কর্পোরেট মুনাফালোভী ধান্ধাবাজ মিডিয়ার বয়ানে বিভ্রান্ত হবেন না। কৃষক শ্রমের চড়া মূল্যের জন্য "কামলা বা মজুর রাখতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত", "ধানে আগুন" ইত্যাদি সংবাদ মূল জায়গা থেকে আমাদের অন্যদিকে নেয়। কারণ মূল সমস্যা ধানের মূল্য কম। আলু, পটল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, টমেটো, মরিচ, শসা, লেবু, কপি, শাক-সব্জী, লাউ, কুমড়া, পেয়ারা, কচু, আখ, আম, কাঁঠাল প্রভৃতি কিছুরই ন্যায্যমূল্য পায়না প্রান্তিক চাষী। ফসলের মূল্য নাই। পাটের মূল্য নাই, অথচ বিশ্বে পাটের চাহিদা সর্বাধিক। এই সব ফসলের মূল্য বৃদ্ধি করতে হবে রাষ্ট্রকে। তা না হলে রাষ্ট্র দেউলিয়া হবে, পুঁজিবাদীরা তখন অন্য দেশে পালাবে। তারা গরীবের রক্ত চুষে সে সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমাদের কী হবে?
২।
একটা ফালতু চকলেটের দামে কয়েক কেজি ধান কেনা যায়, এক বোতল পানির দাম ধানের চেয়ে বেশি। সেই কম দামে ধান কিনে পুঁজিবাদীরা বিক্রি করে ৪০-১০০ টাকা কেজি। প্রতি মন ধান মাত্র ৪০০-৬০০ টাকা, অথচ প্রতি মন চাল ১৫০০-৩০০০ টাকা। এইভাবে উৎপাদনমমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক। তাঁর রক্ত পানি করা ফসল তাকেই চড়াদামে কিনে খেতে হয় বা কেনার সামর্থ হয়না। মধ্যস্বত্বভোগী, রাষ্ট্র, মধ্যবিত্ত, পুঁজিবাদী এরা সব এক হয়ে এক যোগে কৃষকের রক্ত পান করে পৈশাচিক সুখে থাকে। লাভের ল-ও পায়না কৃষক।
৩।
অন্যদিকে কৃষি বিপ্লবের নামে দেশীয় বীজ ধ্বংস করেছে। এখন কৃষক "বেছন" রাখেনা, তাকে বীজ কিনতে হয় ব্যবসায়ীর কাছে থেকে। সেই বীজের ফসল আবার সার ছাড়া ফলেনা। এভাবে ফসলের উপর থেকে কৃষকের মালিকানা পুঁজিবাদী সিনজেন্টা, মনসান্তোরা নিছে। অহেতুক সার দিয়ে নগদ খাওয়ার লোভ দেখিয়ে জমিকে অনুর্বর করেছে শিক্ষিত ধাপ্পাবাজের দল। ভারত থেকে অতিমাত্রায় পণ্য আমদানি করে দেশীয় পণ্য ও ক্ষুদ্র শিল্পকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে। মিডিয়ায় কৃষকের বিনোদনের কিছু রাখা হচ্ছেনা। জিএমও আর হাইব্রিডের নামে ফসলে ভেজাল ঢুকিয়েছে। এই সব মিলে কৃষক অসহায়। তার ফসলের দাম নাই। শুধু ধান নয়। পেঁয়াজ, রসুন, আলু, টমেটো, বাদাম, আম, জাম, কোন কিছুর ন্যায্যমূল্য পায়না কৃষক। অথচ এই বিষয় নিয়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হয়না, যার টাকায়, যার ঘামে, যার শ্রমে এই বিশ্ববিদ্যালয় চলে তাকে নিয়ে ভাবেনা বিশ্ববিদ্যালয়। মিডিয়া হয়েছে শিল্প ও পুঁজিপতিদের দাস। সেখানে কাজ করে পুঁজির দাসদাসীরা। রাজনীতি জনগণের হাতে নাই, ব্যবসায়ীরা এখানেও এসে হাজির। তাই মানুষের আবেগ, কষ্ট, শ্রমেও লাভ-লোকসানের হিসাব করে আগায় তারা। একাডেমিক আর আমলারা নিজের চাষী ও কৃষকের শিকড় ভুলে সাহেব হয়েছে, গাড়িতে চড়ছে, এসি খাচ্ছে, হাত ছেড়ে চামচ দিয়ে খাওয়া শিখছে, লুঙ্গী-গামছা-শাড়ি ছেড়ে প্যান্ট-টাই-টপস ধরছে, চাচা-চাচীকে আংখল, আংটি বানাইছি, নষ্ট করছে সমাজের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা; সামষ্টিক কল্যাণকামী ভাবনাকে ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রীক করেছে। তাই সভ্যতার কারিগর ন্যায্য মূল্য না পেলে কারো কিছু যায় আসেনা। কৃষক-শ্রমিক না খেয়ে মরলেও শয়তান, মুনাফাপূজারী উচ্চবিত্ত ও স্বার্থপর ভণ্ড মধ্যবিত্তের কিচ্ছু যায় আসেনা। অথচ কৃষক না থাকলে, ফসল না ফললে এই (অ) সভ্যতা ধসে যেতে বেশিদিন লাগবেনা। এই মিডিয়া, ফিডিয়া, ভার্সিটি, ইন্ডাস্ট্রি, পলিটিক্স, ফলিটিক্স সব গোল্লায় যাবে কৃষক-শ্রমিক অবমূল্যায়িত হলে, ফসল-শ্রমের ন্যায্যমূল্য না পেলে। যারা শিল্পকে এদেশের অর্থনীতির প্রধান বলতে চাচ্ছে এরা নিজ সংকীর্ণ স্বার্থে এটা বলতে চাচ্ছে, এই জিডিপি-ফিডিপি সব গুটিকয়েক মানুষের কাছে সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার তাত্ত্বিক রূপ৷ কৃষি ও কৃষকই এদেশের মেরুদণ্ড। শিল্প হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষের ফুলে ফেঁপে উঠার মাধ্যম, আর কৃষক সকলের বেঁচে থাকার জ্বালানী, অর্থনীতির চালিকাশক্তি। উৎপাদনের প্রথম পুরুষ। এ সভ্যতার নির্মাতা। স্রষ্টা মনোনীত উপস্রষ্টা। কৃষক-শ্রমিক ও তাদের ঘাম ঝরানো ফসল ন্যায্য মূল্য না পেলে এই আধুনিকতার পতন হলো বলে। এই ভোগবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছে, টের পাচ্ছেনা! টের পেলে হয়তো সময় থাকবেনা।
0 Comments