রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকটের অনালোচিত টেকসই সমাধান
~®~
আরো একটি ২৫ আগস্ট চলে গেলো, অথচ রোহিঙ্গা শরনার্থীরা তাদের নিজ ভূখণ্ডে গেলোনা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে কয়েক সপ্তাহেত মধ্যে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সন্ত্রাসবাদী বৌদ্ধভিক্ষু, রাখাইন জনতা ও মিয়ানমারের আর্মি-পুলিশের হত্যাযজ্ঞের কবলে পড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। হত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নে বিশ্ব মিডিয়া রাখাইনে তাক করা হলেও ভাগ্য বদলায়নি দরিদ্র অসহায় রোহিঙ্গাদের।
অন্যদিকে এখন বিশ্বব্যাংকের মত সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাগুলো পরামর্শ দিচ্ছে আজীবন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার। দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান একেবারেই জোরালো নয়, এমন কী সেখানে সামরিক সরকার থাকলেও।
উত্তাল সমুদ্রে আবারো শরনার্থী শিবির ছেড়ে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের ভারতীয় ডিপ্লোমেটিক পয়েন্ট অব ভিউ মাথায় রাখা মিডিয়া ক্রমাগত রোহিঙ্গাদের 'দানবায়ন' করে চলেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলাপ নেই।
আমি বরাবরই রোহিঙ্গা সংকটের দ্বিপাক্ষিক আলাপযোগ্য সমাধান দেখিনা। এখানে বহুপাক্ষিক এমন কী প্রয়োজনে বস্তুবাদী ইউরোপীয় এক বা একাধিক দেশকেও যুক্ত করা উত্তম। তা না হলে এই যে আমাদের চীন বা ভারতের প্রতি কূটনৈতিক দরদ যেটিকে আমি বলি 'প্রাচ্যপ্রীতি' (Oriental Nepotism) সেটি বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ, এটা নির্মম সত্য যে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে চীন, ভারত ও মিয়ানমার একই সরলরেখায় অবস্থান করছে। তদুপরি, চীনের ও ভারতের নিজ নিজ আরাকান যথাক্রমে উইঘুর ও কাশ্মিরী সংকট তো আছেই। ফলে এরা রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান যেটি সেটি নিয়ে মুখ কোনোদিনও খুলবেনা।
টেকসই সমাধান তবে কী? সমাধান নিচের যেকোনো একটি বা একাধিকটির সম্মিলন।
১। পূর্ব তিমুর ইত্যাদির মত জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি গনভোট আয়োজন। এই গণভোটে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রায় দেবে তারা সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র মিয়ানমারের অধীনে থাকবে, না স্বাধীন ভূখণ্ড গড়বে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আরাকানকে স্বাধীন রাজ্য অথবা বেশিরভাগ সময় বাংলা থেকে শাসিত হতে দেখা যায়।
২। মিয়ানমার তো সহজে গণভোট ইত্যাদি হতে দেবেনা। তারজন্য আপনাকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী একটি মিশন দরকার হবে। এই মিশন আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত 'নিরাপদ অঞ্চলসমূহ' (Safe Zones) গঠন করবে। এই অঞ্চলের জন্য 'বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ' (No fly zone) হবে৷ এরপর আয়োজন হবে ভোটের। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে ভোট হলে তা নিয়ে মিয়ানমার আপত্তি জানাতে পারে। তাই আগে সেদেশে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে৷ সে জন্য কী করার আছে?
৩) এরপর আসবে 'রক্ষণ করার গুরুদায়' (Responsibility to Protect) যেটি R2P নামে পরিচিত। অর্থাৎ জাতিসংঘ তার বাহিনী নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে (Most Persecuted People) উদ্ধার করতে তৎপর হবে৷ আধুনিক সময়ে এটিকে অনেকে PR2PH করতে চান। অর্থাৎ Protected Return to Protected Homeland যাকে বাংলা করা যায় 'সংরক্ষিত আবাসে সংরক্ষিত প্রত্যাবর্তন' বা 'নিরাপদ মাতৃভূমিতে নিরাপদে ফিরে আসা'। এর জন্য আগে আরাকান বা রাখাইনকে শান্তিরক্ষী বাহিনী বসবাসের জন্য প্রস্তুত করবে৷ সেইফ জোন হবে। তারপর এ বাহিনীর পাহারায় রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে পৈতৃক ভিটায়। যতদিন তাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন এ বাহিনী অবস্থান করবে৷ গণভোট হবে৷ গণভোটের ফলাফল স্বাধীন দেশ গঠন হলে তাদের জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশ স্বীকৃতি দেবে।
৪। চীন তো আর অবৈধ শক্তি Veto দিতে বাদ রাখবেনা। এমন কী রাশিয়াও হাজির হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে Uniting for Peace (৩৭৭ ক) নামের একটি 'সমাধান পদ্ধতিতে' নিরাপত্তা পরিষদ নামের 'অনিরাপদ পরিষদকে' পাশ কাটানো যায়। যারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা করেন তারা জানেন, ১৯৫০+ সালে কোরিয়া যুদ্ধে এটি প্রয়োগ করা হয়েছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সমর্থিত উত্তর কোরিয়ার 'আগ্রাসন' থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে মুক্ত করার জন্য। এতে করে নিরাপত্তা পরিষদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাধারণ পরিষদ মানবতার স্বার্থে সামরিক বাহিনীকে নামাতে পারে।
৫। এগুলোর জন্য খুব শক্তিশালী কার্যকাঠামো (Framework) ও সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা তৈরি করে নীতিগ্রহণ করা প্রয়োজন। সেটি যদি না হয়, আপাতত তুর্কি যে নীতিতে সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে সেটি করা যেতে পারে। কী সেটি?
বাংলাদেশ থেকে সীমান্তে রাখাইনের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের জায়গায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করা। এ জন্য বাংলাদেশের যেটি করতে হবে তা হচ্ছে, আরাকানের অভ্যন্তরে ৩০-৪০ কিলোমিটার বা তারও অধিক করিডর নিয়ে নিতে করতে কাজ করতে হবে। মানে কইয়ের তেলে কই ভাজতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরো বেশি ত্রাণের জন্য চাপ দিতে হবে। সেটি না করা গেলে এ মঙ্গোলয়েড জাতিসত্তা(বর্মিজ) পিছু হটবেনা। এরা শক্তের ভক্ত আর নরমের যম।
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান নিয়ে আমি ও জান্নাতুল ফেরদৌস 'Rohingya Refugee Crisis: Toward a Sustainable Solution' শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করছি৷ আমরা এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রকাশও করেছি। সেখানে জাতসংঘের যে প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন তারা একে 'আউট বক্স সলিউশন' বলেছেন যদিও জাতিসংঘের বক্সেই অতীতে এমন বা এর কাছাকাছি সলিউশন রয়েছে। গবেষণাটির অংশবিশেষ Centre for Governance এর আন্তর্জাতিক জার্নালে এ বছর প্রকাশিত হয়েছে৷ আমি চেয়েছিলাম এটিকে একটি বই হিসেবে আনতে, কিন্তু ভাতের সুব্যবস্থার লড়াইয়ে যুক্ত থাকলে গবেষণা মনমতো হওয়া কঠিন। যাহোক, সমাধান করতে আরো বিচক্ষণ হওয়া প্রয়োজন আমাদের।
গাম্বিয়ার মামলায় ইতোমধ্যে মিয়ানমার চাপে। আনান কমিশনের প্রতিবেদনে তারা ফল্ট লাইনে৷ খুনী অং সান সুকির সঙ্গে রক্তচোষা মিলিটারিদের দ্বন্দ্বে মিলিটারিরা ইন চার্জ৷ এতো নাজুক পরিস্থিতিতেই মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার সুযোগ। এখন না হলে সমাধান হওয়া কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণ করে যেটি দেখতে পারি সেটি হচ্ছে, ঠিকঠাক চাপ দেয়া গেলে অবৈধ সামরিক শাসকদের নিকট আন্তর্জাতিক সংস্থার বা দেশের বার্গেইনিং ক্যাপাবিলিটি বেড়ে যেতে পারে।
আমরা চাই টেকসই সমাধান। সেটি হোক। আমরা চিরকাল অন্য আরেক 'জাতির সংকট' টেনে যেতে পারিনা---জাতীয়তাবাদ বা মানবতাবাদ কোন দিক দিয়েই তা যৌক্তিক বা শোভনীয় নয়। টেকসই সমাধান দরকার। সমাধান করতে হলে খাটতে হয়, ভাবতে হয় ও অভূতপূর্ব বা বাক্সের বাইরের উদ্যোগও নিতে হয়।
(https://www.researchgate.net/publication/349077169_Rohingya_Refugee_Crisis_Toward_a_Sustainable_Solution
এ গবেষণা পত্রটির লিংক কমেন্ট বক্সে)
0 Comments