সর্বশেষ

ধর্ম বনাম বিজ্ঞান : আইনস্টাইন ধর্ম নিয়ে কী বলেছিলেন? বিজ্ঞানমনা মুক্তমনা বনাম ধর্মমনা

 ধর্ম বনাম বিজ্ঞান : আলবার্ট আইনস্টাইন আদতে কী বলেছিলেন?

~♥~

বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশের সর্ব ধর্মের মুন্সি-পুরোহিত-ভিক্ষু-পাদ্রী-রাবাই প্রমুখ নিজ নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলতে চায়। তারা বিজ্ঞান থেকে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থকে অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। এটা তাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাস তাদের অমুসারীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেয়। 



আবার, বিজ্ঞানধর্মের অনুসারীদের নিকট বিজ্ঞানই পরম সত্য। ধর্ম অপ্রয়োজনীয়, সংঘাত-ঘৃণা ছড়ায় ইত্যাদি। এরাও অন্যান্য ধর্মের মত বিজ্ঞানে অন্ধবিশ্বাসী। এই অন্ধবিশ্বাস এরাও ছড়িয়ে দেয়৷ এদেরও অনুসারী আছে।


প্রথম শ্রেণীর সঙ্গে এদের তফাৎ ওরা নিজেদের পরিচয় দেয় মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদী প্রমুখ বলে আর দ্বিতীয় পক্ষ নিজেদের বলে বিজ্ঞানমনা, বিজ্ঞানমনস্ক, মুক্তমনা, আধুনিক, লিবারেল, সেকুলার, এথিস্ট, সংশয়বাদী ইত্যাদি।  


এ দুই পক্ষই মূলত নিজ নিজ বিশ্বাস প্রচারে ব্যাপক তৎপর। যেকোনো ইস্যু আপনি দিলে এরা সবাই তার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেবে। ইস্যুটিকে নিজ প্রয়োজনে কাছে টানবে এবং অপ্রয়োজনে দূরে সরাবে। সহজ হিসেব৷ 


এখন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ নিয়ে যেটি হচ্ছে আর কী। 


তো এসব ভাবতে ভাবতে অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের (১৮৭৯-১৯৫৫) ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাট্যাখা বা বক্তব্য খুঁজতেছিলাম৷ কারণ, আপনাদের ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয়ে আলবার্ট আইনস্টাইনের মতাদর্শ কী সেটির নির্যাস জানাতে চাই।


কৃতজ্ঞতা জানাই এলগোরিদম এর সবচেয়ে উত্তম উদ্ভাবক ইসলাম ধর্মের আল খোয়ারিজমি ও লগারিদমের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবিত গুগলের নির্মাতা ইহুদী রক্তের ল্যারি ও সের্গেইকে যাদের কল্যাণে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনস্টাইনের 'Religion and Science' [১৯৩০ (New York Times Magazine), ১৯৪৯ (The World as I see It, Einstein's Book), ১৯৫৪, (Ideas and Opinions)]; 'Science and Religion' [১৯৫৪, Ideas & Opinions ] এবং 'Religion and Science : Irreconcilable?' (১৯৫৪ Ideas & Opinions) শীর্ষক নিবন্ধ তিনটি পাই। 


লেখাগুলি পড়ে আইনস্টাইনের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও ধর্মের বিশালত্ব নিয়ে যে ভাবনা সেটি জানতে পারলাম। আইনস্টাইনের তত্ত্বকে ভিত্তি ধরে ধর্মবিরোধী বা ধার্মিক হওয়া অনেকেই হয়তো কখনো এ নিবন্ধগুলো পড়ে দেখেননি৷ 


আইনস্টাইন তাঁর এসব লেখায় (যার একটি বক্তব্য আকারে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়েও দিয়েছেন) যারা প্রকৃতবিজ্ঞানী তাদের বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনে 'ধর্মের গুরুভূমিকা' এর কথা উল্লেখ করেন। শুধু তাই নয়, ধর্মের নানা ক্রিটিক তিনি যা করেছেন তা ধর্মের স্ক্রিপ্টকে ভিত্তি করে না, মোল্লা-পুরুতদের স্বার্থপ্রভাবিত আচরণের। তিনি বিশেষভাবে গ্যালিলিওর কথা উল্লেখ করেন। তিনি ডারউইনের তত্ত্বকে বলেছেন 'Doctrine', 'Fact' নয়। 


আইনস্টাইন এর মতে, ধর্ম ও বিজ্ঞান একে ওপরের সঙ্গে যুক্ত। একে পৃথক করা কার্যত অসম্ভব। 


আইনস্টান বলেন, সত্য ও বুঝ আনতে যে আকাঙ্ক্ষা তার অনুপ্রেরণা আসে ধর্মের পরিমণ্ডল (Sphere of Religion) থেকে। আইনস্টাইনের পরিভাষায়:


But science can only be created by those who are thoroughly imbued with the aspiration toward truth and understanding. This source of feeling, however, springs from the sphere of religion.(আইনস্টাইন, ১৯৫৪)


আইনস্টাইন সমস্যা দেখেছেন মানুষের অবয়ব ও ভাবনায় নির্মিত ঈশ্বরে (Anthropomorphic conception of God)। তিনি তার ধর্মবিষয়ক আলাপ করেন মূলত খ্রিষ্টান ও ইহুদী ধর্মের আলোকে। এ দুই ধর্মের পাদ্রি ও রাবাইদের নিকট থেকে পাওয়া 'গড' কে তার কাছে মানুষের চিন্তারই ফসল মনে হয়েছে। 


তিনি অবশ্য 'গড' বিষয়ে কিছু ঠুনকো প্রশ্নও তুলেছেন। যেমন--সব কিছু গড এর সৃষ্টি হলে ভালো-মন্দের শাস্তি মানুষ কেন পাবে ইত্যাদি।


আমার মতে, এ প্রশ্ন কার্যত ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্ম উত্তমরূপে ডিল করেনি। ইসলাম বলে 'মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে' এবং মানুষের অভ্যন্তরে 'আল্লাহর রূহ বা সত্তা' দেওয়া হয়েছে। এই যে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব এর গুরুভার ও আল্লাহর সত্তা দেওয়া হলে, এ কারণে মানুষকে 'স্বাধীন চিন্তাশক্তি' দেওয়া হয়েছে। যেহেতু মানুষ স্বাধীন, অতএব তার কর্মের দায় তার।


জাকারিয়া কামাল তার 'সায়েন্টিফিক তাফসিরে' বলতে চেয়েছেন, এই যে  বিলিয়ন বিলিয়ন ছায়াপথ এবং তার অভ্যন্তরের বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র এবং তার অভ্যন্তরে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্রহ-উপগ্রহ এগুলো মূলত 'বিগ ক্রাঞ্চ' (Big Crunch) ও 'বিগ ব্যাং' (Big Bang) এর রিপিটেশন (জামাল নজরুল ইসলাম এর The Ultimate Fate of the Universe, ১৯৮২ ) এর পর মানুষের কর্মফলের গন্তব্য অর্থাৎ এগুলো দেখভালের দায়িত্ব আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের ওপর অর্পিত হবে। উত্তম কাজ করলে ভালো গ্রহ-নক্ষত্র পাবে, যাতে সুস্বাদু দুধনহর ইত্যাদি থাকবে আর বাজে কাজ করলে অগ্নি-হাইড্রোজেন-হিলিয়ামে পূর্ণ ভয়াবহ গ্রহ-নক্ষত্রে নিক্ষিপ্ত হবে। জিনেরও একই কর্মফলের পরিণতি হবে, তবে জিনও মানুষের অধীন হবে কারণ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মানুষকে অগাধ পাণ্ডিত্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। কোরানে আছে দেখবেন আল্লাহ অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন যা ফেরেশতা ও জিন কেউ পারেনি কিন্তু সদ্য বানানো আদম পেরেছিল৷ অর্থাৎ আদম তথা মানুষের মস্তিষ্ক ভীষণ সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময়।  


আইনস্টাইনে ফিরে আসি। তিনি, ইহুদি খ্রিস্টান ধর্মের বাইরে ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবেন নি। তার স্বপ্নের ধর্মভিত্তিক 'জিউশ স্টেট' এর ইহুদিদের দ্বারা তিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যাও দেখেছেন। তবু মুসলমান তার কথায় আসেনি। ছোট্ট করে তিনি বুদ্ধের কথা এনেছেন। হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম নিয়ে তিনি কথা বলেননি, একটি জায়গায় কেবল পেলাম ''Prophets", মানে নবীগণ আর কী! খুব সম্ভবত সেই সময়ে ওসমানীয় খিলাফাতের সঙ্গে ইউরোপীয়দের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তাঁর মধ্যে ইসলামদ্বেষ তৈরি করতে পারে। 


আবার, ১৯৪৮ সালে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইসরায়েল রাষ্ট্রটি গঠনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তিনিও যুক্ত থাকতে পারেন। তিনি ছিলেন একজন জায়নবাদী এবং নিজের বিভিন্ন বক্তব্য ও লেখনীতে তিনি বারবার ঘৃণ্য জায়নবাদের সমর্থন করেন। তিনি 'লেবার জায়নবাদ' (Labor Zionism) নামে একটি বাম ধারার জায়নবাদের কট্টর সমর্থক ছিলেন যে মত পৃথিবীর তাবৎ ইহুদিদের ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে 'আলিয়াহ' বা প্রত্যাগমনের মাধ্যমে হাজির হয়ে 'প্রলেতারিয়েত রূপে' দখলদার হতে বলে। অর্থাৎ আইনস্টাইন একটি অবৈধ খুনী রাষ্ট্র গঠনের সমর্থক। আমাদের ভারতের জওহরলাল নেহেরুর কাছে চিঠি লিখে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সমর্থনও চেয়েছিলেন আইনস্টাইন। 


তা না হলে, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে ধর্মগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা একটি জঘন্য দখলদারী বিষফোঁড়া ইসরায়েলের বৈধতা নিয়ে উনার একটিও আলাপ নাই, অথচ তিনি ধর্ম নিয়ে কথা বলছেন! আশ্চর্যজনক বটে! যদিও তিনি জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি ছিলেন এটা মাথায় রাখলে বিষয়টিতে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকে না। 


যেখানে ছিলাম--ইহুদি খ্রিস্টান ধর্ম দেখা আইনস্টাইনের মতে, ধর্ম গড়ে ওঠে ভয় (Fear) অথবা সমাজ পরিচালনার নৈতিক (Moral) কারণে। তিনি আধুনিক (আইন্সটাইনের সময়ের পৃথিবীর) বিজ্ঞান বনাম ধর্মের সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন 'ব্যক্তিগত ঈশ্বর ধারণা'কে যাকে আইনস্টাইন বলেছেন Personal God। 


স্পষ্ট করছি আমি। আপনার একজনকে পছন্দ হয় না, তারে আপনি কষ্ট দিতে চান। কেউ আপনাকে অপমান করলে তাকে থাপড়াতে চান, কেউ আপনাকে মারলে তাকে মারতে চান, কেউ আপনার প্রশংসা করলে তাকে আপনার পছন্দ হয়। এই যে 'আপনার আবেগ, অনুভূতি' এগুলো যখন আপনার গডকেও দিবেন এবং নিজে যা ভাবেন, করেন বা করতে চান তাও গডের কাছ থেকে আশা করেন সেটিই বিজ্ঞান ও ধর্মের (এবং আন্তঃধর্মের বা আস্তিক-নাস্তিকের) 'সংঘাতের মূল' বলে আইনস্টাইনের মত। 


এ উদাহরণ ধর্ম নিয়ে আলাপের সময় আমি বহুবার ইসলাম ধর্মের ওহাবী কট্টরপন্থী মতাদর্শের অনেককে বলেছি যে,'আল্লাহ আপনাদের মত এক চোখা নন'। যেমন, আল্লাহ সুরা যিলযালে স্পষ্ট বলেন কেউ অণু পরিমাণ সৎ বা অসৎ কাজ করলেও তা দেখতে পারবে। তাহলে যে কোনো মানুষের পূন্যের মূল্য রয়েছে। আবার, আল্লাহ যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক তিনি কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি একচোখা হবেন না। 


বরং 'এক আল্লাহতে বিশ্বাসী এবং নিজেকে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সঁপে দেওয়া' যেকোনো মানুষ আল্লাহর দৃষ্টিতে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য। ফলে, একজনকে আপনার দৃষ্টিতে হিন্দু, খ্রিস্টান বা ইহুদী মনে হলেও তিনি আল্লাহর নিকট ঈমানদার সৎকর্মশীল হয়ে উঠতে পারেন। 

মূল কথা, আল্লাহর অস্তিত্বের সঙ্গে কারো অংশীদার বিশ্বাস না করে কেউ যদি কারো ক্ষতি না করে বরং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য কল্যাণকামী হয় তাইলে সেই ব্যক্তি বরং আল্লাহর উত্তম প্রতিনিধি হওয়ার দৌড়ে অনেকের চেয়েই এগিয়ে যাবে যারা নিজেদের 'আল্লাহর বান্দা' বলে অপরের হক্ব নষ্ট করছে, ঘৃণা চাষাবাদ করছে, মিথ্যা বলছে, সুদ-ঘুষ খাচ্ছে, দুর্নীতি ও অসততা করছে। 


আইনস্টাইন নিজের স্বার্থে নির্মিত পশ্চিমা গডের রিলিজিয়নকে ক্রিটিক করে এর বিকল্প প্রস্তাবনা আনেন তাঁর 'মহাজাগতিক স্বভাবজাত ধর্ম' (Cosmic Religion) ভাবনায়।


আইনস্টাইনের মতে, সবারই আদিবিন্দু কী ছিল এটি জানতে মন চায়। কোথায় ছিলাম, কেন এলাম, কোথায় যাবো? কে আমাকে বানালো? কে মহাবিশ্ব বানালো? এসব প্রশ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে ধর্মীয় চিন্তা জাগ্রত হয় এবং এই কৌতূহলী চিন্তাই বিজ্ঞান, সমাজ, কলাকৌশল ইত্যাদিসহ আরো অনেক কিছুর উদ্ভব ঘটায়। এ প্রসঙ্গেই আইনস্টাইন সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন যার বাংলা করলে দাঁড়ায়:


ধর্মহীন বিজ্ঞান খোঁড়া, আর বিজ্ঞানহীন ধর্ম কানা (Science without religion is lame, religion without science is blind) 


[এ মন্তব্য "Ideas and Opinions" (৪১ - ৪৯ পৃষ্ঠা) এ আছে। Science and Religion নিবন্ধ এর প্রথম অংশ Princeton Theological Seminary তে ১৯৩৯ এর ১৯ মে বলেন। এটা ১৯৫০ সালে লিখিত "Out of My Later Years" এ ও প্রকাশ হয়। এই বইটি পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন আইনস্টাইন ছিলেন আস্তো একজন জায়নবাদী এবং আজকের অবৈধ ইসরায়েলের জন্ম নেওয়ার অন্যতম তাত্ত্বিক গুরু]।


আইনস্টাইন মনে করতেন, একজন গবেষক বা বিজ্ঞানী যে অগণিতবার ব্যর্থ হয়েও লেগে থাকে একটি লক্ষ্যে (Purpose) এবং অবিচল থেকে বারবার কাজ করে যায় এটি অকারণে হওয়ার নয়। এর পিছনে মহাজাগতিক ধর্মের (Cosmic Religion) শক্তি কাজ করে। মানুষের মধ্যে জানার তাড়না দেয় ধর্মচিন্তা। আইনস্টাইনের ভাষায়:


Only one who has devoted his life to similar ends can have a vivid realization of what has inspired these men and given them the strength to remain true to their purpose in spite of countless failures. It is cosmic religious feeling that gives a man such strength. (১৯৫৪)


এই লাইনের পরেই একজন সমসাময়িক পণ্ডিতের একটি উক্তি আইনস্টাইন উল্লেখ করেন (যদিও সমসাময়িক বলার পরেও নাম উল্লেখ না করা আইন্সটাইনের সংকীর্ণতা বলে আমি মনে করি। যেমন, আমার সমসাময়িক এনথ্রোপলজির রাকিব ভাই, বা প্রত্নতত্ত্বের সলিম অর্ণব ভাই, বা সাহিত্যের জামিল ভাই এর কোনো উক্তি ব্যবহার করলে আমি তাদের নাম ধরেই বলবো) যার মর্মার্থ, দুনিয়াকেন্দ্রীক বস্তুবাদী এ যুগে বিজ্ঞানসম্মত কাজকারবারের সঙ্গে যারা যুক্ত তারাই আসলে গভীরভাবে ধার্মিক। আইনস্টাইনের কথায়:


A contemporary has said, not unjustly, that in this materialistic age of ours the serious scientific workers are the only profoundly religious people. (১৯৫৪)


একটি জিনিস মাথায় রাখবেন আইন্সটাইন 'Scientific Workers' লিখেছেন, 'Scientists' নয়। এ শব্দটি পরবর্তীকালে যারা প্রবর্তন করেছেন তারা হয় শর্টকাট করেছেন আর না হয় ''Worker" এর সঙ্গে ''Communism/Socialism'' যুক্ত বলে একে সরিয়েছেন। আবার, বিজ্ঞানকর্মী/শ্রমিক যেভাবে সরল শোনায়, সাধারণের মনে হয় ''Scientist/বিজ্ঞানী'' ততোটাই গম্ভীর ও এলিট বলেই 'Scientific Worker' বেশ দ্রুতই ''Scientist" এ রূপান্তরিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের 'রয়্যালের' প্রতি আকর্ষণ আমরা নানা সংস্থা, ক্লাব বা জার্নালের থেকেই জানতে পারবো যেমন--রয়্যাল একাডেমি অব সায়েন্স। এই রাজকীয় হওয়ার থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই আইনস্টাইন হয়তো 'Scientific Workers' ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তী সময়ের উচ্চমার্গীয় হওয়ার ভাবনার কাছে পরাজিত হয়। 


আগের কথায় ফিরে আসি। বিজ্ঞানশ্রমিক বা বিজ্ঞানকর্মী হলে আপনি যেকোনো কিছুকে পরীক্ষা, নিরীক্ষা করে তবেই বিশ্বাস করবেন। আপনি যদি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ধর্মের ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন তবে আপনিও আইনস্টাইনের মতে 'বিজ্ঞানশ্রমিক/কর্মী'। আবার, আপনি যদি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মহাবিশ্বের উৎপত্তি তালাশ করেন তাইলেও আপনি বিজ্ঞানকর্মী। মানে ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে বললে যা 'বিজ্ঞানী' হয় আর কী!


এ কারণে খ্রিস্টান ও ইহুদি মোল্লাদের আইনস্টাইন মোল্লাতন্ত্রের ধারক-বাহকের অধিক হয়ে উঠার তাগাদা দেন। তিনি বলেন, তাদের মূলত শিক্ষক হওয়া উচিত। শিক্ষক কী করেন? শিক্ষক নিজে প্রশ্ন করেন এবং অন্যদের প্রশ্ন করতে আগ্রহী ও উৎসাহী করে তোলেন। আইনস্টাইনের মুখের কথাটি হুবহু তুলে দিলাম:


I believe that the priest must become a teacher if he wishes to do justice to his lofty educational mission. (১৯৫৪)


এর এক লাইন আগে ধর্মের নানা তত্ত্ব, গূঢ় রহস্য বিজ্ঞানের দ্বারা যাচাই ও নিরীক্ষিত হওয়ার দারুন সম্ভাবনার কথা বলেন আইন্সটাইন। এ যুগে ঘৃণাজীবী বিজ্ঞানমনা বা বিজ্ঞানবাদী বা বিজ্ঞানান্ধরা যেভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মুখোমুখি করে আইনস্টাইন তাদের বোল্ড আউট করে বলেন:


And so it seems to me that science not only purifies the religious impulse of the dross of its anthropomorphism but also contributes to a religious spiritualization of our understanding of life. (১৯৫৪)


এর সোজা বাংলা হচ্ছে, বিজ্ঞান কেবল মানুষের ব্যক্তিগত সংকীর্ণতার মানদণ্ডে আরোপিত ধর্মের নামে থাকা আবর্জনানুভূতি বিশুদ্ধ করে না, আমাদের জীবনের ধর্মীয় আধ্যাত্মকে অনুধাবন করতেও অবদান রাখে। 


ধর্মের নামে লুকায়িত এই 'আবর্জনা' আইন্সটাইন খ্রিস্টান-ইহুদী ধর্মের প্রেক্ষাপটে (যেমন--খ্রিস্টানরা সব পাপ যিশু বহন করবে এবং ইহুদিরা তারাই গডের ভালোবাসার একমাত্র পাত্র বলে বিশ্বাস করা) উল্লেখ করেন। 


আইনস্টাইন অবশ্য বিজ্ঞানের মাধ্যমে আসা জীবনবিধ্বংসী মহাআবর্জনা কীভাবে বিশুদ্ধ হবে তা বলেননি। কারণ, বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত 'পারমাণবিক বোমা' যা জাপানে লক্ষ মানুষ হত্যা করে, যার ঘানি আজো হিরোশিমা নাগাসাকি টানছে--এর পিছনে একটু হলেও তার অবদান আছে। 


বিশ্বযুদ্ধগুলো এতো ভয়াবহ তো বিজ্ঞানেরই কল্যাণে। অসভ্য ইউরোপীয়দের বর্বর উপনিবেশ যা গোটা পৃথিবীর মানচিত্র, আবহাওয়া, নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতি, অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছে তার পিছনে ইউরোপীয় বিজ্ঞাননির্ভর চেরাগীপনা (Enlightenment) কাজ করেছে। এসব বিজ্ঞানের অবিশ্বাসী আবেগহীন আবর্জনা (Scientific impulse of the dross of its  non-believing emotionless reasoning), যা নিয়ে আইনস্টাইন বা বিজ্ঞানপূজারি এ যুগের কেউও আলাপ করবে না। 


ইসলাম বা বৌদ্ধ ধর্ম এ ক্ষেত্রে সাম্যবাদী বয়ান আনে যা দিয়ে ধ্বংসাত্মক বিজ্ঞানকেও (নিউক্লিয়ার বোমা, যুদ্ধবিমান, মিসাইল, জীবাণু অস্ত্র, জিএমও ইত্যাদি) বিশুদ্ধ করা যায়। গৌতম বুদ্ধ বলেন, অহিংসা পরম ধর্ম। জীবহত্যা মহাপাপ। ইসলাম বলে, আগে আক্রমণ করা যাবে না৷ একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য। ইসলাম বলে, গাছের পাতাও আল্লাহর জিকর করে এবং অকারণে একটি পাতাও ছেঁড়া যাবে না৷ ইসলাম বলে, আল্লাহ এক পরাক্রমশালী নবীর বিশাল বাহিনীকে থামিয়ে দিয়েছিলেন পিঁপড়ের জীবন বাঁচানোর জন্য। মুহাম্মদ (স) বলেন, আরবের ওপর অনারবের বা অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই ইত্যাদি। 


আইনস্টাইনের Religion and Science : Irreconcilable এ আসি। আইনস্টাইন মনে করেন, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সমঝোতা বিদ্যমান। প্রকৃত ধার্মিক ও প্রকৃত বিজ্ঞানকর্মী মূলত একই পক্ষের লোক। সমস্যা হয় অবিশুদ্ধ ধর্ম ও অশুদ্ধ বিজ্ঞানবাদীদের মধ্যে যারা ধর্ম বা বিজ্ঞানকে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। 


আইনস্টাইন এই নিবন্ধের বক্তব্য শেষ করেন পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত ওলন্দাজ নাগরিক ইহুদী দার্শনিক বারুছ স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) এর  Amor Dei Intellectualis এর কথা টেনে। এর অর্থ মানুষ যে বুদ্ধিবৃত্তিক তাড়না অনুভব করে জানতে ও অপরকে জানাতে সেটির পিছনে এক পরম শক্তি রয়েছে।  স্পিনোজা বলতেন, মানুষ স্রষ্টার কথা ভাবে মানেই স্রষ্টা আছেন (দেকার্তের মত করে)। যেহেতু যা দেখেনি, যার অভিজ্ঞতা নেই তা মানুষের জ্ঞানের আওতায় আসতে পারে না।


বিজ্ঞানকে যারা অধর্ম বা ধর্মহীনতার সপক্ষে ব্যবহার করতে চান তাদের উদ্দেশ্যকে একেবারে নিরাশ করে দিয়ে আইনস্টাইন বলেন: 


If this conviction had not been a strongly emotional one and if those searching for knowledge had not been inspired by Spinoza's Amor Dei Intellectualis, they wouid hardly have been capable of that untiring devotion which alone enables man to attain his greatest achievements (১৯৫৪)।


একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি আলাপের। যারা এত মনোযোগ দিয়ে পড়লেন ধন্যবাদ। আপনাদের  প্রশ্ন আসতে পারে আমার বিশ্বাস নিয়ে। বলছি।


আমি বিশ্বাসী মানুষ। বিশ্বাস এভিডেন্সনির্ভর হলে সেটি আর বিশ্বাস থাকে না। বিশ্বাস হয় শর্তহীন। আমি একেবারে শর্তহীন বিশ্বাস করি 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নাই। 


ব্যক্তিগতভাবে আমার এ বিশ্বাসকে আমি আরো সুদৃঢ় করি বিজ্ঞান বা যুক্তির সাহায্যে। আমি আজ পর্যন্ত আল্লাহর একটি নির্দেশ বা বাণী পাইনি যা বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বরং এমন অনেক কিছু পেয়েছি (সুরা তালাক, আয়াত-১২, আরো বাসযোগ্য পৃথিবী এবং সেখানেও আল্লাহর আয়াত নাজিল হওয়া) যা বিজ্ঞান আজো প্রমাণ করতে পারেনি, চেষ্টা করছে। এ জন্য আমার বিশ্বাস হালকা হয়না, বরং আমি মনে করি আরো ৫০-১০০ বছর পরের বিজ্ঞান এটি উদ্ভাবন করতে পারবে। 


আল্লাহ কোরানে অনেকবার চিন্তাশীলদের কথা বলেছেন। আমার বিশ্বাসের ভিত্তি এই কোরান এবং আমি কোরানে বর্ণিত 'সিরাতুল মুস্তাকিম' অনুসারে যাপন করতে চেষ্টা করি এবং নিজেকে একজন ক্ষুদ্র 'চিন্তাশীল' মনে করি। আলহামদুলিল্লাহ।

পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments