সর্বশেষ

তামিল ছবি কেন আমি ভালোবাসি? দক্ষিণ অনার্য আমার

তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়লাম ভাষার চলচ্চিত্রগুলোকে আমার মাটির ও আপন মনে হয়৷ অনার্য ভূমিপুত্রদের ছোঁয়া দেখা যায়। বেশিরভাগ বাংলাদেশের, পশ্চিম বাংলার আর বলিউডের চলচ্চিত্রগুলোকে মনে হয় পশ্চিমকে পলিথিনের ব্যাগে ভরে ফেরি করতেছে মাটির হাড়ি-কলস বলে। 
দক্ষিণের ওদের অঙ্গসজ্জা, পোশাক, সেট, সংলাপ সবকিছু স্বতন্ত্র এবং আমাদের আমাদের। এমনকি এক লাথি দিয়ে ভিলেনকে উড়ায় দেয়া, লুঙ্গি পরে রামদা হাতে কোপানো, বা থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেয়া--- তাও মনে হয় পাশের বাড়ির কাহিনী। 

এদের ফোক গান শুনতে পারেন। মনে হবে আমাদের বাংলার মা-খালারা একটু ভাষা বদলে গীত গাচ্ছে৷ ধনুসের 'কর্ণ' দেখবেন ফোকে পূর্ণ। কলিজায় লাগবে কর্ণকে প্রত্যাশা করে গাওয়া গানটি। মাগাধীরার ধীরা ধীরার সুরও অসাধারণ! আর কর্ণাটকের কেজিএফের মা বন্দনার 'না না রে নানা' তো ইতিহাস।

উত্তর ভারতের সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ এগুলোও দক্ষিণ ভারতে কম৷ এরা এখনো কৃষিপ্রধান। এদের সিনেমার কাহিনীতে উচ্চবর্ণের সাম্প্রদায়িকতাকে পরাজিত করার চেষ্টা দেখা যায়৷ কর্ণে এক দলিত যুবক কর্ণকে দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুলিশদের ধোলাই করায়। অসুরে দেখা যায় ভূমিদস্যুদের কল্লা ফেলে দেয় নায়ক। এভাবে এরা---মেঘনাদের উত্তরপুরুষ হিসেবে লড়াই জিইয়ে রেখেছে। দিল্লিকেন্দ্রীক যে ব্রাহ্মণ্যবাদী দেবতা বন্দনা তাকে এরা মেঘনাদ, অসুর, রাবন, শিব দিয়ে প্রতিস্থাপন করে প্রতিবয়ান দাঁড় করায়। 

হায়দারাবাদ এদের ঢাকা। চেন্নাই এদের ঢাকা। একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অনেককিছু। নিজেরা করার তাগিদ থেকে এরা চিকিৎসায় অনন্য। নাগরিক সেবায়ও অন্যান্য রাজ্য থেকে নিবেদিত। তবে প্রতিবাদের জন্য যেহেতু এরা অনন্য, তারমানে এদের আশেপাশে শোষকও কম নয়৷ সেগুলোই ফুটিয়ে তোলা হয় সিনেমায়।

এক সময় এদের স্বকীয় নির্মাণ, কাহিনী, কস্টিউম, সেট, সংলাপ, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা, গান ও ফাইট সিন দেখে নকলবাজ বলিউড, টলিউডখোররা হাসাহাসি করতো। আজ এগুলোই হয়েছে দারুন মানদণ্ড। ওদের মত করে স্পেশাল ইফেক্ট ব্যবহার শুরু করেছে পুরু উপমহাদেশ।  ওদের সিনেমা কোটি টাকা বাজেটে নির্মিত হয় এবং পুরো বিশ্ব মাতায়৷ বলিউড ওদের কাহিনী রিমেক করে রোজগার করতে বাধ্য হয়। যেমন, গজিনি।

দ্রাবিড় আমাদের রক্তের জাত। কোল, মুন্ডা, সাঁওতালের জ্ঞাতি ভাই৷ তাই দক্ষিণের স্বকীয়তা বা মৌলিকত্বে আমার ভালো লাগা জন্ম নেয়৷ এর সঙ্গে উত্তরভারতের সাম্প্রদায়িকদের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লির প্রতি আমার অনুরক্ততা আছে বলে মনে করার কারণ নেই। যে উদ্দেশ্যে মাগাধীরায় শের খাঁ আসে, বা সুলতানে মনসুর সেই সৎ উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত 'পদ্মাবতীতে' আলাউদ্দিন খলজি আসেনা৷ এসব অন্য আলাপ।

আমি আদিম, মাটি, খাঁটি ও মৌলিকত্বের ধারক, অন্তত চেষ্টা করি আদিতে যেতে৷ আর আমার এই রুচিতে দক্ষিণের চলচ্চিত্রকে তুলনামূলকভাবে মনে হয় অনন্য। 

লকডাউনে কর্ণ, অসুর, সুলতানসহ বেশ কিছু তামিল-তেলেগু সিনেমা দেখছি৷ এরা যেভাবে বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলে, এই মাটির তামাটে কাদামাখা ঘর্মাক্ত শরীরের জমিমাটিরঙের মুখশ্রীকে যেভাবে নায়োকোচিত করে উপস্থাপন করে সেটিই এদের আমাদের কাছে আপন করে নিয়ে আসে। আমাদের আশেপাশে থাকা মানুষদের এরা নায়ক, নায়িকা হিসেবে আনে। এদের সিনেমায় আজো ছোট বোন, দাদা, দাদী, নানা, নানী, মামা জায়গা পায়। আত্মকেন্দ্রীক আমি-তুমির সংকীর্ণ জালে এরা বন্দি নয়৷ এদের প্রেমিক হয় মানবতার ধারক, এদের প্রেমিকা হয় মন্দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্রসেনা। 

এদের নায়িকারা পাঁচ কেজি কেমিকেল মেখে আসেনা, ফিনফিনে পাতলা কাপড়ে শরীর দেখিয়ে মুগ্ধ করেনা---অভিনয়, এক্সপ্রেশন তাদের সম্বল। এদের গানের মধ্যেও দেখবেন কাহিনী আসে অর্থাৎ জীবনকে নিছক ভোগবাদী রূপে এরা পোর্ট্রে করেনা।

আমি প্রচুর পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমা দেখি। যেমন--রহিম রূপবান। এই ছবির গীতগানের যে সুর সেটি পুরো পৃথিবীতে অদ্বিতীয়, সেরা। আবার হলিউডের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, ডকুমেন্টারি, অরিজিনাল সিরিজ, সাই ফাই, সুপারহিরো মুভিজও প্রচুর দেখি। এতো এতো দেখি যে আমার অনেক সিনেমার প্লট অল্প কিছুক্ষণে বুঝে নিতে সুবিধা হয়। এসব বহুদর্শীতা বিবেচনায় আমি বলতে পারি, দক্ষিণের চলচ্চিত্রের মধ্যে যে স্বকীয়তা রয়েছে তা অনন্য।

আমি বিশ্বাস করি, নিজের যা আছে তাকে যদি ভালোবেসে উপস্থাপন করা যায় তবে সেটাই সেরা হয়ে উঠতে পারে৷ কারণ, মানুষ সময় ও অর্থ খরচ করে নকল বা ভেজাল জিনিস কেনেনা, দেখেনা, খায়না৷ মানুষ চায় বৈচিত্র্য, ভিন্নতা ও অনন্যতা। দক্ষিণ---আমাদের নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ভাইটি সেটিই করছে৷ তাদের আমার এ জন্যই ভালো লাগে। তাদের হাজারো সালাম। তাদের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বুর্জোয়া নন্দনতাত্ত্বিক বর্ণবাদী বাটখারা বা ঘোরকে পরাজিত করার লড়াইকে বিপ্লবী অভিবাদন। 

শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতার বাংলাদেশ তথা পূর্ববাঙলা ও দক্ষিণের জয় হোক।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments