সর্বশেষ

জাতীয়তাবোধহীন ইতিহাসবিদ, মিডিয়া ও দেশপ্রেমহীন অপপ্রজন্মের হীনমন্যতা ও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব


আমাদের ইতিহাসবিদগণ বাঙালির ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ অতীতকে তুলে ধরতে সার্থকতার পরিচয় দিতে পেরেছেন কি? বাঙালি জাতির রয়েছে গর্ব করার মত অতীত। সে অতীত গণমাধ্যম ও পাঠ্যপুস্তকে বিপুল প্রভাব তৈরির উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত বা প্রচারিত হয় কি? কেন 'আমি বাংলাদেশী' বা 'আমি বাঙালি' এ পরিচয়ে গর্বিত হতে সচরাচর দেখা যায়না? কেন 'বাংলাদেশী পণ্য বা সংস্কৃতি মানেই পশ্চিমা পণ্য বা সংস্কৃতি থেকে মান খারাপ' এই গণঅপধারণা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায়ও নিজের দেশের সংস্কৃতি চর্চা কিংবা পণ্যের ব্যবহার অপর্যাপ্ত পরিমাণ? আমাদের কি কোন কিছুর ঘাটতি আছে? একদম না। মাছ, ভাত, পোশাক, জমি, জনতা, প্রকৃতি, মেধা, সমুদ্র কি নেই আমাদের? নেই একটা জিনিস। নেই দেশ ও জাতিকে ভালবাসার 'মানসিকতা'। নেই জাতীয়তাবোধ, নেই দেশাত্মবোধ। আমাদের জগদীশ চন্দ্র, সত্যেন বোস, অতীশ দীপঙ্কার, জামাল নজরুল, সালমান, বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর কাছে দৃষ্টান্ত। অথচ আমরা হীনমন্যতাকে আমাদের অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য করেছি। এটা তো এই মাটির শিক্ষা নয়।
এইখানে, এই বাংলার মাটি যতোটা উর্বর স্রষ্টা করেছেন তা তো আরো কোথাও নেই। সেটি ফা হিয়েন, হিউয়ান বা ইবনে বতুতার ঐতিহাসিক দলিলে স্বীকৃত। এই মাটির সন্তানের ভয়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ এ আলেকজাণ্ডার ভয়ে সেনা গুটিয়ে মেসিডোনিয়ায় ফিরে গেছে। এই মাটির সন্তানেরাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়িয়েছে। এই মাটি থেকে নরপিচাশ পাকিস্তানীদের পিটিয়ে বের করেছে বাঙাল। এই মাটিই একসময পরাক্রমশালী মোগল সাম্রাজ্যকে প্রাচ্য থেকে একমাত্র চ্যালেঞ্জটি করেছে। এই মাটি কাপুরুষের মাটি নয়। এই মাটিতে হাডুডুর মত শক্তি, ক্ষীপ্রতা ও বুদ্ধিমত্তার খেলা জনপ্রিয় ছিল। সেই মাটির সন্তানদের 'ভেঁতো বাঙালি' বলা ইতিহাস লেখকদের মানসিক দীনতার উত্‍স অনুসন্ধান করতে হবে। এই জাতীয়তাবোধহীন ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

পশ্চিমপূজারী এই ছোট মানসিকতায় গ্রীসের ছোট ছোট নগরকে গৌরবের সাথে 'নগররাষ্ট্র' বলে জ্ঞান জাহির করা হয় অথচ আমাদের বৃহত্‍ একেকটি প্রাচীন রাষ্ট্র বঙ্গ, পুন্ড্র, সমতট বা হরিকেলকে রাষ্ট্র না বলে 'জনপদ' বলা হয়। এই বুদ্ধিবৃত্তিক হীনমন্য প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে।

দুনিয়ার আর কোথায় রয়েছে হাছন, লালন, করিমের মত নামের উপর সংগীতের ধারা? বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির কাছাকাছি কে আছে আর? নিজেকে নিয়ে অহংকার না করার অজুহাত দাঁড় করানো পশ্চিমকে সুপিরিওর ভাবাদের কে বোঝাবে এ কথা? যখন আমাদের সোমপুর বিহারে বিশ্বমানের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তখন ইউরোপ ও আমেরিকা মূর্খযুগে বাস করে, অথচ আজ ওরা আমাদের জ্ঞানের ছবক দেয়।
যখন আমাদের ঈশা খাঁ পানাম নগরে সর্বাধুনিক শহর বানিয়েছেন তখন ইউরোপ ও আমেরিকা গুহাযুগে বাস করছে। যখন আমাদের পূর্বপুরুষ মসলিন বানিয়েছে তখন ইউরোপ ও আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা পোশাকের অভাবে নগ্ন চলাফেরা করেছে। যখন আমরা দুর্গের পর দুর্গ বানিয়েছি আমেরিকা তখন আবিষ্কারই হয়নি। যখন আমরা টাকায় ৮ মন চাল বিক্রি করেছি ইউরোপ ও আমেরিকা তখন না খেয়ে মরছে খাদ্যের অভাবে। আমরাই একমাত্র জাতি যারা কোন কালে কোন ভীণদেশী শক্তির বশ্যতা স্বীকার করি নাই। এই সব ইতিহাসকে পাঠ্যপুস্তকে সঠিকভাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন ইতিহাসবিদ বা লেখকেরা। এ কারণে পাঠ্যপুস্তক পড়ে তীব্র দেশপ্রেম জাগেনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এ কারণে দেশের পণ্য ও সংস্কৃতির প্রতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নেতিবাচক ধারনা জন্ম নিচ্ছে। এটা হতে দেয়া যাবেনা। সর্বক্ষেত্রে বাংলা, বাংলাদেশী ও বাংলাদেশকে প্রাধান্য দিতে হবে। যে জাতি মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে সে জাতির গর্ব করার সহস্র ইতিহাসকে উপস্থাপনে ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়াটা জাতীয় ক্ষতির কারণ। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে গণমাধ্যমকে আরো সক্রিয় হতে হবে। এই যুগে বিশ্বায়নের ভয়াল ছোবল থেকে দেশ, জাতি, সংস্কৃতি ও স্বনির্ভরতাকে সুরক্ষা করতে হলে নিজ নিজ সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের দেশের পণ্য ব্যবহার করাই দেশপ্রেম। এই বাংলাদেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য সম্পদগুলো রয়েছ। আপনাকে তা খোঁজার চোখ ও মানসিকতা লাগবে। এই দেশের মাটি ও মানুষকে ভালবাসলে সেই চোখ খুলে যাবে, ব্যক্তি ও ক্ষুদ্রস্বার্থ পরিত্যাগ করে সামষ্টিক ও জাতীয় স্বার্থে চিন্তাভাবনা করলেই জাতীয়তাবোধসম্পন্ন মানসিকতা তৈরি হবে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিশাল জনসম্পদকে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে বাংলাদেশপন্থী মানসিকতা প্রয়োজন। তবে জাগবে বাংলাদেশ এবং অচিরেই এ পৃথিবীর বুকে ফের পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। মনে রাখবেন, আজ যেমন পশ্চিমে বা আরবে বাংলাদেশিরা জীবীকার জন্য যাচ্ছে , অতীতে ঠিক একইভাবে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে রুটিরোজগারের জন্য এই বাংলাদেশেই আসতো মানুষ। আমাদের মাথায় পূর্বপুরুষদের এই সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকতে হবে। এই ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশ গড়তে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আজ থেকেই শুরু করি চলুন। প্রথমেই বাজারে প্রচলিত যেকোন দুটি বা ততোধিক সমজাতীয় পণ্যের একটি বাংলাদেশী হলে সেটি ক্রয় করতে হবে। পারবেন? বাংলা গান ও সংগীতের প্রসার ঘটাতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ জায়গায় লাল ও সবুজ পতাকার এই দেশকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

আজ বাংলাদেশ যে ভৌগলিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রয়েছে তা পৃথিবীর খুব কম দেশের রয়েছে। চাইলেই কাতারের মত আমাদের উপর কোন দেশ কোনদিন অবরোধ দিতে পারবেনা, কারণ আমাদের নিজেদের রয়েছে আস্ত একটা সমুদ্র। সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের জনসংখ্যার চেয়ে অধিক আমাদের জনসংখ্যা। এই কোটি মাথাকে কাজে লাগাতে হবে, প্রতিটি হাতকে উত্‍পাদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং এই সব কিছু সম্ভব হবে কেবল আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটলে। সকলের আত্মকেন্দ্রীক চিন্তা ও কর্ম পরিহার করে সমগ্র দেশ ও জাতীয় স্বার্থে চিন্তা ও কর্ম শুরু করতে হবে। আজকে আমি আপনি যদি দেশকে উজাড় করে আমাদের সবটুকু শ্রম ও মেধা দিই, তবে কালকে পরবর্তী প্রজন্মকে দুই হাত উজাড় করে দেবে প্রিয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে হৃদয়ে ধারণ করে চলুন গড়ি বিপুল সমৃদ্ধ স্বদেশ।
পাঠ অনুভূতি