বিনোদন মানুষের জন্য সর্বক্ষণ প্রয়োজনীয় নয়৷
যেভাবে খাদ্য সব সময় লাগে না, সময়ে সময়ে ক্ষুধা লাগে, বিনোদনও অমন।
বিনোদনও সেভাবে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি।
আপনার হঠাৎ মনে হবে 'একটা গান শুনি বা গাই'। কিংবা, যাই একটু আড্ডা দিয়ে আসি অথবা খেলা দেখি।
বেশিরভাগ সময় এটি একান্ত একক অনুভূতি।
কখনো সামষ্টিকভাবে এটি অনুভূত হয়। যেভাবে, একসঙ্গে কখনো আমরা খাই, দাই। যেমন--ধর্মীয় উৎসব।
ঈদ বা পূজার দিনের আনন্দের জন্য সবাই একসঙ্গেই অপেক্ষা করে।
কিংবা গ্রামের মেলা, নবান্ন উৎসব, নৌকা বাইচ ইত্যাদির জন্য সামষ্টিক অপেক্ষার ইতিহাস আছে।
এরকম বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া বিনোদন ব্যক্তিগত পর্যায়েই অনুভূত ও সাধিত হয়।
এ কারণে, যখন আপনার বিনোদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অনুভূতির স্থলে অন্যপক্ষের আগ্রহ, উদ্যোগ ইত্যাদি বিদ্যমান থাকবে সেখানে আপনি নিজেই পণ্য বা খেলনা হয়ে যাচ্ছেন। এটা আমার অভিমত।
কিন্তু এ বিষয়ে ইতালির মার্ক্সবাদী দার্শনিক এন্টোনিও গ্রামসি (১৮৯১-১৯৩৭) তার 'কারাগারের রোজনামচা'য় (Prison Notebooks) লেখেন যে, কর্তৃত্ববাদী শোষক 'সাংস্কৃতিক আধিপত্য' এর মাধ্যমে জনমনকে বিনোদিত রাখতে চায়।
তিনি ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনিকে দেখে এগুলো লিখেছিলেন।
মুসোলিনির রাষ্ট্রীয় মাতুব্বরিকে জারি রাখার জন্য সিনেমা ও আর্টের আলাদা বিভাগ ছিল।
অবশ্য গ্রামসি ১৯২৬ সাল থেকে জেলখানায় থাকায় হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসের কারসাজি দেখেননি।
গোয়েবলস বলতো, 'মিথ্যা বারবার প্রচার করলে ও শেষ পর্যন্ত সত্যই হয়ে যায়' এবং জার্মানির পুরো জাতিকে একসঙ্গে একদর্শনে নিয়ে আসায় হিটলারের সিনেমা, পত্রিকা, টেলিভিশন ও সঙ্গীতে বিনিয়োগ ছিল।
হিটলারের প্রচারমন্ত্রণালয়ের নামেও ''Enlightenment" ছিলো।
হিটলারো দুনিয়াকে তার নিজস্ব চেরাগে আলোকিত করতে চাইতো, ভাবা যায়?
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব হওয়ার পর লেনিন জনগণকে 'সামষ্টিক বিনোদন ও কমিউমিজমের চেরাগে আলোকিত করতে' একধরনের ট্রেনই চালু করলেন। এর নাম 'এজিট ট্রেন' (তানভীর মোকাম্মেল, চলচ্চিত্রকথা, ২০২০)।
এই ট্রেনে সিনেমা, ক্যামেরা, শিল্পী সব থাকতো। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সের্গেই আইজেন্সটেইন থেকে শুরু করে লেভ কুলেশভ, পুদোভকিন, ঝিগা ভের্তভ প্রমুখ লেনিনের প্রোপাগাণ্ডার সঙ্গী হয়ে 'সামষ্টিক বিনোদন উৎপাদন' করে জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত মানুষের মগজ নিয়ে খেলেছে শোষক/শাসকেরা (যা আজো চলমান)। এ জন্য এ সময়েই দেখা যায় গণমাধ্যমের সরাসরি প্রভাব 'যাদুর গুলি', 'ইঞ্জেকশন সুঁচ ফোঁড়ানো' এবং পরবর্তী সময়ে 'এজেন্ডা/অপপ্রচার' বিষয়ক তত্ত্বের ভিত্তি গড়ে ওঠে।
এ সময় কেবল সংস্কৃতিকে পণ্য হিসেবে উৎপাদন করা নিয়ে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট দর্শন মক্তবের দুইজন ফারেগ থিওডর এডার্নো ও ম্যাক্স খোরখেইমার ১৯৪৭ সালে ''Dialectic of Enlightenment'' লেখেন।
এর বাংলা কী করা যায়? 'দ্বান্দ্বিক চেরাগায়ন'? এ বইয়ে উনারা 'সংস্কৃতি কারখানা' (Culture Industry) পদযুগলের সূচনা করেন।
এইখানে উনারা বলেন যে, রাষ্ট্র আপনাকে বিনোদন হিসেবে যা সরবরাহ করে তাতে আপনি বিনোদিত, আনন্দিত ও সন্তুষ্ট যদি হন সেটি আপনার ইচ্ছা নয়, আপনাকে আনন্দে মশগুল রাখা রাষ্ট্রের ইচ্ছা। আপনি সেই ইচ্ছার 'আনন্দিত বলীর পাঁঠা'।
ভারত যে কাশ্মির ফাইলস, কেরালা স্টোরি, সিতা রামাম, আরআরআর, পদ্মাবতী ইত্যাদি সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়া চলচ্চিত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে প্রচার করছে এর গভীরেও রাজনীতি আছে।
একটা ম্যাসিভ অডিয়েন্সকে আরএসএস এর গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী অখণ্ড ভারতের আদর্শে দীক্ষিত করা, 'মুসলমান পরদেশী, এক সময় অত্যাচারী, মন্দির ভাঙছে' এই সব মিথ্যাকে গণমানসে গেথে দেওয়া।
এতে কাজও হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণার পরিমাণ দেখলে বুঝতে পারবেন।
এ কারণে যে সব গাধা একাডেমিক জগতে নানা কারসাজি করে এসে, অথবা দায়িত্বশীল জায়গায় এসে যদি বলে 'সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে কিছু নেই/ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মিথ' তবে তার ব্যাপারে সন্দেহ করবেন।
হয় সে নিরেট গবেট অথবা আপনার বিনোদনের ঠিকাদারি অন্যে নেওয়ায় যে পক্ষ লাভবান হয় সেই 'হেজিমন' এর এজেন্ট; বাংলায় এটাকে 'দালাল' বলা যেতে পারে।
বর্তমান সময়ে মানুষের নিজের ডাটা তার নিকট যতটুকু রক্ষিত অন্যের নিকট তার অধিকও থাকতে পারে। ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এলগোরিদম, বিগ ডাটা সে সুযোগ দিয়েছে।
এ কারণে বিনোদন এখন আরো বিপজ্জনক। পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে একটা চিমটি কাটা অথবা ফোনে ম্যাসেজ করার পিছনেও উদ্দেশ্য থাকে সেখানে কেউ আপনাকে ফ্রি ডাটা, নিউজ, বিনোদন দিলে তা 'লাভ ও লোভ' বিযুক্ত এটা ভাবেন কী করে?
আপনি ফ্রি ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করেন। প্রথম আলো পড়েন।
আর বিনিময়ে তাদের হাতে আপনার ডাটা তুলে দেন।
এ ডাটা তারা বিক্রি করে দেয়।
২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে ফেসবুকের কাছ থেকে ডাটা নিয়ে পুরো মার্কিন নির্বাচনকেই পালটে দেয় কেম্ব্রিজ এনালিটিকা।
এই কেম্ব্রিজ এনালিটিকাই আবার ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারণা চালানোর দায়িত্ব পালন করে।
দেখেন, দুই জায়গায়ই এরা জিতেছে কারণ, এরা অডিয়েন্সের মনোগজতের গভীরে যেতে পেরেছে।
২০১৮ সালের ৫ আগস্ট ব্রিটেনের গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সময়ের জনপ্রিয় অবৈধ ইসরায়েলি লেখক যোভাল নুহু হারারি বিগ ডাটাকে বিপজ্জনক বলেন।
যদিও পুঁজিবাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া এই লেখক সবার জন্য তথ্য উন্মুক্ত হোক এটা চাননি যা উনাদের হলোকাস্ট ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর অথবা পুঁজিবাদের জন্য, যেহেতু হারারি নিউজ বা তথ্যকে পণ্য হিসেবে কেনা বেচার উকিল (The Idea of Free Information is Extremely Dangerous: Yuval Noah Harari, The Guardian, 2018)।
আমার মতোই ইলন মাস্কও অবশ্য এটা মানবেন না। আমরা চাই ইনফরমেশন সবার জন্য উন্মুক্ত হোক।
ইলন মাস্ক টুইটার দখল নিয়ে যদিও তার পুঁজিবাদী খায়েশ পূরণ করছেন। সংবাদের জন্য তিনি ক্ষতিকর এবং ডানপন্থী জায়নবাদের দালাল হিসেবে টুইটারকে নিয়ে এসেছেন।
জুলিয়ান এসেঞ্জ, আমাদের তথ্যবিপ্লবী এ দিক থেকে আমাদের সবার আগে পথ দেখিয়েছেন মানুষের মুক্তি কোথায়।
জার্মানির দের স্পিগালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলিয়ান বলেছিলেন,'If war can be started with lies, then peace can be started by the truth'।
আর সত্যকে এখন যেভানে খণ্ডিত করে উপস্থাপন করা হয় তাতে মাধ্যমের ওপর তথ্যের ও বিনোদনের জন্য নির্ভরতা জনসাধারণকে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করছেনা।
এ কারণেই আগামীতে তথ্যের ক্ষেত্রে 'গোষ্টীতান্ত্রিকতার' উদ্ভব হতে পারে।
আমার অনুসিদ্ধান্ত, এ সময় মানুষ নিজের রক্তসম্পর্কহীন কাউকে আর বিশ্বাস করবেনা।
এই বিশ্বাসহীন পরিস্থিতির বদল ঘটাতে একে এন্টিথিসিস হিসেবে ধরে রেভুলোশনারি সিন্থেসিস আনয়ন যারা করবে তারা এখনো বেঁচে আছে...!।?
0 Comments