বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কীভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি এসেছে সেটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের ভিজিটিং প্রফেসর ড. ফাহমিদুল হক ( Fahmidul Haq) গত ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট রবিবার বক্তব্য প্রদান করেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে তারেক মাসুদ স্বারকবক্তৃতা ২০২৩ উপলক্ষ্যে বক্তব্য প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এ শিক্ষক।
গতানুগতিক বক্তব্যের যে ধাঁচ তার বাইরে এসে অধ্যাপক ফাহমিদুল হক ঠাণ্ডা মাথায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন জেরার্ড জেনেটের তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করে।
তিনি বাংলাদেশের মানুষের বৃহত্তর অংশের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বাঙ্গালীত্বের সঙ্গে তার ধর্মীয় পরিচয় মুসলমানিত্ব কীভাবে চিত্রিত হয়েছে ভিন্নধর্মী বা বিকল্পধারার (যাকে ফাহমিদুল হক 'স্বাধীন চলচ্চিত্র' বলছেন) সেটি ১০ টি চলচ্চিত্রের 'ন্যারেটিভ' স্টাডি ও এনালাইসিস করে উপস্থাপন করেছেন।
এ বক্তব্যটি মূলত ফাহমিদুল হক স্যারের রাউটলেজ থেকে প্রকাশিত বই 'Identity, Nationhood, and Bangladesh Independent চিনেমা' এর বাংলা সরল তরজমা।
Brian Shoesmith এর সঙ্গে যৌথভাবে লিখিত হলেও এ গ্রন্থের মূখ্য লেখক ড. ফাহমিদুল হক।
বক্তব্যটি অনেক সংবেদনশীল বিষয়ে হলেও ফাহমিদুল হক দারুনভাবে মৃদুভাষায় উপস্থাপন করেছেন, এমন কী সমসাময়িক বিষয়কেও প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন।
বক্তব্যটি এ কারণেই অন্যরকম!
যদিও স্যারের সমস্ত কথাকে আমি সমর্থন করিনা, কিছু কিছু আলাপের বিষয়ে আমার পৃথক যুক্তি ও বয়ান রয়েছে তথাপি বাংলাদেশের ফিল্প স্টাডিজে ফাহমিদুল হক 'ওয়ান পিস'।
চলচ্চিত্রের ক্রিটিকাল স্টাডিজে তার ধারেকাছে যায় এমন কারো কাজ বাংলাদেশে নাই৷ কাছ থেকে তাঁর কাজের নজির দেখে আমার মোটেই মন্দ লাগে নি৷
ফাহমিদুল হকের বক্তব্যের মূল বিন্দু কী ছিলো?
তিনি লালসালু, খেলাঘর, মাটির ময়না, মেহেরজান, টেলিভিশন, রানওয়েসহ ১০ টি চলচ্চিত্রকে নমুনা হিসেবে নিয়ে বলতে চান, বাংলাদেশের মানুষ নৃতাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় বাঙ্গালী এবং 'বাঙ্গালীত্ব ও ধর্মীয় পরিচয় মুসলমানিত্ব অনেকে সময় বিপরীতে অবস্থান করে'--বাংলার লেখক বা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ন্যারেটিভ অনেকটা এমন।
আমি এখানে যুক্ত করি যে, বাঙ্গালী আর মুসলমান এ দুটি বর্গকে আলাদা করা হয়েছে মূলত ব্রিটিশরা যখন থেকে কলকাতায় 'বাবু শ্রেণী' তৈরি করেছে তখন থেকে।
তার আগে এই ভূখণ্ডের হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ এক হয়েই বাঙ্গালী ছিল। এর একটি প্রমাণ আমরা শামসুদ্দিনের 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ' নাম ধারণ থেকে পাই।
কাজী নজরুল ইসলাম কাণ্ডারি হুঁশিয়ারে 'সিরাজকে বাঙ্গালী' বলেছেন৷ বাঙ্গাল আর তার সঙ্গে 'ই' লাগানোরও আলাদা রাজনীতি আছে৷
এ কারণে অক্সফোর্ডের শিক্ষক তপন রায়চৌধুরী 'বাঙালনামা' লিখে 'শিক্ষিত বাবুদের সাম্প্রদায়িকতা' তুলে ধরেন।
ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে 'সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস' গ্রন্থেও কলকাতা ও এর আশেপাশের বাবুশ্রেণির সাঁওতালসহ অন্যান্য জাতিকে ছোট করার কথা লিখেছেন।
আজ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ৷ আমরাই প্রাচীন বাঙ্গালার হৃদয়কেন্দ্রভূমিতে অবস্থান করি। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ধর্মে ইসলাম পালন করে তবে খুবই গৌরবের সঙ্গে নিজেকে বাঙ্গালীও পরিচয় দেয়। এই বাঙ্গালীর উচ্চারণ 'বাংগালী', নাক দিয়ে উচ্চারণ করা 'বাঙালি' নয়।
তবে ফাহমিদুল হক ব্যক্তিগত মত দিয়ে, বাঙ্গালী মুসলমানদের ঈদকে বাঙ্গালীর উৎসব বলেছেন৷ এটি এ যুগের সেকুলার শিক্ষকদের অনেকেই স্বীকার করেননি। ফাহমিদুল স্যারকে অভিবাদন বক্তব্যে মুসলমানদের সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।
সিনেমার উদাহরণ টেনে অবশ্য তিনি বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশের বিকল্প বা স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের যারা কর্তা (তারেক মাসুদসহ) তারা মূলত 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) আর এ কারণে তারা তাদের বিশ্বাসের সপক্ষে চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয় বিনির্মাণ করেন। একে হক সাহেব 'আত্মপরিচয়ের রাজনীতি' বলেছেন।
তিনি চলচ্চিত্রে শাস্ত্রীয়, রাজনৈতিক বা জনপ্রিয় ইসলামের পাশাপাশি জনধর্ম (মানে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের 'সিনেক্রেটিক' রূপ অথবা সংমিশ্রণ বা নয়া রূপ--যেমন, সুফিবাদ, পীরবাদ, বাউল ইত্যাদি।) নিয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নব্য উদারতাবাদের কাউন্টারপার্ট হিসেবে ৯/১১ পরবর্তী পৃথিবীতে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরু হলে যে কট্টরপন্থী মতের উদ্ভব হয় সেটিও আলাপ করেন।
এই আলাপটি ইন্টারেস্টিং। রানওয়েতে রুহুল আসে, তার আশেপাশে প্রতিবাদী নারী চরিত্রও আসে। কিন্তু তারেক মাসুদ 'জঙ্গী' হিসেবে মাদরাসা ছাত্র বা 'জঙ্গীদের মদদদাতা' হিসেবে 'রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী'দের যে দায় দেন হোলি আর্টিজানে ইংলিশ মিডিয়াম বা নর্থ সাউথের জঙ্গী ছাত্রদের আক্রমণ কিন্তু সেই ন্যারেটিভকে ধাক্কা দেয়৷ নিম্নবিত্ত রুহুল 'হয়রানীর শিকার হয়ে বা অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতায় জঙ্গীবাদে জড়ায়' এটাকে প্রতিষ্ঠিত করার ইন্টেলেকচুয়াল আলাপের পাশাপাশি কেন নিব্রাসের মত উচ্চবিত্তের ঘরে জন্ম নেওয়া ইংলিশ মিডিয়াম বা মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও জঙ্গী হয়, বা নিব্রাসের সঙ্গীদের কেউ কেউ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পরিবারের সেকুলার পরিবেশে বেড়ে উঠেও কেন জঙ্গী হলো, তার সাইকোএনালাইসি আমি স্যারের কাছ থেকে আশা করেছিলাম৷
কেবল "নিম্নবিত্ত জঙ্গী হয়, আর উচ্চবিত্ত জঙ্গীবিরোধী ফেরেশতা" হয় এ ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভটা চ্যালেঞ্জড হওয়া জরুরি। এ নিয়ে আলাপ হতে পারে।
তবে পুরো বক্তব্যের মধ্যে আমার নিকট চমকপ্রদ লেগেছে এটি যে--তিনি চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশের নির্মাতাদের মধ্যে ১৯৭১ নিয়ে যে আগ্রহ বা আবেগ তা ১৯৪৭ নিয়ে নেই! ১৯৪৭ এর 'দেশ বিভাগ' বা 'নয়া দেশ গঠন' নিয়ে বাংলাদেশে যে লিখিত সাহিত্য (গল্প, উপন্যাস) এবং যে ভিজুয়াল সাহিত্য (সিনেমা, নাটক) তাতে সনাতনধর্মীদের কথাগুলো উঠে এসেছে!
কিন্তু পূর্ববঙ্গ এর বাইরে থেকে বা পশ্চিমবঙ্গ বা আসাম, কোঁচবিহার, ত্রিপুরা থেকে যে মুসলমান জনগোষ্ঠী পূর্বপাকিস্তানে এসেছে তাদের দাঙ্গায় আক্রান্ত হওয়া, ভিটেমাটি ছাড়ার বেদনা, পূর্ববঙ্গের মানুষের মধ্যে এসে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম অথবা বিহার থেকে আসাদের পাকিস্তান রক্ষার '(অপ)তৎপরতার' পরিষ্কার চিত্র আমরা চলচ্চিত্রে পাইনা৷ এ নিয়ে ফাহমিদুল হকের প্রশ্ন একটি যৌক্তিক প্রশ্ন।
গেরিলা চলচ্চিত্রের উদাহরণ দিয়ে আমাদের সেকুলার নির্মাতারা কীভাবে পলিটিকাল এজেন্ডার সফট টুল হিসেবে সিনেমা বানান সেটিকে ব্যাখ্যা করেছেন ফাহমিদুল হক।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় তিনি আলাপ করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নৃবিজ্ঞানী অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে। বক্তব্যের শুরুতে জাতির যে সংজ্ঞায়ন করেছেন তার একটি 'Imaginary society' এবং কারো জন্য যা কল্পিত সমাজ, অন্য কারো জন্য তা 'রাজনৈতিক কারাগার' (Political Prison)।
যদিও ফাহমিদুল হক যে উদাহরণ দিয়েছেন সেটি আমি দিবো না, কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের মিডিয়ার (ফিল্ম, নাটক, নিউজ) কনটেন্ট বিশ্লেষণ করলে দেখবেন 'বুর্জোয়া ডমিন্যান্ট ক্লাস' (স্যার খুব সম্ভবত 'ক্লাস স্ট্রাগল' শব্দ পরিহার করেছেন) যা ভাবে, যা সংজ্ঞায়িত করে সেটিকেই অন্যদের বিশ্বাস করতে হবে এমন একটি স্ট্যাটাস কো আছে, বুর্জোয়ারা বা তাদের সঙ্গী পাতিবুর্জোয়ারা নিজেদের পছন্দের কনসেন্ট ম্যানুফ্যাকচার করে প্রপাগেইট করে৷ তখন অন্যরা কী করে?
তারা এই কন্টেন্টের কালেক্টিভ ইমাজিনারি আইডেন্টিটি এর সাপেক্ষে নিজেদের অদৃশ্য শিকলে বেঁধে ফেলা নাগরিকও ভাবতে পারে। একে নোয়েলে নিউম্যান বলেছেন 'স্পাইরাল অব সাইলেন্স'। আমরা বলতাম 'নীরবতার কুণ্ডলী'। কখনো ক্যাথার্টিক ইন্টারেকশনও দেখা যায় (সেফুদা, হিরো আলমদের জনপ্রিয়তা)।
আমার আর্গুমেন্ট এখানে ফাহমিদুল স্যারের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। আমি বলতে চাই, এই মিডিয়া নিয়ন্ত্রণকারীরা 'সংখ্যাগুরু' হবে এটি 'প্রিজন-ইফেক্ট' এর জন্য অত্যাবশ্যক নয়, প্রাকটিক্যালি সংখ্যাগুরু 'পাওয়ারফুল' নাও হতে পারে। 'সংখ্যায় কম' হলেও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের 'রাজনৈতিক কারাগারে' নিক্ষেপ করা যায়৷ কীভাবে যায় সেটি ফাহমিদুল হক আলাপ করেননি, কারণ তিনি ফিল্ম কন্টেক্সট এর বাইরে হয়তো আসতে চাননি সব সময়। আমি বক্তব্য এর শেষে এ নিয়ে ছোট্ট একটু আলাপ করছিলাম। আপনি কি অনুভব করেন কীভাবে বর্তমানের বাংলাদেশে গুটিকয়েক লোকের 'কল্পিত সমাজ' বা 'চেতনা' আপনাকে 'রাজনৈতিক কারাগার' এ নিক্ষেপ করেছে?
অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের এই বক্তব্যটি আপনি শুনতে পারেন।
এর আগে তারেক মাসুদের সঙ্গে নানা সময়ে কাটানো স্মৃতিচারণও দারুন লেগেছিল।
0 Comments