কেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানের বিচার জরুরি?
স্বাধীন বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক রূপ দানকারী; শত শত মানুষ হত্যার কারিগর; সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এবং অন্যান্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরির তাত্ত্বিক প্রবক্তা; 'মুজিববাদের' বিরুদ্ধে কথিত 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' উকিল; মার্কিন অনুকূলে ভুয়া বিপ্লবের আওয়াজ তোলার মাধ্যমে হাজারো আওয়ামী লীগ ও জাসদ কর্মী, সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের রক্ত ঝরানোর অগ্রসেনা সিরাজুল আলম খানের বিচার চাই।
বেঁচে থাকতেও চেয়েছিলাম।
এই ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, অথচ নূরে আলম সিদ্দিকীর বইয়ের (২০১৮) তথ্যমতে অস্ত্র জমা না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই সশস্ত্র জাসদ ও তার রক্তখেকো গণবাহিনী গঠন করেন৷
উনাকে কে বা কারা কারা মহিমান্বিত করছে? কারা স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের রক্তাক্ত অধ্যায়ের রূপায়ণকারী এই আত্মগোপনকারী কাপুষকে 'রহস্যপুরুষ' উপাধি দিয়ে অতিতোষণ করছে? তারা ইতিহাসকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে পাঠ করেছেন তো?
একটি লোক একটি জাতির একেবারে বিসমিল্লায় গলদ ঢেলে দিলো এবং তার আচরণ ও কর্মকাণ্ড সে সময়ে মার্কিন সিআইএ এর এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা পালন করলো অথচ প্রায় বিনা বিচারে সে পার পেয়ে গেলো?
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদিপাপ 'জাসদ, গণবাহিনী এবং এদের সশস্ত্র কুকীর্তি'। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ এর রক্তপাত এবং পরবর্তীকালের প্রতিটি রক্তবিন্দু, বীরউত্তম খালেদ মোশাররফের হত্যাকাণ্ড, সেনা থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়ার উত্থান ও পতন, ইন্ডেমনিটি, স্বাধীনতাবিরোধীদের সক্রিয় করা, অমুক্তিযোদ্ধা এরশাদের স্বৈরাচার হিসেবে আবির্ভাব, খুনীদের ফ্রিডম পার্টি গঠন ইত্যাদি সমস্ত ঘটনার পিছনে এই আদিপাপের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।
এই আদিপাপের প্রধান তাত্ত্বিক পাপী প্রয়াত সিরাজুল আলম খান। তাকে নীরবে প্রস্থান করতে দেওয়া উচিত হয়নি এ কারণে।
এর আগে, এরশাদও অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রয়াত হন।
বেঁচে থাকা অবস্থায় সিরাজুল আলম খানকে ইতিহাসজ্ঞানসম্পন্ন ক্রিটিক্যাল ভাবনায় সক্ষম আধুনিক ছেলেমেয়েদের সামনে আনার দরকার ছিল।
যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে আনা গেলো প্রশ্ন করে উনার আমেরিকাপন্থী রক্তখেকো বিপ্লবগিরি ছুটায় দেওয়া যেতো৷
কেবল আধামরা জাসদের ফুটসোলজার মহিউদ্দিন ভাই বা সিরাজের মুরিদ শামসুদ্দিন পেয়ারার কেচ্ছা কাহিনীকে ইতিহাসের দলিল ধরা যাবে না৷
তাহলে এই রক্তখেকো বা তার রক্তখেকো চিন্তার মাধ্যমে শক্তিশালী হওয়া আরেক রক্তপিপাসু কর্নেলকে ভালো করে চেনা যাবেনা।
বাংলাদেশের সৃষ্টির শুরুতেই এই রাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে জাসদ।
হ্যাঁ, আপনি তৎকালীন শাসনপ্রণালীর নানাকিছুর ক্রিটিক করতে পারেন। কিন্তু তা আপনাকে জাসদ বা অন্যান্য কমিউনিস্টদের রক্তনেশার বৈধতা দেয় না।
আমি মনে করি, সিরাজুল আলম খানের মত নাটের গুরু খলনায়ককে এইভাবে নীরবে আরামে নিভৃতে একটি 'কাল্ট ইমেজ' তৈরি করার সুযোগ দেওয়া উচিত হয়নি। উনাকে প্রশ্ন করা দরকার ছিল।
ছাত্রজীবনে কয়েকবার লোকটির খবর পেতে চেষ্টা করেছিলাম উনার আইডিওলজি চ্যালেঞ্জ করার জন্য। কে যেন বলেছিলো দেশের ভেতরে বা বাইরে থাকেন। আমেরিকায়ও নাকি গিয়েছেন!
এখন তিনি বাছাইকৃত কিছু দালাল ছাড়া আর কারো সঙ্গে দেখা করেন না--এটাই জেনেছিলাম।
সে দিন বইমেলায় জাসদের বয়ানের ফেরিওলা লেখক মহিউদ্দিন ভাইও খুব গর্বের সঙ্গে আমাকে জানালেন, 'সিরাজুল আলম খান মহিউদ্দিনকে ছাড়া কাউকে ইন্টারভিউ' দেন না৷ যদিও জনৈক পেয়ারা বই একটি বের করেছে উনার মুখের কথা নিয়ে যা ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ইতোমধ্যে 'নিষিদ্ধ'।
আমার মনে হয়, ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যয় রচনায় যারা ভূমিকা রাখে ইতিহাসের প্রয়োজনে তাদের গবেষক বা নতুন প্রজন্মের মুখোমুখি করা উচিত।
সেটি সম্মাননা, সাক্ষাৎকার, আলোচনা যে নামেই হোক এই লোকগুলোকে সামনে আনতে হবে। ইতিহাসের সত্য না বলে বা গোপন করে বা ভুলভাল নিজের অবস্থানকে জায়েজ করে কিছু মুরিদের মাধ্যমে মিথ্যার মিথ তৈরি করে এই 'খল'নায়কদের নীরবে চলে যেতে দেওয়ার বিরুদ্ধে সচেতন বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান আমার।
মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকজন সামনের সারির সংগঠকদের একজন হিসেবে, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যে মর্যাদা তার রয়েছে তা তিনি পেয়েছেন, পাবেন।
কিন্তু তাকে অতিমহিমান্বিত করার মাধ্যমে একটি সদ্যস্বাধীন দেশে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের সূচনাচিন্তক হিসেবে তার ভূমিকাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
আর এ কারণেই তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। অন্তত জনতার আদালতে তিনি সারাজীবন প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকবেন। সেটি হওয়া উচিত।
কারণ, প্রশ্নই উত্তর।
0 Comments