সর্বশেষ

মহানগর ২ এর গোঁজামিল || আশফাক নিপুনের ফাঁক

অবস্থা এমন দাঁড়াইছে যে, মহানগর দুই দেখে 'আমার ভালো লাগেনি' এইটাও বলা যাবে না! যা আমার চারপাশে ঘটছে তার কিছুটা পূর্ণ বা খণ্ডিত বা কিছুটা বিকৃতরূপে উপস্থাপন করলেই সেটি বাহবা কুড়াবে মেনে নিলাম, কিন্তু ভাই আপনার চোখে 'ভালো'কে আমার 'ভালো নাও লাগতে পারে' এটিও মেনে নিতে শেখেন।
মহানগর দুইয়ের পুরো গল্পটি দাঁড়িয়ে আছে একটি ঠুনকো চরিত্রের এনালগ বা বাটন ফোনের উপর। এই বাটন ফোনওয়ালা একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগের 'আইটি সেল' এ কাজ করেন৷ উনার নাম উত্তম কুমার। আইটি স্পেশালিস্ট। ধর্ষক ও গতরাতে ওসি হারুনের হাতে চড় খাওয়া বুর্জোয়া আফনান চৌধুরীর লোক তিনি! ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চে কাজ করা 'স্পেশালিস্ট'কে দিয়ে আশফাক ক্যামেরা ঠিক করানোর পাশাপাশি একজন ওসির হাতে থাপ্পড়ও খাওয়াইছেন! জব হায়ারার্কি না বুঝলে যেটি হয়!

যারা রাষ্ট্রকাঠামো সম্পর্কে জানেন তারা বুঝবেন, এটা বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে উদ্ভট ব্যাপার! যত বড় ব্যবসায়ী হোক ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর শক্তিশালী কেউ এদেশে বর্তমানে নাই, কোনো সময়ে ছিলোওনা। 

হ্যাঁ, ব্যবসায়ী কেউ রাজনীতিতে এলে সে শক্তিশালী হয়। কিন্তু 'সোনা কল্যাণ সমিতি' এর কেউ এই শক্তি পাবে কই? আমরা তো ধর্ষক সাফাতকে দেখেছি ধরা খেতে। মুনিয়ার কেইসটা এনে তার দুলাভাইকে নেতিবাচক কেন দেখালো বুঝলাম না! আরফান এতো বড় ধনীর দুলাল যে গাড়ি নিয়ে একা বের হবে রাতে? কী আর বলবো ফাঁক ভাইয়ের নিপুণতায়!

ওসি হারুনকে দিয়ে গোয়েন্দা সেলের 'প্রভাব ও পাওয়ার'কে প্রকাশ করা আশফাক নিপন স্পাইওয়ার টেকনোলজিকে ইঙ্গিত করছেন অথচ এই টেকনোলজি যে নির্দিষ্ট এলাকায় থাকা সমস্ত ফোনের কথোপকথন রেকর্ড করতে পারে এটি তিনি এড়িয়ে গেছেন!

গোয়েন্দা অফিসটি ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ, এনএসআই, র‍্যাব, আর্মি যাদের হোক--সেখানের নিরাপত্তায় এতো ফাঁক আশফাক বের করছেন যে, আইটি সেলের সনাতনধর্মী ভদ্রলোক ইন্টারোগেশন সেলে ওসি হারুনের সঙ্গে সন্দেহভাজন আলাপ করলেও তাকে গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসা করে না! এটা সম্ভব কেবল আশফাকের ফাঁকভরা মগজে।

অথচ, এই গোয়েন্দা সেলের পুরোটাই রেকর্ডেড হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। আইটি সেলের উত্তম কুমার তো সিসিটিভির 'ক্যাম ওয়ান' ঠিক করতেই আসলো। তো তার সঙ্গে আলাপটি ফজলুর রহমান বাবু দেখবেন না? এমনিতে তার গোয়েন্দা চরিত্র হয়নি, এর মধ্যে এই গোঁজামিল! 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওসি হারুনকে হেঁটে বেড়াতে দেয়, সিগারেট খেতে দেয় এমন কী নিয়মিত বাথরুমে যেতে দেয়। ঘনঘন যায়! ওয়াশরুমে যাওয়া আইটি কর্মকর্তার ফোনে বাইরে আলাপ করে হারুন, আর দুর্ধর্ষ গোয়েন্দারা কিছুই টের পায় না! 

অথচ খুবই নিম্নমানের অফিসারও এ সময় হারুনকে ছেড়ে দিয়ে কাদের সঙ্গে আলাপ করে সেটি অবজার্ভ করবে, আর খোদ গোয়েন্দা দপ্তরে বসে আশফাক নিপুনের নিপুণতায় একজন ওসি হারুন গোয়েন্দাদের পরাজিত করে গোয়েন্দা অফিসে বসেই! যে গোয়েন্দা এম্পির সঙ্গে নায়িকার কথা ট্রাক করে সে ওসি হারুনকে ট্রাক করে না! আরে বাহ! এ দেখে আমার হাত তালি দিতে হবে!

মার্কিন এনএসএ এর হুইসেল ব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেনকে নিয়ে সিনেমা 'স্নোডেন' দেখবেন। গোয়েন্দাদের প্রত্যেকেরই শরীরে চেক করতে হয়। আর এই ভদ্রলোক উত্তম কুমার পকেটে আলাদা ফোন নিয়ে নিয়মিত কথা বলে--এটা আশফাকের ফাঁকে সম্ভব! 

'চালাক আশফাক' নিজের ফাঁককে ঢেকে বাটন ফোনের ওপর দাঁড়িয়ে দর্শকদের বোকা বানিয়ে 'থ্রিলে ভরপুর' বাহবা কুড়াচ্ছেন! তাতে আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু এতো 'ওভাররেটেড' যে কিছু না বলে পারলাম না!

আপনি গতরাতে জয়নালের মাধ্যমে সন্ত্রাসী মাসুমকে এনে একেবারে ফিট করে রাখলেন নিজে গোয়েন্দাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে? এতো সহজ? তাও গোয়েন্দা অফিসে বসেই? ফানি!

অন্যদিকে সাবেক কাউন্সিলর মকবুলকে চড় মেরে বসলেন? ক্রাইম রিপোর্টারকে তাড়াচ্ছিলেন! এদের সঙ্গে ডিল করার সময় পুলিশ এভাবে ব্যবহার করে? নাহ! সাংবাদিক ঐরকম জোকারি করে তথ্য নেয়না। আশফাক সাংবাদিকতায় পড়া গ্রাজুয়েট বা দীর্ঘদিন সুনামের সঙ্গে সাংবাদিকতা কারো সঙ্গে মিশলে এমন হতো না। আর হ্যাঁ, ক্রাইম রিপোর্টাররা যে বাস্তবের আফনান চৌধুরীকে ফুল দেয়, তার গেস্ট হয়, প্রমদ ভ্রমণে যায় সেটি তো আনলেন না। কেন?

এ সিরিজের সমকালীন 'পলিটিক্যাল ক্যামিও' নিশ্চয়ই অনেকের আইডিওলজি বা রাজনৈতিক অবস্থানকে সমর্থন বা বিরোধিতা করতে পারে। সেটি করেছেও।

হাজতে মাসুমের ক্রন্দন, তার বোনের অসহায় আহাজারিসহ কিছু উপাদান ভেতরেই আছে যেটি অনেককেই ইমোশনালি ট্রিগারড করতে পারে। এটা মেকিং এর সঙ্গে জড়িত না। এ ধরনের কনটেন্ট এখন মূলধারায় নেই এ জন্যই এটি হাততালি পাচ্ছে।

'ক্যাথার্টিক এন্টারটেইনমেন্টের' যথেষ্ট চরিত্র, সংলাপ, বা কনটেক্সট এখানে আছে৷ নিপুন যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে হাত দিলে এর চেয়ে ভালো কাজ বের হওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটি আর তেমন কেউ মনে হয় করছে না। এ কারণে নিপুনের ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু সব কিছুর শেষে আমার মনে হচ্ছে, মহানগর এর প্রথম মৌসুমের মতই আশফাক দ্বিতীয়টিতেও ওসি হারুনের প্রতি অতিরিক্ত সিমপ্যাথেটিক। অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আশফাক বলতে চান, ওসি হারুনদের ভেতরে ভূত তাড়ানোর প্রাথমিক প্রেরণা থাকলেও একটি সময় নিজেই ভূত হয়ে যায়। এ মতের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না। আমিও দ্বিমত।

'পাওয়ার স্ট্রাকচার' ও ক্ষমতার ব্যবহার যদি ভালো করে কেউ বোঝেন তবে এটা বুঝবেন, আশফাক ওসি হারুনদের যতোটা অন্যের হাতের খেলনা বলতে চাচ্ছেন বাস্তবে অনেকক্ষেত্রেই তা নয়। ওসি হারুনদের কর্মের স্বাধীনতা বা 'ফ্রি উইল' কেড়ে নিয়ে তাদের দিয়ে থ্রিলার বানালে সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে সত্যটা চাপা পড়ে যায় এতে। 

ঐ যে ওসি হারুন যে বলে, সব সত্য সত্য নয়, সেটা আর কী! ওসি হারুনরা ও এসআই দিপুরা নিজেদের ইচ্ছায় বা আগ্রহেও অনেক কর্ম করেন--এই সত্যটি আশফাকের ফাঁকের কারণে ধরা পড়ছেনা এ সিরিজে। কিন্তু এই সত্য জারি থাকা জরুরি। প্রত্যেকের কর্মের ভার তার। কেবল 'হুকুমের গোলাম' বলে অপরের সমস্ত অন্যায় হুকুম পালন করার দায় কিন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নেই। এ বিষয়ে আইনও আছে দেশে।

আশফাক নিপুন যেটি করছেন সেটি হচ্ছে আপনার চারপাশে ঘোরা ঘটনা, প্রতিঘটনা, সত্য, অর্ধসত্য, গুজব, কানকথা, ফেসবুকের লেখা, ইউটিউবের ভিডিও ইত্যাদি থেকে কিছু বিষয়, চরিত্র, সংলাপ তুলে নিয়ে নতুন মোড়কে উপস্থাপন করছেন৷ এ কারণে এই মুহূর্তে অনেকেই 'থ্রিলড' হচ্ছেন। 

'অভ্যর্থনা' বানান ভুল করছেন এ তুচ্ছ কাজ নিয়ে আলাপ নেই! 

ইন্ট্রোতে ' স্বৈরাচার নিপাত.. ' দেখা গেলো; ভেতরে 'রাতের ভোট', 'এম্বাসি','ক্রশফায়ার অভিযান'  ইত্যাদি সংবেদনশীল বিষয় এসেছে বলে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন, অনেকে প্রতিবাদও করছেন! আমি এসবে না গিয়ে ওয়েব সিরিজের কাহিনী নিয়ে ভাবছি। এ দিকে না গেলাম। কেন না গেলাম সেটি অন্য সময়ে লিখবো।

আমি অবশ্য পুরো সিরিজে মলয়কে খুঁজেছি। আর অবাক হইছি যে, থানা থেকে কিছু সময় আগে গ্রেফতার হওয়া ওসি পোশাক পরা অবস্থায় থানায় না গিয়ে কীভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে বৃন্দাবন দাসের গুলিটা খায়? সেই ডিবি কর্মকর্তা সুকুমার বড়ুয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী মাসুমকে ধরে আবার মেয়র মহোদয়ার বাড়ির সামনে এনে দাঁত বের করে থাকে তাকে দেখাতে! ভাবা যায়?

দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এখানে সনাতন ধর্মের। সুকুমার বড়ুয়া আর উত্তম কুমার। দুইজনকেই আশফাক নিপুন 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এর আগে রাশেদা খানমের ওপর বোমা হামলায় একজনের নাম আসলে 'মাইনোরিটি' বলে ওসি হারুন। মাইনোরিটির পোলিটিক্যাল ইকোনমি বুঝেই তবে আশফাক এ দুটি চরিত্র তৈরি করেছেন? এটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা!

আশফাকের আরেকটি ফাঁক শোনেন৷ ওসি হারুন শাখারিপুর থানায় কাজ করেন। সেই জায়গায় সরকারি দলের দুইটা স্ট্রং পলিটিক্যাল অপনেন্ট রয়েছে। রজব আলীর দলে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী 'আব্দুল্লাহ মাসুম'। আর রাশেদা সারাক্ষণ তাকে চ্যালেঞ্জ করে। হকারদের পুনর্বাসন, 'খ্যালা হবে' ইত্যাদি সংলাপে বোঝা যায় এখানে 'নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াত আইভি বনাম শামিম ওসমান' এর দ্বন্দ্বটিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

যেটি বলছিলাম। এমন একটি সংবেদনশীল এলাকার ওসি হারুন।  সেই এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী 'মাসুম'। তাকে চিনবে না ওসি হারুন? সন্ত্রাসী মাসুম একবারও কি তার পৃষ্ঠপোষক 'বড় ভাই'য়ের সঙ্গে আসেনি ওসি হারুনের নিকট? কিংবা, এতো সাম্প্রতিক ঘটনা অথচ ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে জানাবেনা নিরীহ মাসুমের বোন? পুরো সিরিজে অবশ্য সোস্যাল মিডিয়ার কিছুই দেখলাম না!

বাস্তবজ্ঞান যার আছে সে জানবে একজন ওসি যে এলাকায় যায় সেই এলাকার সমস্ত ইতিবাচক-নেতিবাচক 'হাইপ্রফাইল' চরিত্রের ব্যাপারে তার জানাশোনা থাকে, সে চেষ্টা করে জানতে। অথচ শেষ কর্মদিবসেও এম্পির ক্যাডারকে চিনলোনা ওসি হারুন! এই ফাঁক দিয়ে কীভাবে খ্যালা হওয়াবেন আশফাক?

একটাই উপায়, নতুন কোনো গোঁজামিল হাতে এনে কিছু পলিটিক্যাল ক্যামিও মেশাবেন এই তো? মেশান যদি একটি পরামর্শ থাকলো, ওসি হারুনের পরিবারকে দেখাইয়েন। ভদ্রলোক বিপদে পড়ে বৌকে একটা ফোন দিলোনা, দিলো ডিবির সুকুমারকে যে আবার শেষে ওসি হারুনকেই মেরে দিলো😁 গাঞ্জামিল আর কী!

দুই বছর আগের শাখারিপুরের সরকার দলীয় এম্পির প্রিয়ভাজন মাসুমকে কোতোয়ালি থানার ওসি এখনো খোঁজে? এক থানার ইস্যু অন্য থানায় এইভাবে মনে রাখে? তাও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে? রাশেদা মাসুমের তথ্য দিলো সেই মাসুমের ছবি ছাড়া দিপু এসআই একজনকে এনে দিলো আর কাজ শেষ? এম্পির প্রিয় টিটু আসে নিয়মিত, তারা যদি মাসুমকে সেইভ করতে আরেক মাসুমকে সেট করে তাইলে ওসি হারুনের 'গুড-সাইড' তা ধরতে সক্ষম হলো না কেন? সিসিটিভিতেও মিললোনা? এতো গোঁজামিল কেমনে সম্ভব?

আশফাক নিপুন, আমাদের মত সিনেমা-নাটকপ্রেমীদের নিকট থেকে প্রশংসা পেতে আরো চিন্তা করতে হবে; আরো মেধা খাটাতে হবে। এভাবে 'খ্যালা হবে' না। 
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments