আমাদের সমাজে কিছু পশ্চিমখোর নৈরাজ্যবাদীদের উদ্ভব ঘটছে। তারা চটকদার বক্তব্য দেয়, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক শিকড়কে অস্বীকার করে। তাদের যে পাণ্ডিত্য তাতে সব কিছু অল্প বিস্তর থাকে, কিন্তু নৈতিকতা থাকেনা। নৈতিকতার যে প্রভাব সেটি তারা স্বীকার করেননা। ফলে তারা যে সকল বয়ান বা প্রতিবয়ান আমাদের সামনে হাজির করেন তা গণরূপ ধারণ করেনা। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ভিত্তিকে ভাঙতে হলে আপনাকে আগে বিকল্প ভিত্তির পথ বাঁকলে দিতে হবে। কিন্তু সেটি না করে পশ্চিমের অনুসারী হয়ে সমাজ ভাঙতে যাওয়া ধ্বংসাত্মক। এই ভাঙন করার মানসিকতায় যেহেতু নৈতিক শুদ্ধতার কোন বালাই থাকেনা সেহেতু এটি একুট আধটু করে ধীরে ধীরে ‘ফ্রয়েডের য়েীনসর্বস্ব গর্ভে গিয়ে পড়ে’। এরা যে পরিবর্তন করতে চাক তার পতন হয় অবাধ যেীনতার স্বাধীনতায় গিয়ে। অবাধ যেীনতা পশু সমাজে দেখা যায়। মানুষ অতীত থেকে এটি পরিহার করেছে। এখন আপনি যদি এটিকে ভেঙে এর স্বীকৃতি দিতে চান তবে আপনাকে আগে সামাজিক ভিত্তি দেখাতে হবে। আপনাকে আগে এইডস, সিফিলিস, গণোরিয়া মোকাবেলার মানসিকতা রাখতে হবে। তা না করে আপনি পরিবার প্রথাকে ভেঙে যে সমাজ তৈরি করতে চান তাতে তো মানবজাতির বিপর্যয় ঘটতে পারে। কারণ মহামারী আকারে যদি এইডস ছড়ায় সেক্ষেত্রে আমাদের অস্তিত্ব বিলীন হবে। সে কারণে জৈবিক জীবনে পরিচ্ছন্নতা মানুষের জীবনে আবশ্যক। যেহেতু অপরিচ্ছন্ন জৈবিক জীবনে এক ইঞ্চি কল্যাণ কেউ দেখাতে পারবেনা। যেীনবিকারগ্রস্ততা নিশ্চয়ই কোন কল্যাণমূলক কিছু নয়।
২।
যে বস্তুবাদী দর্শন থেকে এদেশের কেউ কেউ নীতিনৈতিকতাকে ফেলে দিতে চান তা এসেছে পশ্চিম থেকে। আমাদের প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক শিকড়কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে এই দর্শন কাজ করবে। ফলে আপনি রক্তে প্রাচ্যের হয়ে যখন মগজে পশ্চিমের প্রতি চাকরবৃত্তি নিয়ে ঘুরবেন তখন আপনার মগজ থেকে শুদ্ধ চিন্তা বের হবেনা। চিন্তার অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এটি যে, চিন্তা যদি নৈতিকতাযুক্ত না হয় তবে সেই চিন্তা আপনার দাসত্বের কারণ হতে পারে, আপনার অশুদ্ধ যাপনের উপলক্ষ হতে পারে। সক্রেটিস বলেছেন, Knowledge is Virtue, এখানে জ্ঞানকে শুধু জ্ঞান বলা হয়নি। ভাল গুণ বলা হয়েছে। Virtue এর সাথে নৈতিকতার সম্পর্ক রয়েছে। আপনি সক্রেটিস সক্রেটিস করে দিন কাটাবেন আর নৈতিকতাকেও ছুঁড়ে ফেলবেন এটা হিপোক্রেসির শুরু। হিপোক্রেসি কখনোই ভাল নয়।
৩।
ইতিহাসে ফিরে যাই। মানবসভ্যতার যতবার পতন ঘটেছে তার সাথে কি নৈতিক স্থলনের সম্পর্ক রয়েছে? এখানে ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্বের আলোকে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সময় সাপেক্ষ। তবে জানা ইতিহাসে নৈতিকতার সাথে মানবসভ্যতার পতনের সম্পর্ক পাওয়া যায়না। কিন্তু বিভিন্ন জাতির পতনের পিছনে এর কারণ আছে। যেমন, বর্তমান সময়ে আরবের যে পতন ঘটেছে শ্বেতাঙ্গ পশ্চিমের কাছে সেটার অন্যতম কারণ আরব্য নৈতিকতার মানদণ্ড ভুলে তারা গ্রহণ করেছিল পশ্চিমেরটা। ফলে পশ্চিম আগ্রাসন চালিয়েও আরবের একটা অংশের কাছে প্রভু। কিন্তু রাশিয়ান সাংস্কৃতির শিকড়ের সংযুক্ত নৈতিকতায় কিন্তু পশ্চিমা নৈতিকতা ঢুকতে পারেনি। ফলে রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের কলাপ্সের পরেও ফের উঠে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি অনেক গভীরে। সহজ নয়। আর সভ্যতার যে পতন তাতে যে নৈতিকতা স্থলনের সম্পর্ক পাওয়া যায়না তা নয়, ব্যবিলনীয় সভ্যতা যখন পারস্য সভ্যতার কাছে পরাজিত হয় তখন ব্যবিলনের মানুষের নৈতিকতা মানবিক ছিলনা। মায়া সভ্যতার ভেতরে নৈতিকতা ধসে গিয়েছিল তীব্র ভোগবাদীতার ছোঁয়ায় , এপোক্যালিপ্টো মুভিতে সেটি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। থিওলজিতে দেখা যায়, লুত এর জাতি আদ ও সামূদকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তাদের সমকামীতার কারণে। এসব বিষয় নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝায়। সর্বশেষ যে গ্রানাডার পতন হলো, বা নদীয়ায় এসে লক্ষণ সেন তুর্কিদের হাতে হারলো এর পিছনে নৈতিক অধঃপতন কাজ করেছি। আপনার চারিত্রিক শুদ্ধতা থাকলে আপনাকে কেউ পরাজিত করবেনা। দুঃসাহসী গঙ্গাহৃদয় বা পিক্ট জাতি বা কুর্দিদের সংগ্রামের মূল কারণ নৈতিকতা। ১৯৭১ সালে যে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে তার কারণ সৈ নৈতিকতার শক্তিতে বলীয়ান ছিল। আর এত শক্তিশালী বাহিনী হয়েও নৈতিকতায় দুরবল হয়ে পরাজিত হয় হানাদাররা। এ কারণে নৈতিকতার ভীষণ শক্তি। সেটি অনুধাবন না করারা মূলত নৈতিকতা থেকে দূরে সরে অন্য সকলের লেজ কাটতে কাজ করে যাচ্ছে।
৪।
সুতরাং নৈতিক নিয়ন্ত্রণ (Moral Sanction) দরকার সমাজ, সভ্যতা ও মানুষের জন্য। নির্বিচার ভোগবাদ, নির্বিচার পুঁজিবাদ, নির্বিচার যেীনতা কখনোই মানব সভ্যতার কল্যাণে কোন ভূমিকা রাখেনি। নৈতিক নিয়ন্ত্রণ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি হচ্ছে বহিঃনিয়ন্ত্রণ (External Sanction), যেটির উপর নিয়ন্ত্রণ বহু আগে থেকে ভঙ্গুর হয়েছে। এর কারণ ১৯৪৫ সালের পর যে বিশ্বায়ন নামের সুশীল সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটেছিল তা প্রতিটি সমাজ ও জাতির নিজস্ব নৈতিকতার নিয়ন্ত্রণরেখাকে দুর্বল করে দেয়। এতে মীরজাফর হিসেবে কাজ করে পশ্চিমা জ্ঞানে কথিত আলোকিতরা যাদের পশ্চিমা মডার্নাইজেশন প্রবক্তরা আদর করে ডাকে change agents , বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় পরিবর্তন দালাল। অর্থাৎ এই দালালরা আমাদের গ্রামে-নগরে এসে বলেছে আমাদের জীবনব্যবস্থা ভাল না, পশ্চিম ভাল, পশ্চিমের যন্ত্র ভাল, সিনজেন্টা ভাল, মনসানতো ভাল, ওদের তা সব নয়, লিভ টুগেদার ভাল, বেশি বয়সে বিয়ে ভাল। ইত্যাদি । এরা সমাজের নৈতিকতার বহিঃনিয়ন্ত্রণ শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলেছে। ফলে এখন কেউ ঘুষ খেলে তাকে অসম্মান করা হয়না, কেউ বহুগামী হলে তাকে ঘৃণা করা হয়না, কেউ মা-বাবার পরিচর্যা না করলে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়না ইত্যাদি।
৫।
দ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক নিয়ন্ত্রণের নাম অন্তঃনিয়ন্ত্রণ (Internal Sanction)। এথন অনৈতিক লেজকাটাদের টার্গেট এটিকে ভেঙে ফেলা। এটি যদি তারা করতে পারে তবে তাদের লেজকাটা দেখে আর হাসিতামাশা করার লোক থাকবেনা। সে কারণে এই নীতিহীনরা আমাদে্র বলতে চায়, কেউ চাইলেই যাচ্ছেতই করতে পারে । মোটাদাগে এরা আত্মকেন্দ্রীক, ভোগবাদী। ফ্রয়েডের অসুস্থ চিন্তা ধারা এদেরে ভেতরকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে কি হয়, এরা অসততা, অনৈতিকতাকে আর পাপ মনে করেনা। পাপ ও পাপবোধকে এরা প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে। এর মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনার নৈতিকতা সুরক্ষার দেয়াল ভেঙে ফেলা। সে কারণেই ওরা বলতে চায়, লিভ টুগেদার ইজ ওকে, মিথ্যাচার ইজ ওকে, বহুগামীতা ইজ ওকে, প্রস্টিটিউশন ইজ ওকে, সব ধরনের যেীনবিকৃতি ওদের কাছে ওকে। এখন নৈতিকতার ব্যাপারে আমার অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, যে অনৈতিক হতে মনস্থির করে সে জৈবিক জীবন দিয়েই তা শুরু করে। এবং এই টা চেইন রিএকশনের মত অন্যান্য কাজ ও চিন্তাকে প্রভাবিত করে। ফলে তাদের চিন্তার গরল ধরা পড়ে যায়। এই ধরা পড়ে যে নৈতিক নিয়ন্ত্রণ রেখায় সেটি প্রত্যেকের হৃদয়ের রেখা। এটি আসে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, সংস্কৃতি থেকে, ধর্ম থেকে। যেহেতু পশ্চিমখোর অনৈতিকতাবাদী নৈরাজ্যপন্থী এই সাইকোপ্যাথগুলোর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জীবনকে পশুর উপভোগ করা যাতে কোন ত্যাগ নেই সেহেতু তারা পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মকে আগে নাকচ করে। কার্যত এই নাকচের মূলে থাকে নৈতিকতাকে দূরে রাখে। কারণ তাদের অমানবিক পাশবিক জীবনযাপনকে সমাজের চোখে পাপকাজ, নীতিহীন কাজ, ঘৃণ্যকর্মে পরিণত করে নৈতিকতা। তাই তাদের কলুষিত হৃদয়ের যুদ্ধ মূলত নৈতিকতার সাথে। আর নৈতিকতার দুর্ভেদ্য স্তর অন্তঃনিয়ন্ত্রণের দেয়াল ভাঙতে পারলেই তারা যে জানোয়ারের জীবনযাপন করে তা মানুষের উপর আরোপ করা যাবে। সে কারণে নৈতিকতাকে পরাজিত হতে দেয়া যাবেনা।
নৈতিকতাই মানবিকতা। নৈতিক মানুষই মানুষ। আর সব পশু, জানোয়ার। নৈতিকতাহীন লোক মানুষের আকৃতির হলেও কার্যত সে জানোয়ার। জানোয়ার চায় তাবৎ দুনিয়ায় জানোয়ারের বিজয়। মানুষ হিসেবে আপনার চাওয়া উচিত মানবিকতার জয়, যে মানবিকতা জানোয়ারকেও অন্য জানোয়ারের প্রতি সদয় আচরণের শেখাবে।
0 Comments