সর্বশেষ

পান্তা ভাত কেনো এতো মজাদার? খাঁটি পান্তা ভাতের ইতিহাস || পান্তালোচনা || পান্তার আলাপ

পান্তা ভাত নিয়ে পান্তালোচনা
~~~®~~~
অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কিশোয়ার এর পান্তা দেখে (না খেয়ে) যদি আপনি 'পান্তা ভাত সুস্বাদু নয়'--এই সিদ্ধান্ত দেন তবে আপনার বাড়িতে সম্ভবত পান্তা ভালো করে কখনো রান্না বা খাওয়া হয়নি বা হয়না। 
পান্তা ভাত ভীষণ সুস্বাদু। পশ্চিমের মানসিক দাসদাসীরা এক সময় পান্তা ভাতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছিলো এই বলে যে এটি 'অস্বাস্থ্যকর' ও এতে 'শরীরের জন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে' যা ডাহা মিথ্যা বলে আধুনিক সময়ে এসে প্রমাণ হয়েছে। বরং পান্তা ভাতে অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে বলে এখন জানানো হচ্ছে।

এ মাটিতে ভাতকে পান্তা ভাত সাধে করা হতোনা৷ খুব ভোর বেলায় ক্ষেতে কাজ করতে যেতে হতো। অতো ভোরে চুলায় আগুন জ্বালানো কঠিন ছিল। ফলে আযানের পরে চুলা জ্বালিয়ে তরকারি রান্না করার চেয়ে আগের রাতের অতিরিক্ত ভাতের সঙ্গে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ বা চুলার ছাইয়ে পোড়া দেয়া শুকনো মরিচই ছিলো উপযোগী খাদ্য। দুপুর বেলা জমিতে ঘাম ঝরিয়ে গামছায় পেঁচানো বাসন-খোরায় এই খাবারই হয়ে যেতো মুখরোচক। আবার, যাদের ঘরে নিত্য বাজার হতোনা তারাও পান্তা করতো সাধ্যের কারণে, সাধে নয়। আর এ জন্যই স্রষ্টা এতে দিয়েছিলেন চমৎকার স্বাদ। সাধ করে স্বাদ আসেনি, শ্রমে ও ত্যাগে এসেছে স্বাদ। 

রাতে খাওয়ার পর অবশিষ্ট ভাত যেন নষ্ট না হয়ে যায় সে জন্যও ভাতে পানি দেয়া হতো। অপচয় করে ভা ফেলে দিতোনা। আবার, পানি না দিলে নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি। এভাবেই পান্তা ভাতের উৎপত্তি। বিলাসী সাধে নয়, অসাধে।

পান্তা ভাত এ কারণে সবাই রান্না করতে পারেন না। এটি শিল্প। যার সাধ্য আছে তার কাছে এই স্বাদ সহজে ধরা দেবেনা। অভাবের সঙ্গে অথবা শ্রমের সঙ্গে এ স্বাদ জড়িত। বিলাসীতায় পান্তার যে স্বাদ আর আসল পান্তার স্বাদের মধ্যে নিশ্চয়ই তফাৎ আছে৷ তথাপি এ বাংলার স্বচ্ছল, অস্বচ্ছল সবাই পান্তা ভাতে মশগুল হয়েছে। একে ভালোবেসেই খেয়েছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।

সবাই যেমন পান্তা ভাত রান্না করতে পারেনা, তেমনি সব চালে পান্তা ভাত ভালোও হয়না। পান্তার জন্য আদর্শ দেশী আউশ, আমন জাতীয় লাল চাল। এতে যে মজা তা অন্য চালের থেকে পাবেননা--এটা সুনিশ্চিত। পুষ্টিকর অংশ কেটে ফেলে শ্বেতাঙ্গ চাল দিয়ে আদিম রসাস্বাদন করা যাবেনা। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো হবে।

আবার সব রান্না করা ভাতেও ভালো পান্তা হবেনা। পান্তা যেদিন করবেন সেদিন ভাত নরম করে রান্না করা যাবেনা৷ একটু দাঁড়া দাঁড়া করতে হবে যেটাকে ঝরঝরে বলতে পারেন। পানি দিতে হয় নিয়ম করে। রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পানি দিলে সকালে পান্তার স্বাদ আসে। ভাত রান্না করলেন আর গরম ভাতেই পানি মেরে দিলেন---বিষয়টা এমন না।

রান্না শেষ? এবার খাওয়ার পালা! সব কিছু দিয়ে পান্তা খেলেও আপনার ভালো লাগবেনা। পান্তার সঙ্গে সকালে শুকনো মরিচ পোড়া আর কাঁচা পেঁয়াজ, লবন দিয়ে মাখালে সবচেয়ে সেরা স্বাদ পাবেন। মরিচ আবার শলাকা বা কাঠির মধ্যে দিয়ে মাটির চুলার আগুনে পোড়াবেন অথবা চুলার গরম ছাইয়ের মধ্যে দিয়ে নাকে গিয়ে হাঁচির উদ্রেকের আগ পর্যন্ত পোড়াবেন। এরপর পাবেন সেই আদিম স্বাদ! খেলেই শান্তি! আর শান্তিতে আসতে পারে ঘুম! খেজুর পাতার পাটিতে শিমুল তুলার বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমাতে পারেন।
ঠিক দুপুর বেলা বা এর আশেপাশের সময় পান্তা, লবন আর কাঁচা মরিচ-পেঁয়াজ দুর্দান্ত স্বাদের। আর এই কাঁচা মরিচ যদি নিজের বাড়ির আঙিনার থেকে ছিড়েই পাতে ভাঙেন তবে এই মরিচ, পেঁয়াজ আর পান্তা ভাতের যে ঘ্রাণ বের হবে সেটি অমৃত! এ পৃথিবীর বিরল এক খাবার এটি। এই স্বাদ আগের দিনের প্রায় সব বাড়িতেই ছিলো। এখন বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত আর কিছু মধ্যবিত্ত পায়। অনেকেই পান্তা ভাতের এই সৌন্দর্যকে ভুলতে বসেছে।

পান্তা ভাত আরো কিছু তরকারির সঙ্গে ভালো লাগে৷ যেমন, পান্তা আর আগের রাতে রান্না করা গরুর গোশতোর ঝালঝোল সকালে গরম করে খাওয়ার সময় আপনার মনে হবে এই খাবার খাইতে হলেও কম করে একশ বছর বাঁচতে আপনার আয়ুর দরখাস্ত স্রষ্টার কাছে করা উচিত। গরুটা রান্না করতে হবে আলু দিয়ে। আর একটু মশলা বেশি দিয়ে৷ গোশতোটা সকালে নরম নরম হবে। এই গোশতো, গরম গোশতের ঝালঝোল, আধা ভাঙা আলু আর পান্তা ভাত---এই চারে মিলে আপনার বাঙালি হওয়াকে সার্থক করবে। যারা গরু খাননা, তারা এই স্বাদটি পাবেন দেশী মুরগীর ঝোলে। তবে অবশ্যই আলু দিয়ে রান্না করতে হবে।

এ ছাড়াও পান্তা আর হালকা ঘন ডালও ভালো লাগে খেতে। অনেকে আছেন আগের রাতে রান্না করে ডাল যেটি একটু বাসি হয়েছে সেটি দিয়ে পান্তা খেয়ে ভীষণ তৃপ্তি পান। আমার ঘ্রাণটি পছন্দ, খাবারটি তেমন নয়।

আমাদের টুঙ্গিপাড়ায় পান্তার সঙ্গে ভর্তা খাওয়া হয়না। এটা শুনলে আমাদের মা-খালারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় আর আমাদের তামাশা করে যখন শোনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পয়লা বৈশাখে 'শুঁটকী আর আলু ভর্তা দিয়ে পান্তা খাই'! তবে অনেকে ইদানীং খায় শুনছি।  

আমাদের এলাকায় খায়না বলে সব জায়গায় খাবেনা এমন নয়। অনেক এলাকায়ই পান্তা ভাত আর শুঁটকী ভর্তা দিয়ে মজা করে খায়। সঙ্গে শুকনা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে আলু ভর্তা! আমি আলু ভর্তা আর পান্তা ক্যাম্পাসে এসে প্রথম খেয়েছি। মোটামুটি ভালোই। শুঁটকী খাইনা। এর টেস্ট জানিনা। তবে ক্যাম্পাসের পান্তা আসলে পান্তা হতোনা। এটা গরম ভাতে পানি দেয়া কৃত্রিম পান্তা। ঢাকার বা শিক্ষিতদের অধিকাংশ পান্তাই এই কৃত্রিম পান্তা! আউশ, আমন তথা লাল চালের আদি ও অকৃত্রিম পান্তার স্বাদ এই যান্ত্রিক-চাকরিক শহর জানেনা।

পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার যে চল এটি গ্রামে এখন বা তখন অতোটা চল ছিলোনা যেটি এখন পুঁজিবাদীরা করেছে। সারা বছর ইলিশ পাওয়া যেতোনা বলেই পান্তার সঙ্গে ইলিশের দেখা হতো কম। আর এ জন্যই পান্তা ইলিশ আমাদের আদি সৃষ্টি নয়, নয়া সৃষ্টি। মূলত পান্তাভাতের সঙ্গে মাছের বণিবুনা কম। এখন, অবশ্য পান্তা বললেই মাথায় ইলিশ একটা এসে হাজির! 

অথচ মাছের মধ্যে চিংড়ির সঙ্গে (যদিও চিংড়িকে অনেকে মাছ বলেন না) ছিলো পান্তা ভাতের ঘনিষ্ট সম্পর্ক। আলু গোল করে কেটে বা পটল ভাজির সঙ্গে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ দিয়ে চিংড়ি ভাজি এবং পান্তা ভাত খেলে মনে হবে 'উফফফ! এ কী মান্না না সালওয়া?'। কোন চিংড়ি? চাষের? নাহ! মধুমতী বা এ জাতীয় নদীর এক ইঞ্চি-দুই ইঞ্চি চিংড়ি অথবা খালে-বিলের একেবারে ছোট চিংড়ি যাকে আমাদের এলাকায় বলে ইঁছা বা ঘুষো চিংড়ি৷ আমার এলাকায় অবশ্য পান্তাকে বলে 'ফান্তা ভাত' (গোপালগঞ্জে কিছু ক্ষেত্রে কিছু শব্দে প কে ফ উচ্চারণ করা হয়, যেমন--ফরিখ্যা ইত্যাদি)। 

এই হলো আমার পান্তা বিষয়ক চিন্তাভাবনা। এটার প্রেক্ষাপট আমার নিজের জেলা ও উপজেলা। সার্বিকভাবে পুরো দেশের পান্তা ভাতের সংস্কৃতি আরো বিস্তৃত ও গভীর। এটা নিয়ে বড় গবেষণা কাজ হতে পারে। খাদ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা উপাদান জড়িত৷ পান্তা ভাত আমাদের নিত্যসঙ্গী হলেও আমাদের 'মাছে-ভাতে বাঙালি' বলা হয়৷ কারণ, পান্তা সকল মৌসুমে সমানভাবে খাওয়া হতোনা। কনকনে শীতে পান্তার জায়গা করে নিতো পিঠা বা জাউ বা ভাজা ভাত৷ এসময় আগের রাতে ভাত নষ্ট না হওয়ার ঝুঁকি বা সম্ভাবনা না থাকায় অনেকেই পানি দিতোনা। সেই ঠাণ্ডা ভাত সকালে ঘি বা ডাল্ডা আর পেঁয়াজ মরিচ একটু হলুদ দিয়ে  ভাজা হতো!এর স্বাদ অনন্য! এই ভাজা ভাত কোনো রকম তরকারি ছাড়াই বিশ্বসেরা। 

ফলে পান্তাভাত ছাড়াও বাঙালীর অনেক চমৎকার খাবার ছিল৷ তাছাড়া সারা বছর পান্তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি বিজড়িত। মাছ সারাবছর পাওয়া যেতো৷ বিয়ে বা খৎনা বা মিলাদ-শ্রাদ্ধে কলাপাতায় জাউ বা শৈল মাছ আর কদু ঘোটা দিয়ে ভাত দেয়া হতো। এভাবে নানা আঙ্গিকে আমাদের অতীতে ফিরে যেতে হবে।

নিজের সংস্কৃতি ছাড়া আপনার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ সংস্কৃতিই আপনার পরিচয় তৈরি করে। যার নিজের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সে জাতি টিকে থাকে৷ কারণ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্রাসন। শুভ হোক পান্তা ভাতের পথ চলা। রচিত হোক পান্তার ইতিহাস। এ ইতিহাসের মধ্যে জাতি হিসেবে আমাদের স্বাদ, সাধ ও সাংস্কৃতিক লড়াই লুকায়িত। একে খুঁজে বের করার দায় আমার আপনার উপর দিয়েছে চাষা-ভুষা-কিষাণ-মজুর---আল্লাহর কৃপায় পান্তা ভাত খেয়েও দারুন দক্ষতায় কৃষি কাজ করে যে কিষাণ-মজুর আমাদের মুখে গরম ভাত তুলে দিচ্ছে, আমাদের পরাচ্ছে ও পড়াচ্ছে...!

#পান্তা #ভাত #সংস্কৃতি #পান্তাইতিহাস #ইতিহাস #পান্তালোচনা
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments