সর্বশেষ

ভ্লাদিমির পুতিনের লেখায় ইউক্রেন ও নব্য আগ্রাসী রাশিয়ার নীতি

রাশিয়া-ইউক্রেন সম্পর্ক নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নিবন্ধ পড়লাম। লিখেছেন রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ক্রেমলিনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে আছে এটি। নব্য রাশিয়া নিয়ে এক সময় আমার বেশ পড়াশোনা ছিল। আমি পুতিনের এজেন্ডা অধ্যয়ন করতাম৷ আমি বলতে চাইতাম, পুতিন নব্য রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতে চান 'রুশ জাতীয়তাবাদ ও অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্ম' এর কাঁধে চড়ে। অনেক দিন পর আমার আগের সেই হাইপোথিসিসকে সত্য মনে হলো। 
১২ জুলাই ২০২১ এ অনলাইনে প্রকাশিত "On the Historical Unity of Russians and Ukrainians" শীর্ষক এ আর্টিকেলটি পুতিনের রাজনৈতিক এজেন্ডা ও তার ব্যক্তিগত মতপথকে বুঝতে ভীষণ কার্যকর হবে, যেকোনো গবেষণাপ্রেমীর জন্য। 

এ নিবন্ধে ভ্লাদিমির পুতিন বলতে চান, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে ইউক্রেন মূলত রাশিয়ারই অংশ। তিনি নানা যুদ্ধ, সংকট, রাজ্য, সাম্রাজ্য এনে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশকে প্রাচীন রাশিয়া এবং এখানকার জনতাকে প্রাচীন রুশ জাতি বলতে চান (আধিপত্যবাদী পুতিন ২০১৪ তে ক্রাইমিয়াকে এই কারণেই দখলে নেয়, অথচ এ অংশটি এক সময় উসমানী তুর্কিদের দখলে ছিল এবং সেখানের ককেশীয় মুসলিমরা বেশ নিপীড়িত বলে 'ভাইস নিউজ' প্রতিবেদন করেছিল। )। 

পুতিন আরো বলতে চান, ইউক্রেনের নাগরিকরা পশ্চিম তথা পশ্চিন ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ক্যাথলিক ছিলোনা, অর্থোডক্স খ্রীস্টান ছিল। এ উদাহরণে তিনি আলেকজান্ডার নেভ্রস্কি (যাকে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্ক্সবাদী সের্গেই আইজেনস্টাইন ১৯৩৮ এ বায়োগ্রাফিক্যাল ফিল্ম তৈরি করেন) যিনি ক্যাথলিক রোমানদের পরাজিত করেন। এমন কি 'ওলিগ অব নভোগরদ' নামের একজন 'অর্থোডক্স পাদ্রী' যাকে 'নবী'ও বলা হয় তার ভবিষ্যৎ বাণী-- 'কিয়েভকে কেন্দ্র করে সমস্ত রুশ জাতি ঘুরে দাঁড়াবে'-- পুতিন উল্লেখ করেন! কী ভয়াবহ আইডিওলজিক্যাল সেটাপ ভেবেছেন?

পুরো নিবন্ধে পুতিন চেষ্টা করেছেন পশ্চিমারা ইউক্রেনের গুটিকয়েক অভিজাত দুর্নীতিবাজদের মাধ্যমে 'বিভক্ত করো এবং শাসন করো" নীতির প্রয়োগ ঘটাতে 'রাশিয়া শত্রু" এই 'রাজনৈতিক বিশুদ্ধতাবাদীর' (Political Correctness) প্রসার  ঘটাচ্ছে এটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি এমন কি 'নয়া নাৎসি'দেরও টেনে আনেন। 

আমি খুবই মনোযোগের সঙ্গে একাধিকবার পড়ে দেখি পুতিন ইউক্রেন, বেলারুশ, পোলান্ড, লিথুনিয়া ইত্যাদি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে বের হওয়া রাষ্ট্রগুলোকে রুশ ঐতিহ্য--বিশেষ করে 'ভাষার' শৃঙ্খলায় বন্দি করে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে রাশিয়ার নাক গলানোকে জায়েজ করতে চাচ্ছেন। তিনি এমনও যুক্তি দিয়েছেন, কানাডা-আমেরিকা বা ইইউ যেভাবে সীমানা উঠিয়ে দিয়েছে রাশিয়াও তো ইউক্রেন প্রভৃতি রাষ্ট্রে সেটি করতে পারে!

এখন ইউক্রেন বেশ উত্তাল। ২০২১ এর জুলাইয়ে পুতিন তার অবস্থান ক্লিয়ার করেছেন। ইউক্রেন যে নব বা ছোট্ট বা প্রাচীন রাশিয়ার মতই একটি রাশিয়া সেটি বারবার প্রমাণ করতে ইতিহাস এনেছেন--সেই খ্রীস্টপূর্ব থেকে মধ্যযুগ,  রুশ বিপ্লব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত! ন্যাটোকে সে যে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অপ্রয়োজনীয় মনে করে এবং রাশিয়া বিরোধীতা ছাড়া এর অস্তিত্বের কারণ দেখেনা এটি ল্যাভরভ ও পুতিন অনেকবার বলেছেন। 

আমেরিকা ও তার মিত্ররা এটা অধ্যয়ন করেও যদি ইউক্রেনে অস্ত্র নিয়ে যায় তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র ইউরোপই ফের হতে পারে। কারণ, ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পুতিন সরাসরি সমর্থন দিচ্ছেন। এটা সিরিয়া নয়, এখানে প্রক্সি যুদ্ধ বাস্তবে চলে আসতে পারে। এটা স্ব-নগর। আর নিজ নগরের ঘরে আগুণ লাগলে দেবালয় ব্রাসেলস, বার্লিন, লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস নিরাপদ থাকবে?

আজকে সিএনএন ইন্টারন্যাশনালে নাথান হজের ''Will Vladimir Putin turn the second cold war into a hot one?" শীর্ষক নিবন্ধটিতে এ বিষয়ে যদিও বিস্তারিত আলাপ করেনি, কিন্তু পুতিন যে আমেরিকা ও ইউরোপের আগ্রাসী আচরণের জন্য আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি চীনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসে গিয়ে বামপন্থী ফ্যাসিস্ট শি জিনপিং এর সঙ্গে পরামর্শ করবেন সে ইঙ্গিত আছে। 

পুতিনের লেখাটিতে ফিরে আসি। পুতিন লিখেছেন,''True sovereignty of Ukraine is possible only in partnership with Russia'' এবং আধ্যাত্মিক, মানবিক (পুতিন সম্ভবত নৃতাত্ত্বিক বোঝাতে চেয়েছেন), সভ্যতা (সাংস্কৃতিক বন্ধন বোঝাতে চেয়েছেন সম্ভবত) এর প্রতিটি ধাপে বাঁচা, অর্জন ও বিজয়ে রুশ-ইউক্রেনিয়ানরা এক। 

পুতিনের ঢালাও বয়ান, তিনি সাধারণ ইউক্রেনিয়ানদের বিরুদ্ধে নন, তিনি পশ্চিমনির্ভর ও পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিযুক্ত এলিটদের বিরুদ্ধে। আর্টিকেলটি শেষ করেছেন ইউক্রেনের জনগণকে আস্কারা দিয়ে। পুতিন বলেন:
I will say one thing--Russia has never been and will never be "anti-UKraine".  And what Ukraine will be--it is up to its citizens to decide.

অনেক দিন রাজনৈতিক বিশ্লেষণ লেখার সময় পাইনি। প্রায় ৫,০০০ শব্দের এ  আর্টিকেলে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। সব বিষয় লিখলে বিশাল থিসিস হতে পারে৷ তবে আমার মনে হয়, পুতিনের রাশিয়া অর্থোডক্স বন্ধন ও প্রাচীন ইতিহাসের কাঁধে বন্দুক রেখে 'রুশ জাতীয়তাবাদ' কে সম্প্রসারিত করবে আরো নগ্নভাবে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপ বা আমেরিকা যদি বাঁধা দেয় বা দিতে আসে তবে সেটি স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি নয়া শীতলযুদ্ধ নয় বরং সরাসরি যুদ্ধকেই টেনে আনতে পারে। 

আর এ পরিস্থিতি এড়াতে ইউক্রেনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতোমধ্যে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়াকে নিয়ে কৃষ্ণ ও আজভ সাগরকে করায়ত্ত করেছে৷ ন্যাটোকে রুখতে রাশিয়ার "অফেন্স ইজ দ্যা বেস্ট ডিফেন্স'' নীতি সক্রিয় হলে তা বিশ্বকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে পারে। আর যদি আমেরিকা সিরিয়ার মতই রাশিয়ার মুখোমুখি হওয়াকে এড়িয়ে যায় তবে ফের পুতিনের রাশিয়ার আগ্রাসী সামরিক শক্তির আরেকটি বিজয় আমরা দেখতে যাচ্ছি--ইউক্রেনে।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments