মোনাজাত উদ্দিনের (১৯৪৫-১৯৯৫) আজ মৃত্যুবার্ষিকী। বুর্জোয়া মিডিয়াপাড়ায় গরীবের সাংবাদিকের ঠাঁই নাই মনে হচ্ছে। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের সংবাদ দিয়ে তিনি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছিলেন। কাজ করতেন 'আজাদ', 'পূর্বদেশ' ইত্যাদি পত্রিকায়। ১৯৭৬ সালের পর 'দৈনিক সংবাদ' এ যোগ দিয়ে তিনি উত্তরাঞ্চল কাভার শুরু করে খ্যাতি পান।
সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহ করার নানা কৌশল তিনি রপ্ত করেন। কখনো ভুল করে শিখেছেন, কখনো ঠেকায় পড়ে, কখনো বা মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না থেকে। তার 'পথ থেকে পথে' বেশ সুপাঠ্য। কীভাবে মানুষের, জনপদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন তার বর্ণনা। আরেকটি বই 'সংবাদ নেপথ্যে' তিনি তার সংবাদগুলোর পিছনের নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের একেবারে প্রথম বর্ষে এ বইগুলো পড়ানো হয়। লেখা আকর্ষণীয় না হলেও পড়তে আমার ভালো লেগেছিল।
মোনাজাত উদ্দিনের সাংবাদিকতা পদ্ধতি ইত্যাদির সঙ্গে আমার সব সময় মতের মিল নেই যেমন, সেনশেসন ক্রিয়েট করতে 'দাঁড়িতে মৌচাক' এ জাতীয় ভুয়া সংবাদও করেছেন একুশে পদক পাওয়া এ সাংবাদিক--কিন্তু তার কার্যপ্রণালী থেকে এখনো শেখার অনেক কিছু রয়েছে যদিও সমাজ ও বাস্তবতা এ সময় অনেক বদলেছে।
যাহোক, আমি এ দেশের সাংবাদিকতার যে অবস্থা তাকে বস্তুনিষ্ঠ তো বলিই না, আমার মনে হয় ঢাকার বড় বড় সাংবাদিকদেরও নীতি, আদর্শ, কৌশল, সাক্ষাতকার গ্রহণের আদব-কায়দা শেখার রয়েছে। আর গ্রাম বা মফস্বলের কথা আমি না বললাম৷ আমার কোনো দিন সময় হলে এ বিষয়গুলো আমি পাঠশালায় যেভাবে হাতেখড়ি দিয়ে বোঝায় এভাবে সংবাদকর্মীদের বোঝাবো। মৌলিক জ্ঞানের অভাবে সাংবাদিকতা পথ হারায়। আর এটা সত্য যে, সাংবাদিক যদি পথ হারায় তবে ভুল হয়ে যায় সমাজদর্শন, পরিচালনা কাঠামো এবং অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মোনাজাত উদ্দিন এ বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে। আজ গ্রাম বা মফস্বলে মোনাজাত উদ্দিনের মত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সংবাদকর্মীদের বেশ অভাব। অর্থ, ক্ষমতা, পদ, প্রতিপত্তির কাছে অনেকেই ব্যক্তিত্ব বিক্রি করে দেয়। এতে সাংবাদিকতা তার আদি রূপ হারিয়ে বিজ্ঞাপন, জনসংযোগ অথবা প্রোপাগাণ্ডায় পরিণত হয়। এ কারণে আমাদের আদর্শ সাংবাদিকতা চর্চা করতে হবে।
সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ ও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সামাজিক মাধ্যম এসে জনগণকে তথ্য আদান-প্রদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ায় মিথ্যা ও অর্ধসত্য বা নিজের বানানো সত্য, বা অপপ্রচার সত্য হিসেবে সবাইকে গেলানো সম্ভব নয়। নীতি, আদর্শ ও পেশাদারী হতে হবে সাংবাদিকদের। তা না হলে এ পেশার মর্যাদা হারাবে। আর সম্মান-মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব নেই, কিন্তু টাকা আছে--এ অবস্থায় সার্থক মানবজীবন যাপন করা অসম্ভব।
মোনাজাত উদ্দিন ১৮ জানুয়ারি ১৯৪৫ এ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯৫ সালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ফেরি থেকে পড়ে নিহত হন! উনাকে বলা হয় চারণ সাংবাদিক। মোনাজাত উদ্দিনের আত্মা ভালো থাকুক।
0 Comments