সর্বশেষ

রাশিয়া বনাম ইউক্রেন + অ্যামেরিকা ন্যাটো যুদ্ধ || ভ্লাদিমির পুতিন এর ভূরাজনৈতিক এজেন্ডা

শান্তিরক্ষার অজুহাতে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের অশান্ত যুদ্ধবাজি, ইউক্রেন সংকট ও আরো কিছু কথা
***
পুতিন 'শান্তিরক্ষা' করতে গিয়ে আজ আবার জাতিসংঘের আর্টিকেল ৫১ এর অজুহাতে ইউক্রেনে আক্রমণের ঘোষণা দিল। তার পদ্ধতিটা কী একটু মনে রাইখেন। দোনেৎসক ও লঘানস্ক রিপাবলিককে প্রথমে অস্ত্র দিয়ে সমর্থন, তারপর স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি, তারপর প্রজাতন্ত্রদ্বয়ের সঙ্গে মিত্রচুক্তি, এরপর কথিত শান্তিরক্ষী অভিযানে সেনা পাঠানো, সর্বশেষ শান্তিরক্ষার দোহাই দিয়ে প্রতিপক্ষ ইউক্রেনের ওপর আক্রমণ। এই একই পদ্ধতি রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োগ করছে অথচ জাতিসংঘ, নপুংশক জাতিসংঘ কচুও করতে পারেনি। কারণ? 

জাতিসংঘ নিজেই অসাম্য ও অশান্তির ঘাঁটি। এর ৫ টি সাম্রাজ্যবাদী বাটপার রাষ্ট্রের দুনিয়া ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খাওয়ার নামই 'নিরাপত্তা পরিষদ'। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অর্ধচোখা বাস্তবতায় ভেটো ক্ষমতা নামের নির্লজ্জ কোটাসমেত এই নিরাপত্তা পরিষদই পৃথিবীর অনিরাপত্তার মূলহোতা। রাশিয়ার আগ্রাসী রূপের শুরুতে আসা যাক।

২০০০ এ অখ্যাত কেজিবি কর্মকর্তা ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতায় আসার পরপরই বিশ্বমঞ্চে নেতৃত্ব হারানো সোভিয়েত স্ট্যাটাস, রুশ সাম্রাজ্যের ভূমি, অর্থডক্স খ্রিস্টান নেতৃত্ব ইত্যাদিকে ভিত্তি ধরে নব্য রাশিয়া বিনির্মাণের এজেন্ডা হাতে নেয়। 

২০০৮ সালে জর্জিয়ার দক্ষিণ ওশেটিয়া ও আবখাজিয়াও প্রথমে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং পুতিন স্বীকৃতি দেয় কিছুদিন পর। তারপর শান্তিরক্ষার নামে জর্জিয়া আক্রমণ করে।

২০১৪ সালে এক সময়ের স্বায়ত্তশাসিত ক্রাইমিয়াকে অধিগ্রহণ করতে সেখানে সাজানো গণভোট দেয় যাতে ৮৩ শতাংশ ভোটারের ৯৭ শতাংশ 'রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে হ্যাঁ ভোট দেয়'। নপুংসক জাতিসংঘসহ কেউই এটাকে স্বীকৃতি দেয়নি। রাশিয়া ক্রাইমিয়া অধিগ্রহণ করে আজভ, কৃষ্ণসাগরে তাদের অবস্থান সুনিশ্চিত করে। এই অপরাধে রাশিয়াকে জি-৮ বহিষ্কার করে, কিন্তু জাতিসংঘে সে থেকেই যায়! ফালতু গঠনতন্ত্র জাতিসংঘের। 
২০১৪ তে পশ্চিম কথিত 'ইউক্রেন এর মর্যাদার বিপ্লব' কে সমর্থন দেয় এবং রুশপন্থী ভিক্টর ইওনিকোভিচকে ক্ষমতাচ্যূত করে৷ একই সঙ্গে বুশের সময় থেকে ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্য করতে তৎপর হয়। স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া হুমকি অনুভব করে। ইউক্রেনের রুশভাষীরা রাশিয়াকে নিজেদের জন্য নিরাপদ ভাবে। 

আর পুতিনের লেখা সাম্প্রতিক নিবন্ধ ''On the Historical Unity of Russians and Ukrainians' এ তিনি স্পষ্ট করেছেন যে কিয়েভকে কেন্দ্র করে প্রাচীন রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কার্যক্রম পরিচালিত হয় এবং ইউক্রেন 'মূলত' রাশিয়াই। শুধু কি তাই? 

পুতিন পার্শ্ববর্তী বেলারুশ, লাতভিয়া, লিথুনিয়া, মলদোভা ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোকেও সাংস্কৃতিক ও ভূরাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার বলে দাবি করেন৷ এ নিয়ে জাতিসংঘ বা পশ্চিমারা কোনো আলাপ তোলেনি৷ অথচ পুতিন নিজের রুশ অর্থডক্স খ্রিস্টান আইডেনটিটিকে সবার আগে এনে প্রাচীন রুশ সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত লিগ্যাসিকে সামনে এনে নব্য রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী খায়েশ খোলাখুলিভাবেই প্রকাশ করে।
'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ' নামের সন্ত্রাসবাদী প্রকল্পের মাধ্যমে মুসলমানদের পিছনে লেগে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্র তার ঘরের পাশের পুতিনকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে ঐক্যবদ্ধ হয়নি। এ কারণে, সিরিয়ায় আমেরিকাকে চপেটাঘাত করলেও এ নিয়ে তারা উচ্চবাচ্য করেনি। এমন কি এই সেদিন তালেবানদের সঙ্গে পর্যন্ত পুতিনের দহরম মহরম।  ২০০৮ এ জর্জিয়া আক্রমণ করার পরেও ন্যাটো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়নি। তারা মুসলিম নিধনে ব্যস্ত ছিল। 

রিপ্রেসিভ রাষ্ট্রকাঠামো এমন যে তা যুদ্ধ করে, জাতীয়তাবাদকে উগরে দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে। পুতিনের উপর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে তার অর্থনীতি এমনিতেই ভঙ্গুর। কিন্তু এর প্রোপাগাণ্ডা গণমাধ্যম আন্না, আরটি, স্পুৎনিক, তাসে দেখবেন পশ্চিমের পলিটিকাল ক্রিটিকে ভরা। তারা জনগণকে পশ্চিমের ভুল ধরায় ব্যস্ত রেখেছে এবং রাশিয়া যে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে অপ্রতিরোধ্য শক্তি এটি প্রতিষ্ঠিত করেছে। 

পৃথিবীর যেখানে যত ফ্যাসিস্ট শক্তি, তা যদি পশ্চিম বা আমেরিকার বিরুদ্ধে যায় পুতিন শরম লজ্জার মাথা খেয়ে তার পাশে দাঁড়ায়। এ পরিণতিতে রেজিম চেইঞ্জ করেও তাকে সরানো যাচ্ছিল না। কিন্তু বিকল্প প্লানও করেনি পশ্চিম। কারণ, সে তার নিজের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক, বর্ণবাদী ও রাজনৈতিক সংকটেই জর্জরিত। এমন কি আমেরিকার ক্যাপিটল হিলে খুনোখুনি হয়। 

আরেকটি কারণ, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়ার। আরো একাধিক শক্তি অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতায় ভাগ বসায়। চীন, ভারত, তুর্কি, ইরান ইত্যাদি রাষ্ট্র বিশ্বকে আর দুই মাতুব্বরের তালুকদারি হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক নয়। তুর্কির এরদোয়ান তো একাধিকবার নিরাপত্তা পরিষদের ৫ টি স্থায়ী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ক্রিটিক করে 'দি ওয়ার্ল্ড ইজ বিগার দ্যান ফাইভ' ফ্যাক্টকে সামনে আনে। এ ক্ষেত্রে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের অহেতুক যুদ্ধ মার্কিন শক্তি, অর্থ ক্ষয় করে৷ এ যুদ্ধগুলোর কারণে নয়া নয়া সামাজিক সমস্যা সামনে আসে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিভাজিত হয়। পশ্চিমের নেতার এই দুরবস্থার সুযোগ নেয় রাশিয়ার গোয়েন্দা রাষ্ট্রপ্রধান। সে এমন কি মার্কিন নির্বাচনকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে। 

যাহোক, এসব কথার মূল কথা পৃথিবী আর একা আমেরিকার কথায় চলেনা। ১৯৯১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত আমেরিকা ও পশ্চিমাদের মাতুব্বরি থাকলেও ২০০৮ সালে পুতিনের নেতৃত্বে জর্জিয়ায় আক্রমণ এই বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই চ্যালেঞ্জের ষোলকলা পূর্ণ হয় সিরিয়ায় গিয়ে রাশিয়ার পুরো যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এবং ২০১৪ তে ক্রাইমিয়া অধিগ্রহণ করা ক্রাইম করার মাধ্যমে। 

জো বাইডেন দেখলাম বলছেন আজকে যে, রাশিয়া যুদ্ধ বাঁধালো এবং পরবর্তী কার্যক্রম যা হবে তার দায় রাশিয়ার নিতে হবে৷ 

বাইডেনসহ পশ্চিমাদের বুঝতে হবে যে, পুতিন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি জেনেই এখানে এসেছে৷ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র হলেও তার জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়েও কম। তার ভূখণ্ডের চেয়ে জনসংখ্যা বেশি প্রয়োজন। তাই যেখানেই রুশ ভাষীদের দেখবে সে সেখানে যাবে৷ রুশভাষী না হলেও তাকে ডাকলেই সে যাবে। কারণ, যুদ্ধই রাশিয়ার পুতিনকে টিকিয়ে রাখবে। 

কেইস স্টাডি হিসেবে লিবিয়ার গাদ্দাফি আর উত্তর কোরিয়ার কিম কে নেওয়া যায়। গাদ্দাফি পশ্চিমকে বিশ্বাস করে তার আত্মরক্ষার অস্ত্র ধ্বংস করার কিছু বছর পর পশ্চিমা ন্যাটো জোট তাকে খুন করে এবং কিম জং উন পারমাণবিক বোমা রাখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করজোড় করে কিমের সঙ্গে মিটিং এর ডেট নেয়। রাশিয়ার সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা এ বিষয়টি জানেন। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের নিকট জীবনের মূল্য তার জানা আছে৷ রক্তাক্ত অতীতের উপর দাঁড়ানো আজকের চেরাগি ইউরোপ যে নিজের ঘরে রক্তপাত দেখলেই ঘরপোড়া গরু হবে সেটি পুতিন জানে। 

ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুদ্ধের ময়দান পশ্চিমে নিয়ে আসার পেছনে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে রাশিয়া ও ভ্লাদিমির পুতিনের পাকাপোক্ত জায়গা নিশ্চিত করাসহ শাসনকে দীর্ঘায়িত করার এই রক্তমাখা চোখরাঙানি পূর্বপরিকল্পিত ধরা যায়। ধরা যায়, আমেরিকা ও ন্যাটো যদি জবাব দেয় তবে ইউরোপীয় চেরাগীপনা ধ্বংসস্তুপ হলো বলে...!
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments