এ ইহুদি কট্টরপন্থী থিওডর হার্জেলের 'রাজনৈতিক জিওনবাদ' এর প্রকাশ হওয়া থেকে।
হ্যাবারমাস এই ইতিহাসের কাছে না গিয়েই হামাসকে সমস্ত দায় দিচ্ছেন যা তার বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার প্রমাণ।
৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ২০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ৭৩ দিনে ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী ১৯,৬৬৭ জন ফিলিস্তিনীকে হত্যা করে যার মধ্যে ৫০% এর অধিক নারী ও শিশু এবং প্রায় ৯০% বেসামরিক লোকজন। পুরো গাজার ১% মানুষকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। অথচ ১১৪০ জনের বিপরীতে এই জুলুম নিয়ে হ্যাবারামাসপাল কিছুই বললেন না! তাইলে তার বিশুদ্ধ চিন্তাসত্তা আর থাকে?
ইসরায়েলের যদি 'রেস্পন্স করার অধিকার' থাকে তবে ফিলিস্তিনিদেরও সেই অধিকার নিশ্চয়ই আছে। তাই নয় কী?
অনেকটা মিথ্যা কথাই বলেছেন উনারা যে হামাস এই আক্রমণ চালিয়েছে ইহুদিদের নির্মূল করার জন্য। কিন্তু এই আক্রমণ যে ইসরায়েলের নিপীড়নের বুমেরাং (Blowback) সেটি উনারা না ভেবে লিখেছেন,' The Hamas massacre with the declared intention of eliminating Jewish life in general has prompted Israel to strike back.' অর্থাৎ হামাসের আঘাতের পরই ইসরায়েল পালটা আঘাত করেছে যা সর্বৈব মিথ্যাচার। কারণ, দখলকৃত জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে তো হামাস নাই, সেখানে কেন ইসরায়েল কয়েক হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলো এবং এখনো করে যাচ্ছে। আর, এই অক্টোবরের আগে কি ইসরায়েল গণহত্যা চালায়নি গাজায়? জেরুজালেমে? জেনিনে? রামাল্লায়? নাবলুসে? বেথেলহামে? পশ্চিম তীরে?
অবশ্যই চালিয়েছে।
৫।
একজন ক্রিটিক্যাল থিংকার হওয়ার পরেও হ্যাবারমাস তার গংসহ ক্রিটিক্যালি এই ঘটনার ব্যাখ্যা করেননি। কারণ, হামাস (বা তার সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল কাসাম ব্রিগেড) তো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও পঠিত হতে পারে। নোয়াম চমস্কি, মিয়ার্শিমার, ফিংকেলস্টেইন তো তাইই বলছেন। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণে বা ফাঁনোর বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতেও ফিলিস্তিনিরা মুক্তির জন্য লড়াই করছে৷ তাদের গণহত্যা করে নির্মূল করার প্রতিবাদে তাদের প্রতিরোধ করার অধিকার সমস্ত আন্তর্জাতিক আইনে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানতত্ত্বে স্বীকৃত অধিকার। জনপরিসর নিয়ে আলাপ করা হ্যাবারমাস গং সেই কথা বেমালুম ভুলে জিয়নবাদী শয়তানদের বুদ্ধিবৃত্তিক সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলো!
ইসরায়েল একটি সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদী বৈষম্যযুক্ত রাষ্ট্র (Apartheid State) এটা সর্বজনস্বীকৃত। তারা যে গাজাসহ দখলকৃত ভূখণ্ডে মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের 'মানব জানোয়ার' বলে নির্মূল করছে সেটি প্রকাশ্যে বলছে। এ সত্ত্বেও লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে হ্যাবারমাসরা বিবৃতিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগকে নাকচ করে দেন৷ তারা বলেন:
How this retaliation, which is justified in principle, is carried out is the subject of controversial debate; principles of proportionality, the prevention of civilian casualties and the waging of a war with the prospect of future peace must be the guiding principles. Despite all the concern for the fate of the Palestinian population, however, the standards of judgement slip completely when genocidal intentions are attributed to Israel’s actions.
কত বড় অমানবিক হলে মাত্র দুই মাসে ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারানোর পরেও 'which is justified in principle' লিখতে পারে একজন শিক্ষাবিদ?
৬।
তাদের পরের বিবৃতিটুকু জার্মানিতে নাৎসিদের কথা বলে কথিত এন্টি-সেমেটিজমের উদ্ভব যেন না হয় সেই আহবান! আদতে, ইউরোপের আশকেনাজি দখলদার ইহুদিদের চেয়েও যে ফিলিস্তিনের মানুষ সেমেটিক রক্তধারার অধিক নিকটবর্তী উত্তরাধিকারী সেই আলাপ এক সময় হিটলারের তরুণ সংঘে যোগদান করা হ্যাবারমাস করেননি।
লোকে প্রতিবাদ জানানো শুরু করলে তারা অবশ্য বলছেন যে, আমরা মুসলিমবিদ্বেষী নই। আমরা 'আনুপাতিক' জবাবের কথা বলেছি ইত্যাদি। ফর্স্ট সমালোচনার হাত থেকে বাঁচতে ব্যাখ্যা হাজির করলেও ইসরায়েলের গণহত্যার ব্যাপারে মুখে কুলুপ আঁটতে ভুল করেনি এভাবে:
We are even in agreement with a number of critics that the strict criteria for a genocide have not been met
আপনি ফিলিস্তিনিদের অপছন্দ করলেও এটা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ইসরায়েল এখন নাৎসি জার্মানির ভূমিকা পালন করছে, গাজা হচ্ছে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, এ যুগের হিটলার নেতানিয়াহু এবং ফিলিস্তিনিরা হচ্ছে 'নিপীড়িত ইহুদি জাতি'। অর্থাৎ মূলত ফিলিস্তিনের বিরোধিতা করা, ফিলিস্তিনের গণহত্যাকে হামাস নিধনের নামে সমর্থন করাই হচ্ছে এ যুগের নাৎসিবাদ তথা এন্টি-সেমেটিজম।
জার্মান জাতির চিন্তাবিদদের এহেন অধঃপতন ইতিহাসে আর কখনো হয়নি যে তারা এই বিষয়ে নিরপেক্ষ ভাবতে পারলো না!
৭।
আমার একটি মৌলিক গবেষণা আছে যেটি ২০১৮ সালে সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষা জার্নালে প্রথম হিসেবে প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিলো 'গণমিথস্ক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম: বাংলাদেশের ভার্চুয়াল পরিমণ্ডলের ওপর একটি পর্যালোচনা'। এ গবেষণায় আমি তাত্ত্বিক কাঠামো হিসেবে আরো কয়েকটি তত্ত্বের সঙ্গে হ্যাবারমাসের 'জনপরিসর তত্ত্ব'ও ব্যবহার করি।
সাম্প্রতিক সময়ে হ্যাবারমাসের এই নৈতিক অধঃপতন যদিও তার আগের চিন্তাকে বাতিল করে না, কিন্তু আমার ভেবে খারাপই লাগে এরকম একজন ভেজাল চিন্তককে একদিন আমি গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করেছিলাম। পাশাপাশি, হ্যাবারমাসের জন্যও কষ্ট লাগে যে, ইতিহাসে হিটলারের পাশে থাকা যুদ্ধাপরাধী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বুদ্ধিবৃত্তিক যন্ত্র (Ideological Apparatus) হিসেবে তার নামও আসবে!
এতো বড় চিন্তাবিদের কী দৈন্যদশা যে, জায়নবাদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশের সম্পর্ক তিনি স্থাপন করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একটিবারের জন্যও বলতে পারলেন না #CeaseFireNow অথচ—চমস্কির মতে—গাজায় নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির কথা উচ্চারণ করাটি চিন্তাযোদ্ধার মৌলিক দায়িত্ব, সত্যি বলতে গুরুদায়িত্ব—যে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে চিন্তার জনপরিসর থেকে 'গুরু'ত্ব হারালেন অথবা হারিয়েই গেলেন হ্যাবারমাস গং!
[ছবি: হ্যাবারমাসের নিজের ছবি ও টুইটারে হিটলার বাহিনীতে যোগদানের প্রামাণ্য। ভদ্রলোক অনলাইনে যে জনপরিসর ধারণা কাজ করছে এইটা বুঝলেও টুইটার ব্যবহারে দক্ষ নন।]
#FreePalestine
#ceasefireInGazaNOW
#savepalestine
#SaveGaza
#ZionismIsTerrorism
#zionismiswhitesupremacy
#ZionistTerrorist
#PalestineHolocaust
0 Comments