সর্বশেষ

স্বাধীন কাতালোনিয়া: আসন্ন রক্তাক্ত জাতীয়তাবাদী লড়াই ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের খুনী ইতিহাস


যেকোন দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা মানেই স্বাধীনতা পাওয়া নয়, স্বাধীনতা অর্জনের ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট কার্লেস পুয়িগডেমন্টের নেতৃত্বাধীন কাতালোনিয়ার সরকার কাতালান জাতির জন্য দুটি মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ করে দিয়ে গেলো।


ক. ১ অক্টোবর, ২০১৭ স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট আয়োজন এবং


খ. ২৭ অক্টোবর, ২০১৭ কাতালোনিয়ার রাজ্য পার্লামেন্টে স্বাধীনতা ঘোষণার ভোটে বিজয় অর্জন করানো।


একটি দেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়ার জন্য আর মাত্র একটি ক্রাইটেরিয়া পূরণ করা বাকি আছে। সেটি হচ্ছে: স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে কাতালোনিয়াকে। তবে স্বাধীনচেতা কাতালান তরুণ-তরুনীরা অবশ্য শুক্রবার স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই ‘স্বাধীন কাতালানিয়া’ এর বিভিন্ন স্থান থেকে স্পেনের পতাকা নামিয় ফেলে কাতালানিয়ার পতাকা উড়িয়ে দেয়। এর মানে হচ্ছে স্বাধীনতার ব্যাপারে কাতালান জনগণ বদ্ধ পরিকর এবং ইতিহাস সাক্ষী এমন স্বাধীনচেতা জাতিকে কোন শক্তিই স্বাধীনতা অর্জন থেকে বিরত রাখতে পারবেনা। সুতরাং কাতালানিয়া স্বাধীন কাতালোনিয়াই হবে। আঞ্চলিক সরকার তাদের কাজ করে দিয়েছে। এখন কাতালানদের হয়তো রাস্তায় থাকতে হতে পারে, কিংবা সারা বিশ্বে স্বীকৃতি আদায়ের ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত। এক সময়ের প্রবল পরাক্রমশালী স্পেন এত সহজে সম্পদশালী কাতালোনিয়াকে হাতছাড়া করবে সেটি ভেবে বসে থাকবেনা নিশ্চয়ই কাতালানরা। তাদেরও প্রস্তুতি রয়েছে এমনই বিশ্বাস আমার।


কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণায় ইউরোপ ও আমেরিকার উদ্বেগের আসল কারণ

কাতালানদের স্বাধীনতা ঘোষণাকে পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালভাবে নেয়নি। এর কারণ এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সমষ্টিতে যে পশ্চিমা বলয় গড়ে উঠেছে তা কাতালানদের মত বহু জাতির স্বাধীনতা হরণ করে টিকে আছে। সে কারণে এভাবে যদি কাতালানরা স্বাধীন হয়ে যায় তবে সেই স্বাধীনতা আন্দোলন ইউরোপ ও আমেরিকার অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জাতিকে বিপুলভাবে উৎসাহিত ও আলোড়িত করবে। সে কারণেই বলদর্পী ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অখণ্ড স্পেনের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান ঘোষণা করেছে। অথচ এই রাষ্ট্রগুলোই কিন্তু সারা দুনিয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি ব্যাপারে ছবক দেয়। আজ তারাই গণভোটে ৯০% কাতালান যে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছে তা মানতে পারছেনা। কারণ বিশ্বায়নপন্থী নামের সুশীল সাম্রাজ্যবাদীদের থলের বিড়াল তাতে বেরিয়ে আসে। আজ কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা প্রাপ্তি মানে কাল প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের জাতিগুলো স্বাধীনতার জন্য আরো বেশি উদ্বেলিত হবে। তখন কে তাদের দমিয়ে রাখতে পারে শুনি? ১৯৭১ সালে পেরেছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন, আমেরিকা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বেরিয়ে আসা ঠেকাতে? কাতালানদের পারবেনা। 

এখন প্রশ্ন কেন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো কাতালানদের পাশে দাঁড়াচ্ছেনা? এরাই না পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের ক্ষুদ্র বাহিনীর মানবাধিকার নিয়ে এনজিও ইত্যাদি পাঠিয়ে আমাকে আপনাকে অনেক কিছু খাওয়ায়? আজ এদের দ্বিমুখীতা কেন? একটু বিস্তারিত বলা যাক কেন কাতালানদের স্বাধীনতার প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকার কোন সমর্থন নেই।

ব্রিটেন

ব্রিটেনের ইহুদীবাদী প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কাতালানদের বিচ্ছিন্নতাবাদীতায় (আসলে স্বাধীনতা আন্দোলন) তাদের সমর্থন নেই। ২৭ অক্টোবর থেরেসা মে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রজয় এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। এর কারণ ব্রিটেনের অভ্যন্তরে স্কটিশ জাতি দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার আন্দোলন করছে। আইরিশ রেড আর্মিও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ড কখিত গ্রেট ব্রিটেনের থেকে বেরিয়ে যেতে গ্রেট গণভোটের আয়োজন করে এবং তাতে জটিল মারপ্যাঁচে ১% এর মত ভোটে স্কটল্যাণ্ডের স্বাধীনতা বিলম্বিত হয়। তবে ব্রেক্সিট সম্পন্ন হলে স্কটল্যাণ্ড ফের গণভোট দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে বেরোনোর চেষ্টা করবে বলে জানিয়ে স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা। তো, থেরেসা মে যদি এখন কাতালোনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেন, তবে স্কটল্যাণ্ড তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করবে। সে কারণেই স্প্যানিশদের সুরে সুরে কথা বলছে ইংলিশরা। এক সময়ের সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব ভুলে আজ তারা গলায় গলায় বন্ধুত্ব করছে, সংখ্যালঘু জাতিকে নিপীড়ণ করতে, তাদের জমি দখল করে সম্পদ লুট করতে।

ফ্রান্স

ফরাসীরা বিশ্ব ইতিহাসের আরেক সাম্রাজ্যবাদী জাতি। এরাও কাতালানদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেবেনা। কারণ ফ্রান্সের অভ্যন্তরে কাতালান জাতির বসবাস রয়েছে যারা উত্তর কাতালোনিয়া (Northern Catalonia) হিসেবে বেরিয়ে মূল কাতালোনিয়ার সাথে মিশে যেতে চায়। এছড়াও ব্রিটনী, করসিকা, স্যাভয়, প্রভিন্স, অসিটিনিয়া ইত্যাদি জাতি রয়েছে যারা পৃথক জাতি রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের শাসন থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। বসকিউ জাতীয়তাবাদ (Basque Nationalism) এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ফরাসীদের উপর মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টাও করেছে। সশস্ত্র প্রতিরোধও করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদ সংস্থা AFP ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় আমাদের এসব তথ্য জানতে দেয়না ফ্রান্স। যাহোক, এই কারণেই মুখে যতই Liberty, freedom, fraternity এর চটকদর কথা ফরাসীরা আমাকে আপনাকে শোনাক, দিন শেষে ওরা অন্য জাতির স্বাধীনতা হরণকারীই। আলজেরিয়ানদের উপর ফরাসী গণহত্যার কথা ভুলে যাবেননা। তাই কাতালান জাতিকেও ওরা স্বাধীনভাবে গ্রহণ করবেনা।

জার্মানি

অনেকেই বলে থাকেন হিটলারের থার্ড রাইখের পর এঙ্গেলা মার্কেলের হাতে সুপারপাওয়ার জার্মানির উত্থান ঘটেছে যেটি ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি হয়েছে। এটাকে ফোর্থ রাইখ বলা যায়। কিন্তু সত্যি বলতে জার্মান রাষ্ট্রেল অভ্যন্তরেও ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদের ব্যাপক উদ্ভব ঘটেছে। বাভারিয়া এর মধ্যে অন্যতম যারা স্বাধীনতা চায়। এছাড়া ফ্রাঙ্কোনিয়ানস, সর্বস, ফ্রিশিয়ানস নামের জাতি জার্মান জাতির শাসন থেকে বেরিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। জার্মান বৈশ্বিক গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে DW কিন্তু ঘরের খবর আমাদের দেয়না। অথচ এরা আমাদের কিছু হলে তা নিয়ে প্রোপাগাণ্ডা চালাতেই থাকে।

ইতালি
সাম্রাজ্যবাদী ইতালি এক সময় লিবিয়ানদের উপর ভীষণ অত্যাচার চালিয়েছে। ওমর মুখতার এক সময় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন যা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ইতালির অভ্যন্তরে স্বাধীনতা চায় কয়েকটি জাতি। এখন যারা ইতালির শাসন ব্যবস্থায় রয়েছে এরা রোমভিত্তিক। কিন্তু প্রাচীন ভেনিস নগরির নাগরিকরা পৃথক রাষ্ট্র চাচ্ছে বহুদিন ধরে। ভেনিটিয়ান জাতি তাদের রাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নাম দিয়েছে Republic of Venice। অন্যদিকে সিসিলিয়ান, সার্দিনিয়া, লম্বারদিনিয়া, ফ্রিউলিয়ানস প্রভৃতি জাতি ইতালির রোমান ঐতিহ্যে বিশ্বাসী বর্তমান জাতির রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা জাতিসংঘ বা আমেরিকা বা ব্রিটেনকে এ ব্যাপারে কখনোই নাক গলাতে দেখা যায়না। তাদের যত চিন্তাভাবনা সব তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ও হীরা সোনার আফ্রিকা ও জনবহুল এশিয়াকে নিয়ে। তো ইতালিও একারণে কাতালানদের পাশে দাঁড়াবেনা।

রাশিয়া

রাশিয়াকে আমি আপনি যতটা সুশীল ভাবি ততটা তারা নয়। কাতালানদের পক্ষে তারা দাঁড়াবে এমন কোন আলামত নেই। বরং এ থেকে উৎসাহিত হয়ে ককেশাস অঞ্চলের যে বিপুল সংখ্যক জমি রাশিয়া দখল করে রেখেছে যেমন দাগেস্তান তারাও স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট ডাকতে পারে। চেচনিয়া এমনিতেই রাশিয়ানদের দেখতে পারেনা। তাতারিস্তান স্বাধীনতা চায়। সে কারণে কাতালানদের স্বাধীনতাকে কিছুতেই প্রকাশ্যে রাশিয়া সমর্থন জানাবেনা।

আমেরকিা যুক্তরাষ্ট্র

ভাবছেন আমেরিকা দাঁড়াবে কাতালানদের পক্ষে? না, তাও হবেনা। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় খোদ আমেরিকাতেও বিভিন্ন প্রদেশ স্বাধীনতা চায়। আর আদিবাসী আমেরিকানরা বর্তমান শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের থেকে মুক্তি চায়। ১৮৬১-১৮৬৫ সাল পর্যন্ত যে স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ প্রধান আমেরিকা গৃহযুদ্ধ বলে তা ছিল মূলত কৃষ্ণাঙ্গ ও ন্যাটিভ আমেরিকানদের স্বাধীনতার লড়াই। এই ইতিহাস এখন পুনঃচর্চা শুরু হয়েছে। নর্থ ডাকোটায় আদিবাসী আমেরিকানরা রুখে দাঁড়িয়েছে, নেভাদাকে স্বাধীন রাষ্ট্র করার সশ্রদ্ধ বাহিনীও দেখা গিয়েছে। আর সর্বশেষ মার্কিন নির্বাচনের পর ক্যালিফোর্নিয়াও স্বাধীনতার দাবি তুলেছে। ইতিমধ্যেই YES California নামের একটি স্বাধীনতাকামী সঙ্গবদ্ধতা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেকারণেই আমেরিকা কাতালানদের পক্ষে নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে।



ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সর্ব মার্কিনি সর্বনাশা চিন্তায় বিভোর তার সম্পূর্ণ বিপরীত আইডিওলজির দেশ কাতালোনিয়া। সে কারণেই কাতালোনিয়ার পাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেই। আর যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেই সেখানে জাতিসংঘ নামক নপুংশক সংস্থাও নেই হয়ে যাবে। কারণ নিউইয়র্কে সদরদপ্তর হওয়ায় এবং রথচাইল্ড পরিবারের ইহুদীবাদী ভূমিতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় জাতিসংঘ ও ইহুদীবাদী আমেরিকা এক ও অভিন্ন স্বত্মা। তাই কাতালানদের লড়া্‌ই করেই স্বাধীনতা পেতে হবে এটা নিশ্চিত। এই অসম লড়াইয়ে কাতালানদের সাথে আছে এশিয়া ও আফ্রিকার কোটি সাধারণ মানুষ। সেই মানুষদের অকুণ্ঠ ভালবাসা আর কাতালান তারুণ্যের স্বাধীনচেতা মনোভাবই কাতালোনিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও নির্মাণ করবে।

স্পেন এখন কী করবে বা করতে পারে?

স্পেন সহজেই দখলকৃত ভূখন্ড ছেড়ে দিবেনা। আমি আপনি যে স্পেনকে কেবল ফুটবলের স্পেন বলে জানি সেটি কিন্তু স্পেনের ব্যাপারে অসম্পূর্ণ তথ্য। ইউরোপে যে কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদী জাতির উদ্ভব ঘটেছিল একাদশ শতকের পর তার মধ্যে স্প্যানিশরা অন্যতম। পৃথিবীকে বাটোয়ারা করে নেওয়া প্রকল্পে ইংরেজরা এসেছিল এশিয়ায়, ফরাসী, ইতালী আফ্রিকায় এবং স্প্যানিশরা এসেছিল পুরো দক্ষিণ আমেরিকায়। উত্তর আমেরিকায় ফরাসী, স্প্যানিশ ও ইংরেজ তিন পক্ষই আসলেও ফরাসী ও স্প্যানিশরা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হয়। ল্যাটিন আমেরিকার কেবল ব্রাজিল ছাড়া আর সব দেশে যে কারণে স্প্যানিশ ভাষা চলে এর কারণ স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদ। এরা এতটাই পরাক্রমশালী জাতি ছিল যে ল্যাটিন আমেরিকার পুরো সংস্কৃতিকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে তাদের ভাষাগুলো পর্যন্ত থুন করে এসেছে। দীর্ঘদিন স্পেনে যে মুসলিম শাসন ছিল কর্ডোভা ইত্যাদিতে তাও স্প্যানিশ উগ্র খ্রীষ্টানদের হাতে ধ্বংস হয়। তারপর ১৭১৪ সালে বর্তমান কাতালোনিয়াকে স্পেন দখল করে নেয়। এর আগে কাতালোনিয়া স্বাধীনভাবে শাসিত হতো। কাতালানরা কখনোই স্পেনের এই শোষণ মনেপ্রাণে নিতে পারেনি। তারা স্বাধীনতার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম অপেক্ষা করেছে। ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে।

গণভোটের ব্যাপারে স্পেনের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পর থেকেই স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কাতালানদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে অবদমন করতে পুলিশ নামিয়ে দেয়। কিন্তু তাতে আরো বেশি স্বাধীনতাকামীরা রাস্তায় নেমে আসে। ছেলে মেয়েদের উপর স্প্যানিয়ার্ডদের অত্যাচারের প্রতিবাদে অনেক বয়স্করাও কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়। আবার যারা প্রাথমিক অবস্থায় মাদ্রিদের শাসনাধীনে থাকতে চেয়েছিল তারাও ধীরে ধীরে কাতালোনিয়ার পক্ষে চলে আসে বা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। তারা সম্ভবত দেশদ্রোহী হতে চায়নি। তো এমন পরিস্থিতিতে স্প্যানিশ সরকার ১৯৭৮ সালে প্রণীত সংবিধানের বিশেষ আর্টিকেল ১৫৫ এর আলোচনা শুরু করে। আর্টিকেল ১৫৫ হচ্ছে স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য বা প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রে কুক্ষীগত করা। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার কোন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা প্রদেশের উপর যখন আর্টিকেল ১৫৫ প্রয়োগ করবে তখন আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতা বিলুপ্তি হয়ে যাবে এবং অঞ্চল বা প্রদেশ বা রাজ্যটি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার আওতায় চলে আসবে। ঠিক একারণেই ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর, শুক্রবার স্পেনের সংসদ তড়িঘড়ি করে আর্টিকেল ১৫৫ অনুমোদন করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কাতালোনিয়া সরকার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে। সে কারণে আর্টিকেল ১৫৫ কার্যকর করতে গেলে কাতালোনিয়ার স্থানীয় যে বাহিনী রয়েছে তাদের সাথে স্প্যানিশ সরকারের অনুগত বাহিনীর সংঘর্ষ হতে পারে কিংবা সংঘর্ষ অনিবার্য।

এমন হলে ইউরোপে ফের জাতীয়তবাদী দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে। কাতালোনিয়ার মানুষের রক্ত ঝরা নিশ্চয়ই স্কটিশ বা বাভারিয়ান বা ভেনিটোরা মেনে নিবেনা। এ কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, উভয় পক্ষকে সংলাপে বসতে। তবে সংলাপ যে স্পেনের জন্য কাল হবে সেটি বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর স্পেন যদি এই স্বাধীনতার স্পৃহা ও ঘোষণাকে অস্ত্র, ট্যাংক দিয়ে দমন করতে চায় তবে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা অবধারিত হয়ে যাবে। আবার স্পেন যদি এই স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় তবে স্পেনের অন্যান্য স্বাধীনতাকামীরাও ফের জেগে উঠবে। স্পেনের অভ্যন্তরেই আন্দালুসিয়া গঠন করতে চায় আন্দালুসিয়া নামের একটি জাতি, ভ্যালেন্সিয়ার জনগণ স্বাধীনতা চায়। এছাড়া এ্যারাগনিজ, আস্তুরিয়ানস, বালিয়ারিক, ক্যানারিয়ানস, ক্যান্টাবিরিয়ানস, ক্যাস্টিলিয়ানস, গ্যালিসিয়ানস, লিওনিজ, মুরসিয়ানস ইত্যাদি জাতিকেন্দ্রিক স্বাধীনতা আন্দোলন স্পেনে রয়েছে। যদি স্পেন কাতালানদের স্বাধীনতা মেনে নেয়, তবে এই সব জাতিগোষ্ঠীও স্বাধীনতার দাবি তুলতে পারে বা গণভোট দিতে পারে। সে কারণে স্পেনের এমন সংকটময় পরিস্থিতিটা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। স্পেন হয়তো বলপ্রয়োগ ছাড়া কোন বিকল্প পাবেওনা। তবে তা কি কাজে দেবে?

স্বাধীনতা রক্ষায় কাতালানদের প্রতিরোধ প্রস্তুতি কত দূর?
কাতারভিত্তিক আল জাজিরা নেটওয়ার্কের খবরে দেখলাম, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়া রজয় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায় কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লেস পুয়িগডেমন্ট ও তার মন্ত্রীপরিষদকে বাতিল করেছে। কাতালোনিয়ার পুলিশ প্রধানকে বরখাস্ত করেছে এবং ২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর কাতালোনিয়া নতুন সরকারের প্রতিনিধি নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে কাতালানরা এটি বয়কট করেছে। তাদের মতে, স্বাধীন কাতালোনিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার আর স্পেনের নেই। পুলিশ প্রধানকে বহিষ্কার করায় বোঝা যাচ্ছে, কাতালান জাতীয়বাদী একটি সশ্রদ্ধ বাহিনী অবশ্যই স্পেনের সেনাবাহিনী বা পুলিশকে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত হবে। এছাড়া গণভোট রক্ষা কমিটি (Committees for the Defence of Referendum-CDR) স্বাধীনতা রক্ষায় প্রস্তুত বলে ছাফ জানিয়ে দিয়েছে। তারা CDR এর নয়া নামকরণ করেছে Committees for the Defence of the Republic। অর্থাৎ সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেই কাতালানরা মাঠে নেমেছে।রক্তপাতের দিকে গেলে তা কেবল দুই পক্ষের রক্তপাত ও মনোমালিন্য বাড়াবে। কাতালোনিয়াকে আর কখনোই স্পেনের শিকলে বেঁধে রাখা যাবেনা এটা এখন দিবালোকের সূর্যের মত্য সত্য।

স্প্যানিয়ার্ডদের বুঝতে হবে
এটি ত্রয়োদশ বা সপ্তদশ শতক নয়, একবিংশ শতাব্দি। এখানে একটি ইউটিউব বা ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিও লাখ লাখ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে আসতে পারে। তার মানে ট্যাংক নিয়ে আসলেই কেউ ভয় পাবেনা। ট্যাংকের জবাব দেবে এই প্রজন্ম ট্যাংক ভিডিও করে বিশ্বকে জানিয়ে দিয়ে...! আর স্বাধীনতার জন্য যদি অস্ত্র হাতে নেয় কাতালানরা তবে তাদের উপর অবরোধ আরোপ করা কঠিন। কারণ কাতালান সম্পূর্ণ সমুদ্রতীরবর্তী অর্থাৎ বাণিজ্যের জন্য তাদের মাদ্রিদের উপর নির্ভরশীলতা নেই। তাই বার্সেলোনাকে রাজধানী করে স্বাধীন কাতালোনিয়াকে মেনে নেওয়া ছাড়া স্পেনের আর কোন গতি আছে বলে মনে হচ্ছেনা। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে স্বাগতম, কাতালোনিয়া; শুভেচ্ছা ও ভালবাসা কাতালান জাতির প্রতি।

বার্সেলোনা: ফুটবল ক্লাব থেকে স্বাধীনতার প্লাটফরম
বার্সেলোনা কাতালানদের কাছে কেবল একটি ফুটবল দল নয়। এই দলটি কাতালানদের স্বপ্ন বোনার উপলক্ষ্য।ফুটবলপ্রেমীরা যে সংখ্যায় আছে কাতালানদের স্প্যানিশ লা লিগায় খেলা না খেলা নিয়ে তা কাতালানদেরও আছে। আপাতত লা লিগা স্থগিত হতে পারে। আর স্বাধীন হওয়ার পরে কাতালোনিয়া ইংলিশ লীগে খেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ স্পেনের সংবিধান পরিবর্তন করে বার্সাকে খেলানো লাগবে লা লিগায়। সেটি কি করবে? তবে পুরো ব্যাপারটি স্বাধীন দেশ হিসেবে কাতালোনিয়ার টিকে থাকার উপর দাঁড়াচ্ছে। স্প্যানিশরা কিন্তু ভয়ঙ্কর সাম্রাজ্যবাদী জাতি। ওরা আমেরিকার সাথেও যুদ্ধ করেছে জমিজমা নিয়ে। এখন কাতালোনিয়ার উপর তারা কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনও আরোপ করেছে। দেখা যাক কি হয়। যা বলছিলাম, বার্সেলোনা; এই দলটিকে কেন্দ্র করেই ১৯২১ সালের পর থেকে স্বাধীন কাতালোনিয়ার দাবি ছোট্র করে দানা বাঁধতে থাকে। ২৪ বার লা লিগা শিরোপাধারী বার্সেলোনা হয়ে ওঠে কাতালোনিয়ার মানুষদের স্বপ্ন দেখার মাধ্যম।

ফুটবল মাঠে কাতালান ও স্পেনিয়ার্ডদের দ্বদ্বটা রাজনৈতিক আবহে বাড়তেই থাকে। তবে বার্সেলোনার কর্মকর্তারা কখনো দলটির স্বাধীনতার ব্যাপারে অবস্থান জানাতোনা। সমর্থকরাই এই দলটিকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধের জন্ম দিতে থাকে। রিয়েল মাদ্রিদের সাথে খেলায় বার্সেলোনার দর্শকরা গর্জে উঠতো জাতীয়তবাতী চেতনায়। ওরা রিয়েল মাদ্রিদকে হারানোর মাধ্যমে যেন স্পেনকেই হারাতো। ন্যূ ক্যাম্প হয়ে ওঠে লাখো কাতালানের ভালবাসা, ক্ষোভ ও বিচিত্র অনুভূতি প্রকাশের একচ্ছত্র মাধ্যম। সে কারণেই ইনিয়েস্তা, পিকে, গার্দিওয়ালা প্রমুখ মহাতারকারাও ভক্তদের সাথে স্বাধীন কাতালোনিয়ার পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কাতালানরা বার্সেলোনার প্রতিটি ম্যাচের ১৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ড সময়ে সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার জন্য একসাথে শ্লোগান দিতো। ১৭ ও ১৪ এর মাহাত্ম এই যে ১৭১৪ সালে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদীরা কাতালোনিয়ার মানুষকে হত্যা করে কাতালোনিয়াকে মূল স্পেনের সাথে সংযুক্ত করে। সেই ১৭১৪ সাল থেকে স্বাধীনতা হারানোর কষ্টটা অবশেষে ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর পূরণ হলো। স্বাধীন কাতালোনিয়া। প্রজাতন্ত্রী কাতালোনিয়া। রিপাবলিকা কাতালোনিয়া। ভালবাসা রইলো বিশ্বের বুকে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাওয়া কাতালানদের জন্য।



নয়া জাতিরাষ্ট্র কাতালোনিয়াকে বিশ্ব মানচিত্রে শুভেচ্ছা। কিন্তু সামনে আসন্ন বিপদ, বন্ধুত্বহীন চলার পথ বন্ধুর


২৭ অক্টোবরের স্বাধীনতার ঘোষণার পক্ষে কাতালোনিয়ার পার্লামেন্টে ভোটের ৭০ টি স্বাধীনতার পক্ষে পড়ে, ১০ টি বিপক্ষে এবং ২ টি শূণ্য ব্যালট। এর আগে এ মাসেরই পয়লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত স্বাধীনতার জন্য অনুষ্ঠিত গণভোটে স্পেন সরকারের বাঁধার মুখেও ২.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ২৩ লক্ষ ভোটার ভোট দেয় এবং ফলাফল দেখা যায় ৯০% কাতালান স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছে।স্বাধীনতা ঘোষণার পর লাখ লাখ কাতালান রাজধানী বার্সেলোনায় নেমে আসে। তারা রং মেখে, বাঁশি বাজিয়ে ও গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে স্বাধীনতার দিনটি উদযাপন করছে। আর এখন দেখা যাবে এই আপাত অর্জিত স্বাধীনতা সুরক্ষায় আসন্ন প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় কি ব্যবস্থা নেয় কাতালান সরকার ও কাতালোনিয়ান জনগণ! স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বিশ্বের বুকে টিকে থাকতে হলে তাদের অনেক বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চোখ রাঙানি, অবরোধ এমন কি যুদ্ধেরও মোকাবেলা করতে হতে পারে। আমরা আশা করি স্বাধীনতার অমৃতসুধা পান করা কাতালোনিয়ার নাগরিকদের জাতীয়তাবোধ দৃঢ় হবে এবং সকল আগ্রাসন, অবরোধকে পরাজিত করে তারা বিশ্বমানচিত্রের বুকে নব্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

নিবন্ধটি শেষ করবো কাতালোনিয়ার ৬০ বছরের নারী মারতা সোল (Marta Sol) এর একটি বক্তব্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে ব্যক্ত অনুভূতিতে এই বার্ধক্যে উপনীত নারী বলেন, ‘আমার কৈশোর থেকে এই মুহূর্তটির জন্য আমি অপেক্ষা করছি। আমার অনুভূতি (স্বাধীনতা পেয়ে) ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা।’ স্বাধীনতার অনুভূতি আসলেই ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। এটি কেবল অনুভব করা যায়। নিজের একটি দেশ, একটি পতাকা ও একটি সংগীত দেখে যেতে পারার সেীভাগ্য এ পৃথিবীর সকল জাতির হয়নি। আশা করি একদিন স্বাধীনতাকামী প্রতিটি জাতি স্বাধীনতার অপার্থিব স্বাদ পাবে।

কাতালান জাতির ঘোষিত স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার যে আসন্ন সংগ্রাম তা ভেবে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কারণ, রক্তপাতহীন স্বাধীনতা ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীরা কোন জাতিকে কোন কালেই দেয়নি...! ব্রিটিশ, ফরাসী, ইতালী, জার্মানী, বেলজিয়াম সবার ইতিহাসই অন্য জাতির রক্তে রঞ্জিত। সে কারণে এককালের দুর্ধর্ষ সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা জাতি স্প্যানিয়ার্ডরাও কাতালানদের রক্তপাতহীন স্বাধীনতা দেবেনা। ঘোষিত স্বাধীনতার পূর্ণপ্রাপ্তির জন্য তাই কাতালান মায়েদের বুক খালি করার স্প্যানিশ প্রকল্প আসন্ন, ইতিমধ্যেই বার্সেলোনার স্বাধীনতা উদযাপন করা জনতার মাথার উপর দিয়ে স্প্যানিশ সেনা ও পুলিশ হেলিকপ্টার দিয়ে মহড়া দিচ্ছে। বারুদের গন্ধ বের হচ্ছে ফের! ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা এই যে, সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির হাত থেকে মুক্তির জন্য রক্ত ঢেলে দিতে হয়।

কাতালানরাও কি বুকের তাজা রক্ত দিতে প্রস্তুত নয়?
এ প্রশ্নের উত্তর বাংলার কবি দিয়ে গিয়েছেন বহু বছর আগে আরেকটি প্রশ্ন করে:-
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়?’।

লেখক: মঈনুল রাকীব

স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments