পাক-ভারত-চীন সংঘর্ষে বাংলাদেশীদের মনস্তাত্ত্বিক বিভাজনের শিকড়
~~~~~~~
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে উদ্ভব হলেও আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী হিসেবে নিজেদের সাংবিধানিক পরিচয় দিই। আমাদের একটি স্বাধীন সত্তা রয়েছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি! তথাপি পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্রকে আমাদের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলা হচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকেই। এতে করে জাতি হিসেবে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে।
আমাদের মধ্যেই হাতেগোনা কিছু ছাড়া অনেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও কেউ কেউ মানসিক পাকিস্তানি এবং কেউ কেউ মানসিক ভারতীয় হিসেবে জীবন যাপন করছে। পাকিস্তান ও ভারতের প্রতি এই জনগোষ্ঠীর নিজনিজ প্রেম ও ভালবাসা দেখানোর সাধারণ নির্দেশক হিসেবে কাজ করে ক্রিকেটসহ অন্যান্য ক্রীড়ায় সমর্থন। এরপর কাশ্মীর, লাদাখ, বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বা উত্তেজনার সময় এই বিভাজন আরো চোখে পড়ে। এই চক্রটি ভয়াবহ। বাবা-মা, পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ইত্যাদি থেকে ধারাবাহিকভাবে সন্তানদের মধ্যেও সেই পাকপন্থী ও ভারতপন্থী সত্তা প্রবাহিত হতে থাকে। সেকারণে সর্বশেষ কাশ্মীরের লাদাখের চীন-ভারত সংঘর্ষও এ থেকে বাদ যায়নি।
পাকিস্তান বা ভারত কিংবা ভারত বা চীনের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বিভাজিত হয়, হচ্ছে। এই বিভাজনের মনস্তত্ব ভীষণ গভীরে! ১৭৫৭ মীর জাফর, রায় দুর্লভ, ঊমিচাঁদের পাশাপাশি কমপক্ষে ২০০০ দেশীয় সেনা ইংরেজদের পক্ষে লড়াই করে। বঙ্কিমচন্দ্রের মত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা দখলদার ইংরেজদের ইতিবাচক ধর্মীয় সহায়তাকারী হিসেবে নিয়েছে! কত বনেদী জমিদার, তালুকদার, সম্ভ্রান্ত পরিবার পথের ফকির হয়েছে ধর্মীয় কারণে! আমাদের বিভাজনের রেখাটি অনেক গভীরে প্রোথিত।
আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৪৭ এ। সে সময় দেশ বিভাজনের সময় খুবই কম সংখ্যক মানুষ অখণ্ড বাংলা বা পূর্ববাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে আলাদা দেশ চেয়েছিলো। বর্ণবাদী হিন্দুত্ববাদী সংকীর্ণতায় আক্রান্ত ও প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে অনেকেই শরীক হয়। আবার অনেকেই ভারতের সঙ্গে থেকে যেতে চায়। তারপরও ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করে পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট বাংলারই বড় একটি অংশ স্বেচ্ছাচারীতা করে বর্ণবাদপ্রভাবিত ব্রিটিশরা ভারত বা হিন্দুস্তানের সঙ্গে যুক্ত করে। ১৯০৫ এ মায়ের অঙ্গহানীতে যারা ভারাক্রান্ত ছিলো ১৯৪৭ এ তারাই স্বেচ্ছায় মাকে কেটে ফানাফানা করে খুশিতে আটখানা হলো! এমন কি আসামের করিমগঞ্জ ভোট দিয়ে "পূর্ববাংলার" সঙ্গে যোগ দিতে চাইলেও দেয়া হলোনা!
তো এই সময়টিতে অনেকেই অখণ্ড ভারতবর্ষের সঙ্গে থাকতে চেয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের কারণে পাকিস্তানের নাগরিক হয়েছে। এই অংশটি বংশানুক্রমিকভাবে ভারতের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ প্রকাশ করেছে।
ঠিক বিপরীতক্রমে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার, ধর্ষক, খুনী, লোপাটকারীদের থেকে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীরা বেরিয়ে যেতে লড়াই করে একটি অংশ তা চায়নি। এই অংশটি পাকিস্তানকে তাদের সর্বশেষ ঠিকানা ভেবেছিলো এবং তারা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে নির্লজ্জভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়, নৃশংস উপায়ে তা প্রকাশও করে। ১৯৭১-এ পরাজিত হলেও তাদের সুপ্ত অস্তিত্ব তারা নানা সময়ে জানান দিয়ে থাকে। তাদের এই পাকিস্তানপ্রীতিও বংশানুক্রমিকভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হয়ে এসেছে। উভয়ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, অনেক ভারত ও পাকপন্থী পরবর্তীকালে বাংলাদেশপন্থী হয়ে কাজ করেছে।
তো যে কথাটিতে ছিলাম। ১৯৪০ এর লাহোর প্রস্তাবের "States" এর আওতায় আলাদা মুসলিম বাংলা গঠনের চিন্তা ১৯৭১ এ বাস্তবায়িত হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বকে অসাড় করে দিলেও বাংলাদেশের মানুষের একটি বিশাল অংশের ভারতের বা পাকিস্তানের প্রতি যে মোহ তা আমাদের ইতিহাসের পাঠকে জটিল করে তোলে।
তাই লাদাখে ভারতের সৈন্য হতাহতের পর বাংলাদেশের কিছু মানুষের ফেসবুকে উল্লাস ও কিছু মানুষের কেন চীনের পক্ষে যাবে এরা বিষয়ক বয়ান যে কেবলই সেই পুরোনো মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন নয় এ কথা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবেনা।
বিজেপীর অখণ্ড ভারতনীতি এদেশে ১৯৪৭ এ ভারতের থেকে বের হওয়াটিকে যারা পছন্দ করেনি তাদের জন্য আনন্দদায়ক হলেও যারা দিল্লির সম্প্রসারণবাদী ইতিহাস সম্পর্কে জানে তাদের জন্য আতঙ্কের। তিনপাশে ভারতবেষ্টিত এই ভূখণ্ডে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক বৈষম্যের কারণে দীর্ঘদিন ভারতকে ভালোবাসা অনেকেও অতিষ্ঠ।
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের মানুষকে অনেক বেশি আহত করে। বাংলাদেশের মানুষ চায় তাদের বাহিনীও অন্তত একটি ফাঁকা আওয়াজ করে জবাব দিক। কিন্তু নানা জটিলতায় তা হয়ে ওঠেনা। এসব কারণেই চীনের সেনাবাহিনীর হাতে কাশ্মিরের লাদাখে ২৩ ভারতীয় সেনা হতাহতের ঘটনায় এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক তৃপ্তি পায় অনেকে। একে ক্যাথার্সিস বলা হয়। অর্থাৎ নিজে যা করতে চাই তা অন্য কাউকে করতে দেখে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া। বাংলাদেশে ভারতীয় সিরিয়াল এ কারণেই দেখে দেশের বৌ ও শ্বাশুড়িরা। তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে গুটিবাজি দেখে প্রশান্তি পায়। চলচ্চিত্রের খলনায়কের মার খাওয়া এ কারণেই আমাদের মনে প্রশান্তি দেয়। আমার মনে আছে, ঢাকা কলেজে থাকতে অবতার চলচ্চিত্র দেখতে বলাকা সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। সেখানে প্যান্ডোরার প্রাণী ও অধিবাসীদের হাতে শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসনকারীদের মাইর খাওয়া দেখে সব দর্শকরা ভীষণ জোরে করতালি দিচ্ছিলো। বাংলাদেশের যে মানুষগুলো ভারতের নাকানিচুবানিতে হাত তালি দিচ্ছে এর সবাই মানসিক পাকিস্তানী নয়, অনেকেই এই সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি না দেয়া, বিনা শুল্কে ট্রানজিট নেয়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, দিল্লিতে দাঙ্গায় মুসলমানদের হত্যা করা, মসজিদ ভাঙা, গরুর গোশতো খেলে পিটিয়ে মারা, আমাদের পর্যটন ও চিকিৎসাব্যবস্থাকে ক্ষতগ্রস্ত করা, রোহিঙ্গা সংকটে পাশে না দাঁড়ানো ইত্যাদি কারণে ভারতের প্রতি বিতৃষ্ণ! এই বিতৃষ্ণ দশা থেকে সাময়িক প্রশান্তি এনে দেয় লাদাখ বা অন্যান্য হতাহতের ঘটনা!! তবে আমি এখনো বিশ্বাস করি, ভারত যদি দাদাগিরি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের পানির ন্যায্যহিস্যা বোঝায় দেয়, বাণিজ্য ঘাটতি দূর করে, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করে বাংলাদেশকে সমীহ করে তবে অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষ বা সরকার ভারতের পাশেই দাঁড়াবে। কারণ--
পাকিস্তান জঘন্য সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র যারা একাত্তরে আমাদের উপর নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে। চীন জঘন্য ফ্যাসিবাদী দেশ যারা উইঘুর মুসলিমদের উপর অত্যন্ত অমানবিকভাবে অবিচার করছে, পদ্ধতিমাফিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ যখন ভারত ও চীনের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্কে মধ্যবর্তী অবস্থায় যায় এর দায় মূলত ভারতের। কারণ ভারত এক বিন্দু ছাড় তো দেয়ই না, আবার পারলে বাংলাদেশ ধরে তার লাভের খাতায় লিখে ফেলে! এর মধ্যেই বাংলাদেশ তার নিজ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিলেও ভারতীয় ছোটলোক আনন্দবাজার যখন "খয়রাতি" সাংবাদিকতা করে তা ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকেই নাজুক করে তোলে। এইসব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে না উঠলে ভারতের প্রতিবেশী এবং একমাত্র পাল্টা আঘাত না করা প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ কতদিন থাকবে তা দেখার বিষয়। কারণ দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বাংলাদেশী বাঙ্গালির লড়াই করার ইতিহাস ইতিহাসের পাতায় অজেয় ও উজ্জ্বল।
অতএব, এই নিবন্ধে আমার প্রস্তাব থাকবে, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আরো শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। ভারত ও চীনের মধ্যে কোনো এক পাশে ঢলে পড়ে নিজের সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধকে হ্রাস করা যাবেনা। এই দুই দেশের উত্তেজনা, স্বার্থের লড়াইয়ে নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে হবে। সেই সিদ্ধান্তটি যত দ্রুত হবে তত এদেশের জনগণ পরিচয় সংকটের যে ঐতিহাসিক মনস্তাপ তা থেকে বেরিয়ে আসবে। আর তা না হলে সেই পিছনেই হাঁটবে জাতীয় তরী! যেখানে বিভাজন লাগিয়ে তৃতীয় পক্ষ ফায়দা লুটে খেতো আমাদের প্রিয় বাংলা থেকে! সে ভুল আর কত করবো আমি তুমি ও সে---আমরা???
(সংক্ষেপিত)
0 Comments