মহানগর মহাদর্শন
~~~
যারা আমাকে চেনেন একটু আধটু তারা জানেন আমি সিনেমা শুধু দেখিনা, আমি পাঠও করি। মানে খুঁটিনাটি দেখি, এর অন্তর্নিহিত বয়ান বের করার চেষ্টা করি। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম হইচই-এ বাংলাদেশের নির্মাতা আশফাক নিপুণের বানানো 'মহানগর' মুক্তি পেয়েছে। আইএমডিবিতে ৮+ রেটিং দুই দিনেই।
আফনান চৌধুরী চরিত্রের কৃত্রিমতা, দুর্বল অভিনয় আর জাকিয়া বারি মম'র ন্যাঁকামো ছাড়া আর সবাই আসলে দারুন অভিনয় করেছে। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মম'র ড্রেসকোড এবং বাংলাদেশের একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার হাতে বিড়ি ধরিয়ে দেয়া একেবারে একটা অবাস্তব বাজে উপস্থাপন।
আবিরের চরিত্রটি হতে পারতো মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত কেউ। গাড়িওয়ালা আবিরকে যতোটা অসহায় দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো গাড়িওয়ালা এতো অসহায় নয়---সে যে লেভেলেরই হোক।
আর সাংবাদিক হিসেবে যাদের অভিনয় করানো হয়েছে তাদের একদমই হয়নি। পিটিসিকে এভাবে হাস্যকর করা আনাড়িপনা না করলেও হতো। আশফাক নিপুণ চাইলে বাংলাদেশের যেকোনো বা একাধিক সাংবাদিক/প্রতিবেদককে গেস্ট এপিয়ারেন্স হিসেবে দেখাতে পারতেন। অবশ্য বিনোদন সাংবাদিক বা আনভীরকে ফুল দেয়া ক্রাইম রিপোর্টার্স মার্কা সাংবাদিকদের স্যাটায়ার করতে এদের আনলে সে অন্য আলাপ। আনভীর আর শারুণের দ্বন্দ্বটিকে ফোটাতে 'কুমিল্লার মেয়ে' আনা হলো হয়তো। কিন্তু রিজওয়ান কি শারুণ? তার পাওয়ার কে? এসব নাই!
আর মিডিয়ার প্রভাব, ক্ষমতার সঙ্গে মিডিয়ার মাখামাখি নিয়ে তেমন কিছুর উপস্থাপন নাই! আনভীরকে পোট্রে করলেন আর আনভীর গংদের মিডিয়াকে করলেন ধোয়া তুলসি, তাও কতগুলো দুর্বল বাজে ক্রু দিয়ে! কালেরকণ্ঠ, নিউজ২৪, বাংলাদেশ প্রতিদিন গং এর ইমদাদুল বা নঈম নিজাম বা পীর হাবিবদের মালিকের এলসেসিয়ানমার্কা একটা টাইপেজ দেখাতে পারতেন।
এইসব অসঙ্গতি ছাড়া পুরো উপাখ্যানটি আমার কাছে দুর্দান্ত মনে হয়েছে৷ অনেক অনেক অপ্রিয় বাস্তবতা এখানে উঠে এসেছে। সংলাপ এদিক সেদিক সামান্য হলেও স্ক্রিপ্টের কাজ অসাধারণ হয়েছে৷ খিজির হায়াতের 'জাগো', অমিতাভের 'আয়নাবাজি', বা অজ্ঞাতনামা, গিয়াসের 'মনপুরা' চলচ্চিত্রের সংলাপে এমন নিপুণতা আমি পেয়েছি, যেটি 'মহানগরে' নিপুণও করেছেন।
মোশাররফ করীম ওসি চরিত্রে ভালো অভিনয় করেছেন তবে আমার দৃষ্টিতে পুরো সিরিজের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনয় করেছেন সাব-ইন্সপেক্টর মলয় চরিত্রে অভিনয় করা Mostafizur Noor Imran ভাই। যে কেউ তার অভিনয় দেখলে নিশ্চিতভাবেই ধারণা করবেন যে তিনি পুলিশেই চাকরি করেন। হুমায়ুন ফরিদীর মতো এতো শক্তিশালী অভিনয় বহু বহুদিন পরে দেখলাম ইমরান ভাইয়ের চরিত্রে৷ বিশেষ করে আবীরের সঙ্গে পরিচয়, থানার মধ্যে কথোপকথন, ওসির সঙ্গে কোল্ড ওয়ার বা সাক্ষি খুঁজতে যাওয়া---দুর্দান্ত অভিনয়।
ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে বা মানুষকে হয়রানী না করতে মলয়ের অবিরাম চেষ্টা দেখে আমার বিগত ৫-৭ বছরে এসআই হিসেবে ফেয়ার প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের কথাই মাথায় এসেছে যারা ঘূণে ধরা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সদ্য ক্যাডার এএসপি/এসি বনাম আগেকার নিয়োগ পাওয়া ওসির ঠাণ্ডা লড়াই বা পুরোনো আমলের ওসি বনাম আধুনিক ভার্সিটি পড়ুয়া সাব-ইন্সপেক্টরের অদৃশ্য দ্বন্দ্বটা নিখুঁতভাবে হয়তো কাহিনীতে আসেনি, কিন্তু এটা নিয়ে কাজের বিশাল জায়গা রয়েছে।
তবে মলয় বনাম হারুনের এই থিসিস-এন্টিথিসিসই বাংলাদেশের পুলিশের জনগণের আদর্শ রক্ষক ও সেবক হওয়ার সিন্থেসিসে পরিণত হবে--এটা আমার হাইপোথিসিস। আমি এই সিরিজে তার একটি আলামত পেয়েছি। কাছের মেধাবী অনেকে এসআই, এএসপি ও ওসি থাকায় এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বান্দ্বিকতাটি আমি উপলব্ধি করছি।
এ দেশের মানুষ আইন সম্পর্কে নানাভাবে অজ্ঞতার শৃঙ্খলায় বন্দি। ভার্সিটিতে থাকতে একটি জরিপ করেছিলাম যে আটক বিষয়ে নাগরিকদের ধারণা কী। বেশিরভাগ নাগরিক জানেনা যে তাকে আটক করতে ওয়ারেন্ট প্রয়োজন এবং ২৪ ঘণ্টার বেশি পুলিশ তাকে আটক রাখতে পারেনা। ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ বাহিনী ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি। এসব বাহিনীতে অনেক অনেক সৎ কর্মচারি রয়েছে। তবু কিছু ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর জন্য সাধারণ মানুষ ভীষণ ভয় পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এই ভয়কে জয় করাই আসলে এ বাহিনীর কাজ হওয়া উচিত। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রখর মেধাবী ছেলেমেয়েরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। আমার বিশ্বাস, অচিরেই নাগরিকদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি যে সংশয় মলয়রূপী শাকিল, নাজমুল, রাজু, সৈকতরা তা বদলে স্বস্তি দেবে।
তবু থানার ভেতরের নানা কিছু নাটকীয়ভাবে দেখাতে আশফাক চেষ্টা করেছেন যে দৃশ্য অনেকেই জানেননা।হয়তো পুরোপুরি পারেননি, তবে যা করেছেন তা ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু করতে উৎসাহ প্রদান করবে।
তবে হ্যাঁ, একরাতে ডিবি এসে কোতোয়ালি থানার ওসিকে ধরে নিয়ে যাবে এটা অতিনাটকীয়। যে কনটেক্সটকে ধর্তব্যে নিয়ে তিনি এ দৃশ্য করলেন তাতে এটি তেমন নিপুণতা হয়নি। কোতোয়ালি থানার ওসিকে এসআই এর অভিযোগে গ্রেফতার করার সুযোগ একটিও নেই। বরং ওসি প্রদীপরা আর্মির সাবেক মেজরকে মেরে ফেলে প্রিজন ভ্যানে বসে নালিশ করে সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের নামে!
ঢাকার একেকটি থানার ওসি কী পরিমাণ পাওয়ার হোল্ড করে নিপুণ সেটি ভালোভাবে অনুধাবন করেননি হয়তো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে এক ওসির সঙ্গে কথা হয়েছিলো ক্যাম্পাসের শিক্ষক রাজনীতির একটি সংকটে, মনে হয় অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বা ড. শরীফ এনামুল কবীরের সময়ে। সেই ওসি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, তার সঙ্গে বাদ-বিবাদ করায় তার ঊর্ধ্বতনকেই তিনি একবার বদলি করিয়েছিলেন তদবির করে৷ এ দিক থেকে ওসি' হারুনের এসি' শাহানা'র সঙ্গে ফুটেজ গায়েবের তর্কাতর্কিটাকে ভীষণ সাহসী একটা মুহুর্ত তৈরির সিন মনে হয়েছে।
তা স্বত্ত্বেও শাহানাকে সিগারেট খাওয়ানোর দৃশ্যটি একেবারে বাজেমার্কা, মম'র পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে অভিনয়ও ভালো হয়নি আমার কাছে। ডিসেন্সি, পারসোনালিটি, ক্যারিশমাটিক পারফরম্যান্স বা কস্টিউম---সব কিছুতে মম'র চরিত্রটি ব্যর্থ।
আর এর ঠিক বিপরীত ছিলো 'দারোগা' মলয় চরিত্রের ইমরান ভাই! তার মিশ্রিত রূঢ় ও নরম সংলাপ, এক্সপ্রেশন, হাঁটাচলা, তৎপরতা সব কিছুই অসাধারণ। মোশাররফ করীম অসাধারণ অভিনয় করেছেন, তবে আমার বিবেচনায় তাকে ছাড়িয়ে গেছেন ইমরান।
যাহোক, বাংলাদেশের কেউ আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে কাজ করছে এটি আমাদের জন্য সুসংবাদ। তবে বেশিরভাগ দর্শকই যেহেতু বাংলাভাষী তাই নাম লেখা, নাম উঠানো ইত্যাদি বাংলাতে দেয়াই সমীচীন। অহেতুক চরিত্রকে দিয়ে ইংরেজি বলানো বা মমকে দিয়ে ফাক বলানো আশফাকের নির্মাণের ফাঁক বলেই মনে হলো৷
এসব ছোটখাটো ভুলত্রুটি কাটিয়ে এরপরে আমাদের আশফাক ভীণদেশের ডাকাতদের আরো বেশি করে চিচিংফাঁক করে দেবে এই প্রত্যাশা করে 'মহানগর' দেখার এখানেই সমাপ্তি টানা হলো। ভালো থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। মহানগরের মহানাগরিকবৃন্দের জন্য শুভকামনা।
0 Comments