ধ্যান, সিয়ামের অন্যজগতে যাত্রা ও আমার ভাবনা
®®®
জাবির ৪৫ তম আবর্তনের সিয়াম গতকাল ৪ এপ্রিল ভোর রাত ৪:২৫ মিনিটে (সিয়াম ৩ এপ্রিল লিখেছে) 'ডেথ নোট' স্ট্যাটাস আকারে লিখে নিজেকে হ%ত্যা করেছে!
সে বলতে চেয়েছে যা তা হলো--দেহ আর আত্মা দুটি আলাদা জিনিস। আত্মা অনন্তসত্তার সঙ্গে মিশে গেলে সেটিই জীবনের প্রাপ্তি। এ লক্ষ্যে সে ঐদিকে চলে গেছে!
তার আধ্যাত্মিকতা সাধনা আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হলো এ কারণে যে, স্বার্থপরের মত দেহত্যাগ করে অসীমের সঙ্গে মিলতে চাওয়া যে অপরাধ সে এটি অনুধাবন করতে পারেনি। ফিজিক্সে পড়া সিয়াম তার মেটাফিজিক্যাল ডেস্টিনেশনের খোঁজ করছিল। কিন্তু সেই গন্তব্য পেতে যে ধৈর্য ধরতে হয়, পরিণত হতে হয় সেই বোধটুকু তার পূর্ণ ছিলোনা অথবা তার পারিপার্শ্বিকতা সে সুযোগ দেয়নি তাকে।
খোঁজ নিলাম তার সম্পর্কে। জানলাম, ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যস্ত ছিল সে। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র সিয়াম পড়াশোনায় অমনোযোগী (অথবা শিক্ষকদের অবহেলায় ঝরে যাওয়া) হওয়ায় বারবার অনুত্তীর্ণ হচ্ছিল। পারিবারিক সংকট ছিল। এর মধ্যে বিভাগের শিক্ষকরা কোনোদিন নাকি ডেকে খোঁজখবরও নিতো না। যত্ন না নিয়ে নিষ্ঠুরতা করে অকৃতকার্য করার মধ্যে তারা তৃপ্তি পেতেন!
এ রকম পরিস্থিতিতে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে! সিয়ামও হয়েছিল। আর তার অসহায়ত্বের থেকে মুক্তির পথ খুঁজতেই সে বইটই পড়ছিল। ভালো-মন্দ (যেমন-সদগুরু একজন বিতর্কিত লোক) বই পড়ে ধ্যান-জ্ঞান করে আত্মা, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে অসম্পূর্ণ ধারণা জন্ম নেয় তার ভেতর। তাই মৃত্যুটাকেই তার সমাধান মনে হয়।
২।
আমি ওর ফেসবুক প্রফাইল ঘাঁটলাম। সিয়াম অনলাইনে দাবা খেলতো। তার আইডির নাম 'লুসিফার আনলকড' ও 'লুসিফার ২৫১০'। এ থেকে বোঝা যায়, লুসিফার বা ইবলিশের প্রতি তার কোনো কারণে মোহ তৈরি হয়েছিল। এটি হতে পারে নানা কারণে। পপুলার সিনেমা, বই, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি যেকোনো কিছু মানুষকে তার বদ্ধ বিশ্বাস থেকে দূরে নিতে পারে। উদাহরণ দিচ্ছি।
নেটফ্লিক্সে 'লুসিফার' শীর্ষক একটি সিরিজ আছে। ভীষণ আকর্ষণীয়। আপনি দেখলে নেশা লাগবে আর খুব বেশি বুদ্ধিমান ও সচেতন না হলে লুসিফারকে আপনার ভালো লেগে যাবে। মনে হবে, লুসিফার এক মহান সৃষ্টি। তাকে আমরা ভুল বুঝেছি। আমি খুব ছোটবেলা থেকে সামগ্রিক চিন্তায় সক্ষম হওয়ার পরও 'লুসিফার' এর পার্স্পেকটিভ আমাকে ভাবিয়েছিল। এখন ধরুন, যার ডিপ নলেজ ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি নেই, কম্পারেটিভ রিলিজিয়াস স্টাডি নাই, ফিলোসফি, আর্গুমেন্ট, ডিস্কোর্স, স্যাটানিজম নিয়ে জানা নেই সে তো লুসিফারকে 'গুড ক্যারেক্টার'ই ভাববে, না?
আপনার ক্রিটিকাল রিডিং এবিলিটি না থাকলে আর্টিস্ট বা পরিচালক বা লেখকের প্রোপাগাণ্ডার বলী হয়ে যাবেন আপনি। আমার মনে হয়, সিয়াম ঠিক এভাবেই 'লুসিফার গ্যাং' দ্বারা আক্রান্ত হয়। সে লুসিফার দেখে, স্যাটানিস্টদের বই পড়ে, ইন্টারনেটে ঘাঁটে!
তার আশেপাশে যারা ছিল তাদের সিয়ামের আইডিওলজি চ্যালেঞ্জ করে তার সঙ্গে তর্ক বিতর্ক জারি রাখলে 'লুসিফার' জিততে পারতো না। এর আগে একটি মেয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে নিজেকে শেষ করেছিল।
মেয়েটি লুসিফার, একচোখা দাজ্জাল এসবের ছবি আঁকতো! তার আশেপাশে এ নিয়ে কথা বলার কেউ ছিলো না! সেও সিয়ামের মত চলে গিয়েছিল। এ কারণেই আমি আলাপ-বিতর্ক জারি রাখার পক্ষে।
৩।
মীর মশাররফ হোসেন হলে এর আগে আমাদের ৪১ তম আবর্তনের এক শিক্ষার্থী মারা গেছে! তার অনেক আগে জাবির কোনো এক ছাত্রকবি মনে হয় কবিতায় মৃত্যুর তারিখ লিখে সেই নির্ধারিত দিন (না, রাত?) মারা যায় বলে কথিত আছে!
মীর মশাররফ হোসেন হলের সিংগেল রুমগুলো ভেঙে ফেলার দরকার নেই। এই রুমগুলোও দুইজনের করে ফেলা জরুরি। এতে আলোচনা হয়। মানুষ ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকর চিন্তা-ভাবনা বা ইবলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ কমে যায়। এটি প্রশাসন ভাবতে পারে। সিট সংকট দূর হলো, আবার সঙ্গীও থাকলো।
৪।
সিয়ামের লেখা 'ডেথ নোট' নিঃসন্দেহে অভিনব ও চমকপ্রদ। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা চাট্টিখানি কথা নয়।
কিন্তু ধ্যান করে অন্য জগৎ, অন্য মাত্রা বা অসীমের সন্ধান পেলে সেটি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর কল্যাণে কাজে না লাগিয়ে কেবল নিজে সেই সত্তার সঙ্গে মিশতে চাওয়া স্বার্থপরতা। স্বার্থপরতার সঙ্গে অসীমের সম্পর্ক থাকতে পারে না।
বিশেষ করে সিয়ামের এই জগতে আসার দ্বার তার মা (ও বাবা), তাদেরকে কষ্ট দিয়ে পরমসত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে সেই সাক্ষাৎ যে পরম গ্রহণ করে সে আল্লাহ বা পরমেশ্বর নন, সেটা লুসিফার বা সমজাতীয় কিছু হতে পারে!
ধ্যানে মানবের মুক্তির বার্তা মুহাম্মদ (স) ও বুদ্ধ এনেছিলেন। তারা মানুষের মুক্তির বাণী দিয়েছেন, অন্যদের শিখিয়েছেন। সিয়াম ধ্যানে কিছু পেলে তা এভাবে ডেস্ট্রয় করা আধ্যাত্মবাদ নয়, স্যাটানিক এপ্রোচ সেটি--তবে আমি নিশ্চিত সিয়াম সে বিষয়ে জ্ঞাত ছিলো না।
আজো খাঁটি মুর্শিদ, পীর-ফকির, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই ধ্যান গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চালু রেখেছেন। ধ্যানকে 'দেহতত্ত্ব' এর মাধ্যমে বিকৃত করে পপুলার কালচারে উপস্থাপন করলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে তা অনেক ঊর্ধ্বে। ধ্যানের বাণিজ্যিক যে রূপ দেখা যাচ্ছে 'সেমিনার বা নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টরি বা নানা ফাউন্ডেশনের নামে' তা প্রকৃত অর্থে মৌলিক ধ্যান নয়। ধ্যান মানেই একলা--নির্জন। ধ্যান-তপস্যা কখনো লোকদেখানো বা জনসভায় হওয়া সম্ভব না।
৫।
মওলানা রুমি বলতেন, অসীম-মহাবিশ্ব তো আমারই মধ্যে। মহান আল্লাহ বলেন, আমি এতো বড় যে মহাবিশ্বে আমাকে ধরবেনা কিন্তু বিশ্বাসীর হৃদয়ে আমার স্থান হয়। এগুলো হাইলি ফিলোসফিক্যাল থট। সাধারণ লোকে এমন কী ওয়াহাবি গোঁড়া মুন্সিরাও এসব ইন্ডেপথ ভাবতে পারে না। এ কারণে মুসলমান সমাজ থেকে ধ্যান প্রায় উঠে গেছে।
ধ্যান যে সুন্নত, ধ্যান যে মুক্তির পূর্বশর্ত এটিই ভুলে গেছে লোকে। তাই 'যোগ' দেখে অনেকে এতে আগ্রহী হচ্ছে। তাতে সমস্যা নেই। উদ্দেশ্য সৎ রেখে হালাল খেয়ে বৈধ পথে যে কেউ স্রষ্টাকে খুঁজতে পারে। এ খোঁজায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা থাকলে তাতে বিচ্যুতির সম্ভাবনা কমে যায়। সিয়ামের গুরু ছিলো কেউ? জানা নেই।
৬।
আমাদের এক মামা ছিলেন। জরিয়া মামা। পেশায় কবিরাজ ছিলেন। তিনি পানির উপরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে পারতেন। মনে হতো মরা লাশ ভাসছে। তার একটা পা আরেকটা পায়ের উপর থাকতো, হাত বুকের ওপর, সোজা হয়ে তিনি ভেসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিজের শরীরকে তিনি ওজনহীন করতে পারতেন। অবাক বিস্ময়ে আমরা তাকিয়ে থাকতাম! আমি বলতাম,আমাকে শেখান। তিনি বলতেন, আচ্ছা শিখো। পরে আমি ঢাকা থাকতে একদিন তিনি মারা গেলেন! আমার জীবনে তাঁর মৃত্যু গভীর ক্ষত তৈরি করে যে এই সাধনা আমি কেন শিখে রাখলাম না!
তখন মোবাইল ফোন থাকলে তিনি ভাইরাল হতেন এবং সদগুরুর চেয়ে অধিক ভক্ত জুটতো তার এটি নিশ্চিত। এমনিতেই তাকে সম্মান করে 'ঠাকুর' বলে ডাকতো সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সে তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে তার পরম ভক্ত অনুসারী ছিলো কম। কট্টরপন্থীদের কারণে মুসলমানদের মধ্যে আধ্যাত্মিক সাধনা হ্রাস পেয়েছে!
৭।
জরিয়া মামা সাধনা করে কিছু পেয়েছিলেন। তিনি গাছ-গাছড়া দিয়ে মানুষের চিকিৎসা করে ভালো করতেন। ঝাঁড়-ফুঁক থেকে ভেষজ চিকিৎসাকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। অন্যদিকে সিয়ামও সাধনা করে কিছু পাওয়ার দাবি করলো, অথচ সে নিজেকে ধ্বংস করে বাকিদের বঞ্চিত করলো তার জ্ঞানের থেকে!
এ ঘটনা এ জন্য বললাম যে, কার ভেতর কী আছে আমরা কেউ জানিনা। আমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের প্রতি আমাদের আরো দরদভরা চোখে তাকানো উচিত। কারণ, কে জানে ওর মধ্যে জরিয়া বা সিয়াম আছে কী না! জরিয়া থাকলে আমাদের সবার জন্য কল্যাণ, আর সিয়াম থাকলে তাকে রক্ষা করার দায়ও আমাদের।
সবার ওপর শান্তির বর্ষণ হোক।
###
সম্পাদন করে সর্বশেষ লেখাটি এমন দাঁড়িয়েছে।
ধ্যান, সিয়ামের অন্যজগতে যাত্রা ও আমার ভাবনা
®®®
জাবির ৪৫ তম আবর্তনের সিয়াম গতকাল ৪ এপ্রিল ভোর রাত ৪:২৫ মিনিটে (সিয়াম ৩ এপ্রিল লিখেছে) 'ডেথ নোট' স্ট্যাটাস আকারে লিখে নিজেকে হ%ত্যা করেছে!
সে বলতে চেয়েছে যা তা হলো--দেহ আর আত্মা দুটি আলাদা জিনিস। আত্মা অনন্তসত্তার সঙ্গে মিশে গেলে সেটিই জীবনের প্রাপ্তি। এ লক্ষ্যে সে ঐদিকে চলে গেছে!
তার আধ্যাত্মিকতা সাধনা আমার কাছে অসম্পূর্ণ মনে হলো এ কারণে যে, স্বার্থপরের মত দেহত্যাগ করে অসীমের সঙ্গে মিলতে চাওয়া যে অপরাধ সে এটি অনুধাবন করতে পারেনি। ফিজিক্সে পড়া সিয়াম তার মেটাফিজিক্যাল ডেস্টিনেশনের খোঁজ করছিল। কিন্তু সেই গন্তব্য পেতে যে ধৈর্য ধরতে হয়, পরিণত হতে হয় সেই বোধটুকু তার পূর্ণ ছিলোনা অথবা তার পারিপার্শ্বিকতা সে সুযোগ দেয়নি তাকে।
খোঁজ নিলাম তার সম্পর্কে। জানলাম, ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যস্ত ছিল সে। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র সিয়াম পড়াশোনায় অমনোযোগী (অথবা শিক্ষকদের অবহেলায় ঝরে যাওয়া) হওয়ায় বারবার অনুত্তীর্ণ হচ্ছিল। পারিবারিক সংকট ছিল। এর মধ্যে বিভাগের শিক্ষকরা কোনোদিন নাকি ডেকে খোঁজখবরও নিতো না। যত্ন না নিয়ে নিষ্ঠুরতা করে অকৃতকার্য করার মধ্যে তারা তৃপ্তি পেতেন!
এ রকম পরিস্থিতিতে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে! সিয়ামও হয়েছিল। আর তার অসহায়ত্বের থেকে মুক্তির পথ খুঁজতেই সে বইটই পড়ছিল। ভালো-মন্দ (যেমন-সদগুরু একজন বিতর্কিত লোক) বই পড়ে ধ্যান-জ্ঞান করে আত্মা, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে অসম্পূর্ণ ধারণা জন্ম নেয় তার ভেতর। তাই মৃত্যুটাকেই তার সমাধান মনে হয়।
২।
আমি ওর ফেসবুক প্রফাইল ঘাঁটলাম। সিয়াম অনলাইনে দাবা খেলতো। তার আইডির নাম 'লুসিফার আনলকড' ও 'লুসিফার ২৫১০'। এ থেকে বোঝা যায়, লুসিফার বা ইবলিশের প্রতি তার কোনো কারণে মোহ তৈরি হয়েছিল। এটি হতে পারে নানা কারণে। পপুলার সিনেমা, বই, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি যেকোনো কিছু মানুষকে তার বদ্ধ বিশ্বাস থেকে দূরে নিতে পারে। উদাহরণ দিচ্ছি।
নেটফ্লিক্সে 'লুসিফার' শীর্ষক একটি সিরিজ আছে। ভীষণ আকর্ষণীয়। আপনি দেখলে নেশা লাগবে আর খুব বেশি বুদ্ধিমান ও সচেতন না হলে লুসিফারকে আপনার ভালো লেগে যাবে। মনে হবে, লুসিফার এক মহান সৃষ্টি। তাকে আমরা ভুল বুঝেছি। আমি খুব ছোটবেলা থেকে সামগ্রিক চিন্তায় সক্ষম হওয়ার পরও 'লুসিফার' এর পার্স্পেকটিভ আমাকে ভাবিয়েছিল। এখন ধরুন, যার ডিপ নলেজ ও ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি নেই, কম্পারেটিভ রিলিজিয়াস স্টাডি নাই, ফিলোসফি, আর্গুমেন্ট, ডিস্কোর্স, স্যাটানিজম নিয়ে জানা নেই সে তো লুসিফারকে 'গুড ক্যারেক্টার'ই ভাববে, না?
আপনার ক্রিটিকাল রিডিং এবিলিটি না থাকলে আর্টিস্ট বা পরিচালক বা লেখকের প্রোপাগাণ্ডার বলী হয়ে যাবেন আপনি। আমার মনে হয়, সিয়াম ঠিক এভাবেই 'লুসিফার গ্যাং' দ্বারা আক্রান্ত হয়। সে লুসিফার দেখে, স্যাটানিস্টদের বই পড়ে, ইন্টারনেটে ঘাঁটে!
তার আশেপাশে যারা ছিল তাদের সিয়ামের আইডিওলজি চ্যালেঞ্জ করে তার সঙ্গে তর্ক বিতর্ক জারি রাখলে 'লুসিফার' জিততে পারতো না। এর আগে একটি মেয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে নিজেকে শেষ করেছিল।
মেয়েটি লুসিফার, একচোখা দাজ্জাল এসবের ছবি আঁকতো! তার আশেপাশে এ নিয়ে কথা বলার কেউ ছিলো না! সেও সিয়ামের মত চলে গিয়েছিল। এ কারণেই আমি আলাপ-বিতর্ক জারি রাখার পক্ষে।
৩।
মীর মশাররফ হোসেন হলে এর আগে আমাদের ৪১ তম আবর্তনের এক শিক্ষার্থী মারা গেছে! তার অনেক আগে জাবির কোনো এক ছাত্রকবি মনে হয় কবিতায় মৃত্যুর তারিখ লিখে সেই নির্ধারিত দিন (না, রাত?) মারা যায় বলে কথিত আছে!
মীর মশাররফ হোসেন হলের সিংগেল রুমগুলো ভেঙে ফেলার দরকার নেই। এই রুমগুলোও দুইজনের করে ফেলা জরুরি। এতে আলোচনা হয়। মানুষ ধ্বংসাত্মক বা ক্ষতিকর চিন্তা-ভাবনা বা ইবলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ কমে যায়। এটি প্রশাসন ভাবতে পারে। সিট সংকট দূর হলো, আবার সঙ্গীও থাকলো।
৪।
সিয়ামের লেখা 'ডেথ নোট' নিঃসন্দেহে অভিনব ও চমকপ্রদ। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা চাট্টিখানি কথা নয়।
কিন্তু ধ্যান করে অন্য জগৎ, অন্য মাত্রা বা অসীমের সন্ধান পেলে সেটি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর কল্যাণে কাজে না লাগিয়ে কেবল নিজে সেই সত্তার সঙ্গে মিশতে চাওয়া স্বার্থপরতা। স্বার্থপরতার সঙ্গে অসীমের সম্পর্ক থাকতে পারে না।
বিশেষ করে সিয়ামের এই জগতে আসার দ্বার তার মা (ও বাবা), তাদেরকে কষ্ট দিয়ে পরমসত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে সেই সাক্ষাৎ যে পরম গ্রহণ করে সে আল্লাহ বা পরমেশ্বর নন, সেটা লুসিফার বা সমজাতীয় কিছু হতে পারে!
ধ্যানে মানবের মুক্তির বার্তা মুহাম্মদ (স) ও বুদ্ধ এনেছিলেন। তারা মানুষের মুক্তির বাণী দিয়েছেন, অন্যদের শিখিয়েছেন। সিয়াম ধ্যানে কিছু পেলে তা এভাবে ডেস্ট্রয় করা আধ্যাত্মবাদ নয়, স্যাটানিক এপ্রোচ সেটি--তবে আমি নিশ্চিত সিয়াম সে বিষয়ে জ্ঞাত ছিলো না।
আজো খাঁটি মুর্শিদ, পীর-ফকির, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এই ধ্যান গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চালু রেখেছেন। ধ্যানকে 'দেহতত্ত্ব' এর মাধ্যমে বিকৃত করে পপুলার কালচারে উপস্থাপন করলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে তা অনেক ঊর্ধ্বে। ধ্যানের বাণিজ্যিক যে রূপ দেখা যাচ্ছে 'সেমিনার বা নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টরি বা নানা ফাউন্ডেশনের নামে' তা প্রকৃত অর্থে মৌলিক ধ্যান নয়। ধ্যান মানেই একলা--নির্জন। ধ্যান-তপস্যা কখনো লোকদেখানো বা জনসভায় হওয়া সম্ভব না।
৫।
মওলানা রুমি বলতেন, অসীম-মহাবিশ্ব তো আমারই মধ্যে। মহান আল্লাহ বলেন, আমি এতো বড় যে মহাবিশ্বে আমাকে ধরবেনা কিন্তু বিশ্বাসীর হৃদয়ে আমার স্থান হয়। এগুলো হাইলি ফিলোসফিক্যাল থট। সাধারণ লোকে এমন কী ওয়াহাবি গোঁড়া মুন্সিরাও এসব ইন্ডেপথ ভাবতে পারে না। এ কারণে মুসলমান সমাজ থেকে ধ্যান প্রায় উঠে গেছে।
ধ্যান যে সুন্নত, ধ্যান যে মুক্তির পূর্বশর্ত এটিই ভুলে গেছে লোকে। তাই 'যোগ' দেখে অনেকে এতে আগ্রহী হচ্ছে। তাতে সমস্যা নেই। উদ্দেশ্য সৎ রেখে হালাল খেয়ে বৈধ পথে যে কেউ স্রষ্টাকে খুঁজতে পারে। এ খোঁজায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা থাকলে তাতে বিচ্যুতির সম্ভাবনা কমে যায়। সিয়ামের গুরু ছিলো কেউ? জানা নেই।
৬।
আমাদের এক মামা ছিলেন। জরিয়া মামা। পেশায় কবিরাজ ছিলেন। তিনি পানির উপরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে পারতেন। মনে হতো মরা লাশ ভাসছে। তার একটা পা আরেকটা পায়ের উপর থাকতো, হাত বুকের ওপর, সোজা হয়ে তিনি ভেসে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিজের শরীরকে তিনি ওজনহীন করতে পারতেন। অবাক বিস্ময়ে আমরা তাকিয়ে থাকতাম! আমি বলতাম,আমাকে শেখান। তিনি বলতেন, আচ্ছা শিখো। পরে আমি ঢাকা থাকতে একদিন তিনি মারা গেলেন! আমার জীবনে তাঁর মৃত্যু গভীর ক্ষত তৈরি করে যে এই সাধনা আমি কেন শিখে রাখলাম না!
তখন মোবাইল ফোন থাকলে তিনি ভাইরাল হতেন এবং সদগুরুর চেয়ে অধিক ভক্ত জুটতো তার এটি নিশ্চিত। এমনিতেই তাকে সম্মান করে 'ঠাকুর' বলে ডাকতো সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। সে তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে তার পরম ভক্ত অনুসারী ছিলো কম। কট্টরপন্থীদের কারণে মুসলমানদের মধ্যে আধ্যাত্মিক সাধনা হ্রাস পেয়েছে!
৭।
জরিয়া মামা সাধনা করে কিছু পেয়েছিলেন। তিনি গাছ-গাছড়া দিয়ে মানুষের চিকিৎসা করে ভালো করতেন। ঝাঁড়-ফুঁক থেকে ভেষজ চিকিৎসাকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। অন্যদিকে সিয়ামও সাধনা করে কিছু পাওয়ার দাবি করলো, অথচ সে নিজেকে ধ্বংস করে বাকিদের বঞ্চিত করলো তার জ্ঞানের থেকে!
এ ঘটনা এ জন্য বললাম যে, কার ভেতর কী আছে আমরা কেউ জানিনা। আমাদের চারপাশে যারা আছে তাদের প্রতি আমাদের আরো দরদভরা চোখে তাকানো উচিত। কারণ, কে জানে ওর মধ্যে জরিয়া বা সিয়াম আছে কী না! জরিয়া থাকলে আমাদের সবার জন্য কল্যাণ, আর সিয়াম থাকলে তাকে রক্ষা করার দায়ও আমাদের।
সবার ওপর শান্তির বর্ষণ হোক।
0 Comments