সর্বশেষ

আরজ আলী মাতুব্বর হতে ইচ্ছে করে

আরজ আলী মাতুব্বর ।
ছাগলমার্কা ফতোয়াবাজদের কবলে পড়েছিলেন তিনি ।
আরজ আলীর মা মারা গেলে তিনি মায়ের স্মৃতিস্বরূপ মায়ের মৃতদেহের একটি ছবি তুলেছিলেন । এই ছিল তাঁর অপরাধ ।
মূর্খের দল ভাওতা জারী করলো এবং তাঁর মায়ের মৃতদেহের জানাজা না পড়িয়ে তারা কেটে পড়ল ।
আরজ আলী হতবম্ভের সঙ্গে সঙ্গে সংকীর্ণদের নিকট থেকে বিরাট দুঃখবোধ অর্জন করলেন ।
তিনি নিজে কবর খুঁড়ে তাঁর মা'কে কবর দিলেন জানাজা ছাড়াই ।
পরবর্তী জীবনে এই আরজ আলী বিস্তর পড়াশোনা করে ভাওতাবাজদের তুলোধুনা করেন । মোল্লাতন্ত্র আর ধর্মের অপব্যবহারকারীদের আক্রমণাত্মক সমালোচনা শুরু করেন আরজ আলী মাতুব্বর ।
একই সঙ্গে কতগুলো মূর্খের গোঁড়ামীর ফলে আরজ আলী শান্তির ধর্মকেও কটাক্ষ করলেন । এটা ঘটেছিল কারণ সমাজে মূর্খরা আইনপ্রণয়ন করে ভুগিয়েছিল একটি সাধারণ কচি মনকে ।


১৮ জানুয়ারি শুক্রবার ।
দীর্ঘদিন ব্রেণ টিউমারে ভুগে জালাল শেখ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ।
তার এক ছেলের নাম রসুল আমীন । তাকে ঢাকার মহাখালী এক মাদরাসায় আরবী পড়া শেখাতে পাঠিয়েছিলেন জালাল শেখ ।
রসুল আমীন এখন হাফেজ ।
জালাল শেখ বেঁচে থাকতে বলতেন, " দুনিয়া দিয়ে কী হবে, মরতে সবার হবেই । তাই ছেলেটাকে দ্বীনের পথে দিয়ে দিলাম । আমার জানাজা আমার ছেলেটাই পড়াবে ।"
জালাল শেখ মারা গেলে সেই রসুল আমীনকে খবর দেওয়ার জন্য মাদরাসার মাওলানা হুজুরকে ফোন দেওয়া হল । তিনি রসুল আমীনকে তাও ছুটি দিতে চাইলেন না । এরকম মৃত্যুর কথা নাকী উনাকে প্রমাণ দেখিয়ে বোঝাতে হবে ।
কয়েকটা উচ্চমানের গালি দেওয়ার পর ভাওতাবাজটা ছুটি মঞ্জুর করলো । অবশ্য তার আগেই মাদরাসা থেকে বেরিয়ে গেছে রসুল আমীন ।
রসুল আমীন আসছে । সব ঠিকঠাক থাকলে সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যেই ও টুংগীপাড়া এসে পৌঁছবে ।
এদিকে আরেক জাতীয় মূর্খ ফতোয়ার পর পর ফতোয়া, মসলার পর মসলা (মাসআলার বিকৃত রূপ) দিয়ে যাচ্ছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাশ দাফন করে ফেলতে হবে । ও ছেলেতো বাবাকে অনেক দেখেছে । এখন না দেখলে কীচ্ছু হবেনা ।
রসুল আমীনকে না দেখিয়ে কবর দিয়ে দিলে নাকী সুয়াবে একেবারে জান্নাত দাখিল হয়ে যাবে জালাল শেখের ।
আমাদের চরম বিরোধে ধোপে টিকলোনা ভাওতাবাজ জোব্বা পরা দুকলম মুখস্ত আরবী পড়া গোঁড়া সমাজের ভ্রষ্ট ফতোয়া ।
একবার জানাজা পড়িয়ে লাশ রেখে দেওয়া হলো ছেলের অপেক্ষায় ।


সাড়ে ৬ টার দিকে রসুল আমীন এলো । বাবার লাশের কাছে গিয়ে কাঁদতেছিল ছেলেটা । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়েও কাঁদছিল ওঁ । ওমনি ফতোয়াবাজ পরভোজীগুলো কোথা থেকে হাজির !
উচ্চ্বস্বরে কাঁদতে এমনি কী একের পর এক বিকৃত হাদীস এনে ছেলেটার কান্নাকেই স্তব্ন করে দিল ।
এ কী নিয়ম ! বাবার মৃত্যুতে ১৪ বছরের একটা ছেলের চোখ দিয়ে পানি ঝরলে নাকী তার বাবার আত্মা কষ্ট পায় !
ফতোয়াবাজরা মানুষ হোক ।

কিছুক্ষণ পর ছেলেটা তার বাবার জানাজা আরেকবার পড়াতে চাইলো যেখানে সে নিজেই নেতৃত্ব দিবে । আবারো সব মূর্খ একত্রে ছেলেটাকে ফতোয়া শোনাতে লাগলো ।
ছেলেটা থেমে গেল । ভাওতাবাজরা তাদের পীরের নির্দেশ দিলো । জানাজা দ্বিতীয়বার পড়ানো অপ্রয়োজনীয় !

ছেলেটি তার বাবার জানাজা পড়াতে পারলোনা ।
ফতোয়াবাজরা জানলোনা , কেন জালাল শেখ তার সন্তান রসুল আমীনকে কষ্টে উপার্জিত টাকা দিয়ে মাদরাসায় ভর্তি করেছিলেন ।

পরদিন সকালে ।
জালাল শেখের কবরের পাশে বসে শীতের মিষ্টি রোদে বসেছিলাম আমরা । বেঁচে থাকতে তার সঙ্গে কার কী স্মৃতি তাই নিয়ে একটা ছোট্র আড্ডা । এমন সময় সেখানে রসুল আমীন এলো ।
সে আমাকে তাঁকে যারা জানাজা পড়াতে দেয়নি তাদের প্রতি ক্ষোভের কথা জানালো ।

আমি ওকে আরজ আলী মাতুব্বরের কাহিনী শুনালাম । রসুল আমীন খুবই আগ্রহ নিয়ে শুনলো !

তারপর ৩০ পারা কোরান মুখস্ত যে ছেলেটার সেই রসুল আমীন শুষ্ক ফাঁটা ঠোঁটেও মুচকি হাসলো । ওর চোখে আগুন ! ভ্রুটা কোঁচকানো , হাতের মুঠিতে শক্ত একটা মাটির টুকরা ।
আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ! আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত ! ওর চোখ আর ঠোঁটের বাঁকানো হাসি যেন স্পষ্টভাবে বলছে :

আরজ আলী মাতুব্বর হতে ইচ্ছে করে
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments