আমাদের মিথ্যুক ব্রাহ্মণ্যবাদী অখণ্ড ভারতপন্থী ইতিহাস লেখক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক প্রমুখ দেশবিভাগ তথা বাংলা বিভাজন নিয়ে নির্মোহ তথ্য জানায়না, অথবা নিজেরাও জানেনা৷
১৯৪৬ এ কলকাতায় ভ-য়াবহ গণ-হ-ত্যা চালায় কলকাতাকেন্দ্রীক ব্রাহ্মণ্যবাদী লোভী শ্রেণি এবং তাদের সহযোগিরা।
ইতিহাসে 'গ্রেট ক্যালকাটা কি-লিং' নামে পরিচিত এই ব্রাহ্মণ্যবাদী গণহ-ত্যা মোট নিহতের ৯০% ছিলো নিরস্ত্র মুসলমান!
জয়া চট্টোপাধ্যায়ের 'বাংলা ভাগ হল', তপন রায়চৌধুরীর 'বাঙ্গালনামা', মুজিবের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ইত্যাদি পড়ুন।
১৯৪৬ এর আগে যতগুলো সাম্প্রদায়িক সং-ঘাত হয় তাতে হতাহতের মোট হিসাবে মুসলমানদের প্রাণ ক্ষয়ের ধারেকাছেও বর্ণহিন্দু ধাপ্পাবা-জদের সংখ্যা নাই৷
কিন্তু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাটপা-ড় ইতিহাস লেখক, সাংবাতিক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অধ্যাপকদের নির্লজ্জ আলাপনে মনে হবে হিন্দু ও মুসলমান মনে হয় ৫০-৫০ হতাহত!
অথচ কলকাতা ও বিহারে বর্ণ তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা যে পরিমাণ মুসলমান মেরে ফেলে তার ১০% হতাহতও নোয়াখালিতে হয়নি৷
কিন্তু নোয়াখালী 'দাঙ্গা'কে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে— গান্ধীর ছাগলসমেত আসা ইত্যাদি দেখিয়ে— বড় করে উপস্থাপন করে।
কারণ, নোয়াখালীকে বড় না করা হলে কলকাতা ও বিহারে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের খু-নীসত্তার মুখোশ খুলে যায়।
নোয়াখালী হলো শাক—কলকাতা ও বিহার এবং পরবর্তীকালে গুজরাট, আজকের দিল্লি হলো র-ক্তখেকো মাছ।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা কলকাতা, দিল্লি ও দিল্লিসেবী ঢাকার ইতিহাস বাণিজ্যে সাধারণ ঘটনা!
২।
অন্যদিকে, মৌলবাদী আরএসএস, বিজেপি, বজরঙ্গী বাহিনী ও বাংলাদেশে তাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী মুসলিম উইং ১৯৪৭ এর আগের লড়াইটাকে ঢালাওভাবে 'মুসলমান বনাম হিন্দু' হিসেবে চিত্রিত করে।
এই হিন্দুত্ববাদের গোলামেরা আমাদের শেখাতে চায় যে, পূর্ববঙ্গের মানুষের পাকিস্তান গঠন করা তো মুসলমানদের, বিশেষ করে মুসলিম লীগের, একক চাওয়া৷
এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, মুসলমানরা ১৭৫৭ এর পর থেকে সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি হিসেবে কষ্ট ও বঞ্চনা সহ্য করেছে ইংরেজ ও মেকলের ইংরেজি শিক্ষিত ব্রিটিশ দালাল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে।
তাই ভারতের শোষণের যাঁতাকল থেকে মুক্তির জন্য 'কান কো বিড়ি/মুখ মে পান/লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' স্লোগান দেয় বাঙ্গালী মুসলমান।
এ সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্দোলনে আরেকটি জাতির সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাস থেকে গুম করে দেওয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে, পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত করা কেবল মুসলমানদের একার লড়াই ছিলোনা।
এ লড়াই ছিলো অব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু তথা শিডিউল কাস্টেরও মুক্তির লড়াই৷
হাজার বছর ধরে নমশুদ্র মতুয়া ও অন্যান্য অব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে নিপীড়িত ছিল।
কেবল নামে অব্রাহ্মণ্যবাদী নমশুদ্র ও মুসলমানদের তফাৎ ছিল।
তাদের কাজ ও পেশা—কৃষি, মাছ ধরা, মাঝি, কামার, কুমোর, নাপিত, মিস্ত্রি ইত্যাদি— ছিলো একই।
এবং সর্বোপরি তাদের সাপেক্ষে জালেমও ছিলো এক ও অভিন্ন—দখলদার ব্রিটিশ ও ব্রিটিশদের চাকর ব্রাহ্মণ্যবাদী দালালেরা।
এ কারণে, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যখন মতুয়া ধর্মের হরিচাঁনকে পাঠশালায় পড়তে দেয়নি হরি মুসলমানদের সাথে মক্তবে ঠিকই পড়তে জায়গা পেয়েছেন।
১৯৪৬ এবং এর আগের যত সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত এই উপমহাদেশে হয়েছে তার কোনোটিই নমশুদ্রের সাথে মুসলমানদের হয়নি৷
প্রত্যেকটি সংঘাত হয়েছে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ স্বার্থপর হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী বা-টপাড়দের সাথে।
এমনকি পূর্ববঙ্গ ভারত থেকে পৃথক হওয়ার ক্ষেত্রে আশু ভূমিকা পালন করা সর্বশেষ কলকাতা মুসলিম গণহ-ত্যাও এককভাবে রঠা গাওয়া শিক্ষিত রেনেসাঁসগিরি করা বাঙালি ব্রাহ্মণ্যবাদী হি-ন্দুর কুকর্ম।
চেপে রাখা ইতিহাস এটা যে, কলকাতা বা ভারতবর্ষের অন্য কোনো স্থানে হওয়া দাঙ্গার সূত্রপাত মুসলমান বনাম নমশুদ্র দ্বন্দ্বে হয়নি৷
যোগেন মণ্ডলের পদত্যাগের চিঠিটি পড়লে জানতে পারবেন যে, কলকাতায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হা-রামজাদাদের কর্তৃক মুসলিম নি/ধনের সময়ে নমশুদ্রের নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই মুসলমানদের হতাহতের সংখ্যা ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে থেমেছিল।
এই নমশুদ্র ভাই-বোনও খেটে খাওয়া মুসলমানদের মত ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ দালাল হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা আক্রান্ত ছিল।
আর তাই কলকাতাকেন্দ্রীক পরান্নভোজী বাটপা-ড় শ্রেণির কবল থেকে মুক্তির জন্য বাঙ্গালী অব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ও মুসলিম এক হয়ে পূর্ববঙ্গকে দিল্লির মাতুব্বরি থেকে বের করে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে।
৩।
মনে রাখবেন, দেওবন্দি কওমী, আলিয়া মাদ্রাসার অনেকে এবং জামাতে ইসলামীসহ ঐ সময়ের ডানপন্থী সংগঠনের অধিকাংশ চেয়েছিল অখণ্ড ভারত।
পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল অধিকাংশ নমশুদ্র হিন্দু ও অধিকাংশ খেটে খাওয়া মুসলমান।
এটা অস্বীকার করা যাবেনা যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ব-দমাশ শ্রেণি পাকিস্তান গঠনের পর সাম্যের স্পিরিট ধারণ করতে পারেনি৷
সেই কাফফারা তাদের দিতে হয়েছে বাঙ্গালী মুসলমানদের হাতে ১৯৭১ এ গলাধাক্কা খেয়ে।
কিন্তু ১৯৪৭ এর ইতিহাস আলাপের সময় 'পাকিস্তান কেবল মুসলমানদের চাওয়া' নামে যে অপবয়ান আমাদের ঢাকা, ইসলামাবাদ ও কলকাতাকেন্দ্রীক দিল্লিসেবীরা দেয় সেটি অনেকাংশেই মিথ্যা।
এই মিথ্যার প্রতিবয়ান: আলাপ-উন্মোচন-বিনির্মাণ করা জরুরি বলেই আজ এ আলাপটি করলাম।
আরেকটি তথ্য আপনাদের জানা জরুরি।
১৯৩৭ এর নির্বাচনে বাঙ্গালী মুসলমানদের আত্মার বন্ধু ও মাঠের কমরেড নমশুদ্র বা মতুয়া বা শিডিউল কাস্ট ৩২ টি আসনের মধ্যে ২৩ টিতেই জিতে যায়৷
বাকি ৯ টির ৭ টি কংগ্রেসের বর্ণহিন্দু আর ২ টি পায় উগ্রবাদী হিন্দু মহাসভা!
এই নির্বাচনই বর্ণহিন্দু টাউট বাবুদের এই বার্তা দেয় যে, আর এই বাংলায় মুসলমান ও নমশুদ্রের রক্ত চুষে খাওয়া যাবেনা৷
দ্রুত লুটপাট করে দিল্লির পদলেহনেই 'ওঁম শান্তি'!
মনে রাখবেন, এই সময়েই বাঙ্গালী মুসলমানের বাচ্চা বাংলার বাঘ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে 'নমস্কার ও আসসালামু আলাইকুম' বলে বাঙ্গালী খেটে খাওয়া মুসলিম ও অব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের সমর্থনে 'কৃষক-প্রজা পার্টি' করে একই সাথে মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা সবকটিকে হারিয়ে দেয়৷
একদিকে মজলুম নমশুদ্রের উত্থান, অন্যদিকে মজলুম খেটে খাওয়া মুসলমানদের নেতার উদ্ভব—এরই প্রেক্ষাপটে ফজলুল হক ১৯৪০ ঈশায়ী সনে লাহোর প্রস্তাব দেন।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলসহ নমশুদ্ররা এই লাহোর প্রস্তাবে অব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের মর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেখেই পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হন৷
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন৷
এর ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে পাকিস্তান তৈরি হয় সেই পাকিস্তান গণপরিষদে যোগেন মন্ডল সভাপতিও হন৷
পরবর্তীকালে পাকিস্তানী নেতৃত্বের ব্যর্থতা, সাময়িক বিসৃঙ্খলা এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হুমকি ও চাপে যোগেন মন্ডল বদলে গেলেও পাকিস্তান তৈরিতে বাঙ্গালী মুসলমান ও অব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু যে সম্মিলিতভাবে কাজ করেছে এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করা যাবেনা৷
পঞ্চাশের দশকে যোগেন মন্ডল যে অজুহাতে চলে গিয়েছিলেন সেটি অতিরঞ্জিত ঘটনা!
উনি আসলে বর্ণহিন্দুদের চাপে এই কাজ করেছিলেন।
পদত্যাগপত্র পড়লে যে কেউ বুঝবেন ওটা কেয়ারফুলি প্রিপেয়ার্ড একটা ডকুমেন্ট।
১৯৪৮ এর পর থেকে বাঙ্গালী মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের সাথে উর্দু ও বিহারী ভাষীদের ঝামেলা হচ্ছিল।
সেই সময়ে যোগেনের ভারতে চলে যাওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ববাদীদের ফাঁদে পা দেওয়া এবং সেই ফাঁদ থেকে আজো মতুয়ারা বের হতে পারেননি।
যে অপবয়ান আমাদের ৫৪ বছর বা তারও অধিককাল ধরে গেলানো হচ্ছে তাকে মোকাবিলার বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটা আমাদের এ কারণে চলমান রাখতে হবে...!
কারণ, সত্যই আসলে মুক্তি দেয়৷
আর, ভারত থেকে পৃথক হয়ে 'পূর্ববাঙ্গালার' বের হয়ে আসায় নমশুদ্র বা অব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের ইতিবাচক অবদানের স্বীকৃতি না দিতে পারলে বাংলাদেশ ও ভারতের সামাজিক অস্থিরতা হ্রাস করা যাবেনা।
ব্রাহ্মণ্যবাদী মৌলবাদী হিন্দু এবং অব্রাহ্মণ্যবাদী ও নমশুদ্রের মধ্যে সুস্পষ্ট শ্রেণি বৈষম্য ও লড়াইয়ের ইতিহাসের ভিন্নতা থাকার পরেও তাদেরকে এক দৃষ্টিতে দেখার সমস্যা চিহ্নিত করতে পারার মধ্যেই বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের সমাধান নিহিত।
অন্ধ বিশ্বাস না করে প্রচলিত একপাক্ষিক হিন্দুস্তান বা পাকিস্তানপন্থী ইতিহাসকে প্রশ্ম করতে হবে।
প্রশ্নই উত্তর—বারবার এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে যাই...!
0 Comments