সংকীর্ণ স্বার্থে হক্বপন্থী খলিফা হযরত আলী (রা) এর ওপর জুলুম করা বন্ধ করুন
~®~
ইবনে তাইমিয়ার অনেক লেখা আপনি ইতিবাচক পাবেন, কিন্তু তার লেখার অধিকাংশ ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের ঐক্যের জন্য প্রতিবন্ধকতা। 'অনিচ্ছাকৃত বা বিপরীত' ঘৃণা ও বিদ্বেষের প্রচারও আছে। যারা ঈমান এনেছে এমন মানুষদের তাকফির করারও ওকালতি আছে। আর আছে রাসূলে পাক(স) যে আলী (রা)কে হক্বের মানদণ্ড বলে গেছেন তাঁর 'সমালোচনা'!
দেওবন্দী বনাম মওদুদিবাদীদের পুরোনো দ্বন্দ্ব 'সাহাবীদের সমালোচনা' আবার বিশেষ কারণে উঠে আসায় অনেক মওদুদীপন্থী আবার ইবনে তাইমিয়া আলী (রা) এর ব্যাপারে যে অন্যায় অভিযোগ দিয়েছিল তা সামনে এনেছে। মওদুদী রক্ষায় তারা তাইমিয়াকে ব্যবহার করছে—আর আমাদের রাসূলঘোষিত মওলার ওপর জুলুম করছে।
অনেক আমির মুয়াবিয়া (রা)পন্থীও আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (বৈধ খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন)কে একই কাতারে ফেলতে লেখালেখি করছেন! আহলে হাদিস নামে পরিচিতরাও ঘৃণা ছড়াতে আহলে বাইতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে, আলী (রা) এর ওপর জুলুম করছে।
প্রকৃতপক্ষে আলী (রা) এর মর্যাদার ধারেকাছেও আমির মুয়াবিয়া (রা) নাই। এ স্বত্তেও ইবনে তাইমিয়াপন্থীরা এবং মওদুদীরক্ষাবাদীরা এ দুইজনকে এক কাতারে এনে আলী (রা) তথা রাসূল (স) এর ওপর জুলুম করছেন। এরাও সাহাবীবিদ্বেষী না?
হযরত আলী (রা) এর চেয়ে মর্যাদায় বড় তাঁর সমবয়সী সাহাবী (রা) পাওয়া যাবে? রাসূল (স) বলেছেন, আমাকে যারা মওলা ভাবে, আলীও তাদের মওলা। আলী (রা) এর স্ত্রী ফাতেমা (রা) জান্নাতে নারীদের সর্দারনী, আলী (রা) এর সন্তানদ্বয় জান্নাতের যুবকদের সর্দার। আলী (রা) এর পিতা আবু তালেব ইসলামের দুঃসময়ে রাসূল (স)কে সুরক্ষা দিয়েছেন! আলী (রা) জীবনে একটিবারের জন্যও রাসূল (স)এর নির্দেশ অমান্য করেননি।
২)
গোঁড়া জ&#ঙ্গীদের গুরু হিসেবে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে ওহাব পরিচিত। এদের বিশ্বাসের একটা ক্রম আছে। হক্বপন্থী খলিফা আলী (রা) আর খলিফার ওপর ইনসাফ না করে বিদ্রোহী মুয়াবিয়া (রা)কে এক কাতারে ফেলা; খেলাফত কেবল আরবদের জন্য বৈধ এই সাম্যবাদী ইসলামবিরোধী কথা প্রচার করা; কারবালায় এজিদ জালেম অনেকটা নিরপেক্ষ এই কথা বলা; জালেম এজিদও সাহাবী এটা বিশ্বাস করা; ইমাম হোসাইন (রা) শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে বলে তার রক্ত হালাল (অথচ মুয়াবিয়া খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও তিনি বিশাল 'হক্বপন্থী'!); সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবেনা; সাহাবী (রা) বিশেষ করে আহলে বাইতের কবর জেয়ারত করা যাবেনা ইত্যাদি। এই বিশ্বাস থেকেই এরা তাকফির করে বিরুদ্ধমতের ব্যাপারে!
খারেজি ওহাবীদের গুরু তাইমিয়া থেকে ওহাব থেকে আজকের যুগের সালাফি নামধারীরা এই ক্রম অনুযায়ী অপরকে কাফের, মুরতাদ ঘোষণা করে তাদের রক্ত হালাল করেছে, করছে—এদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত না করলে ভবিষ্যতেও করবে!
৩)
সিরিয়া ইরাকের আইএস খারেজি সন্ত্রাসীরা এই বিশ্বাসেরই প্রাকটিক্যাল রূপ। বাংলাদেশের জেএমবি ইত্যাদি।
মনে আছে, ২০১৩-২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে আইএস ইরাক, সিরিয়া শিয়াদের ধরে ধরে পাইকারি হারে জবাই দিতো? অথচ জীবনে ইসরায়েলের সীমান্তে একটা ঢিলও ছোঁড়েনি। শিয়ারা আলী (রা) ভালোবাসে, হোসাইনের জন্য মাতম করে বলে তারা নাকি 'কাফের' এবং রাসূলের প্রিয়দের ভালোবাসার অপরাধে তাদের হত্যা করা নাকি জায়েজ! কত বড় বর্বর সাহাবীবিদ্বেষী এরা ভেবেছেন? এই জাহেল ও জালেমরা এবং তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসীরাই হযরত আলী (রা) এর ওপর জুলুমকারী।
৪)
হযরত আলী (রা) হক্বপন্থী খলিফা ছিলেন। হক্বপন্থী খলিফার বিরুদ্ধে অন্যায় বিদ্রোহ করলেই তো সে বিচ্যূত। খলিফা আলী রা কে আমির মুয়াবিয়ার কাতারে আনা মানেই রাশেদিন খলিফার ওপর জুলুম করা। সাহাবি বিদ্বেষ ধারণ করা।
আলী (রা) উসমান (রা) এর হত্যাকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন—এগুলো ঐতিহাসিক মিথ্যাচার খারেজিদের থেকে। উসমান (রা) এর হত্যাকারীদের আলী (রা) কমান্ডার বানাবেন কেন? আলী (রা) এই হত্যাকারীদের দ্বারা বেষ্টিত ছিলেন।
যাদের ইনসাফ, হক্ব ও রাজনৈতিক জ্ঞান আছে তারা কখনো ভালনারেবল কনডিশনে থাকা শাসককে দায়ী করবেনা। বরং ঐ নাজুক পরিস্থিতিতে আলী (রা) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে তাকে শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ দেওয়া জরুরি ছিল।
জাহেল মওদুদিবাদকে সমর্থন বা বিরোধিতা করতে গিয়ে আলী রা এর বিরুদ্ধে বলতেছেন কেউ কেউ, একটু বুকটা কাঁপেনা তাদের?
রাসূল (স) বলেছেন, আমি যার মওলা, আলীও তাঁর মওলা। ভেরি সিম্পল এই হক্বের পথ—সিরাতুল মুস্তাকিম। সত্যের মাপকাঠি হযরত আলী মওলা (রা) এর ভুল ধরার চেয়ে বিচ্যূত হওয়ার আর স্পষ্ট পথ নাই এই যুগে—এই মুহুর্তে!
কেবল জামাতি মওদুদী কী করছেন সেটি দেখার বিষয় না। মওদুদি, দেওবন্দী, ওহাবী, সালাফি যারাই রাসূল (স) কে ভালোবাসবে তাদের উচিত নয় আল্লাহর রাসূল (স) প্রিয়জনের নিন্দা করা, তাদের নামে মিথ্যাচার করা!
৫)
একজন মুমিন তো রাসূল (স) এর প্রিয়জন যারা হক্বের জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাদের ভালোবাসবেন। হাদিস অনুযায়ী, আমাদের মওলা আলী (রা)। উসমান রা এর শহীদ হওয়ার দ্বায় আলী (রা) কে দিতে চাওয়াই সাহাবি বিদ্বেষ, রাসূল বিদ্বেষ।
উসমান রা এর বিরুদ্ধে রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে খলিফা আবু বকর (রা) এর সন্তানও অংশ নেয় বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ৷ হযরত আলী (রা) বা তাঁর কোন সন্তান এই অভ্যুত্থানের ধারেকাছেও যাননি৷ আলী (রা) সেই ক্রান্তিলগ্নেও স্বেচ্ছায় খলিফা হতে চাননি, যেভাবে আগের তিনবারও স্বেচ্ছায় চাননি রাসূল (স) এর স্পষ্ট হাদিস গাদিরে খুম থাকার পরেও। জোর করেই বলা যায় তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি উম্মাহর কল্যাণে এ দায় নেন।
আলী (রা) হেজাজের উমাইয়া গোত্রসহ অন্যান্য গোত্রের কিছু লোকের বাটপারি ও জিঘাংসা থেকে সুরক্ষা পেতে খেলাফতের রাজধানী আস সুমারিয়া তথা ইরাক তথা আজকের কুফায় নিয়ে যান। সেখানেও খারেজি আর মুনাফেকদের কারণে তিনি স্বস্তিতে ছিলেন বলা যাবেনা।
তাঁর সন্তানকে নির্মমভাবে পানির অভাবে যন্ত্রণা দেওয়া হয়, কাফের ঘোষণা করে নিরস্ত্র কাফেলার নেতা হোসাইন (রা)কে জবাই করা হয় এই মুনাফেক খারেজিদের নির্দেশে—সেই যুগের এই সাহাবী (রা) বিদ্বেষীরা এই যুগেও আছে।
মহররম এলে দেখবেন ইমাম হোসাইনের বিপ্লব বাদ দিয়ে মুয়াবিয়া আর এজিদের স্তুতিতে ব্যস্ত এরা—জুমার খুতবায় কেনো নবী (স) এবং তাঁর পরিবারের অনেকের নাম ধরে 'রাজিয়াল্লাহু তায়াল আনহুম' বলা হয় তার ঐতিহাসিক কারণ অনুসন্ধান করে গভীরভাবে চিন্তা না করেই।
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু হক্বের আলাপ:
১। হযরত আলী (রা) এর হক্বের পথে থাকার জন্য হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা) এর আলী (রা) এর পক্ষে কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করে শহিদ হওয়াই যথেষ্ট। হানাফি ঘরের আমাদের কাউকে এই হাদিসটি জানায়না আলেম নামের অনেকে।
২। হযরত তালহা (রা) ও জুবায়ের (রা) আলী (রা) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি। আলী (রা) তাঁদের মুখোমুখি হলে তাঁরা রাসূল (স) এর থেকে আলী (রা) এর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ হাদিস স্মরণ করে যুদ্ধ না করে চলে যান। পথিমধ্যে খারেজিরা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় (জাকারিয়ার মতে, উমাইয়ারা এটা পরিকল্পিতভাবে করে।)
৩। আম্মাজান আয়েশা (রা) হক্বপন্থী বৈধ খলিফা হযরত আলী (রা) এর বিরুদ্ধে উটের যুদ্ধে অংশ নিয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলেও আলী (রা) উম্মুল মুমিনিন ও শ্বাশুড়ি হিসেবে তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় হেফাজত করেন। আয়েশা (রা) সারাজীবন এই যুদ্ধের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হন। মুয়াবিয়া (রা) বা তার জালেম আওলাদ হক্বপন্থী খলিফার বিরুদ্ধে অন্যায় বিদ্রোহ করার বিষয়ে কোনোদিন অনুশোচনাবোধ করেছেন বলে রেওয়াত আছে?
৪। আলী (রা) ছিলেন খলিফা। হক্বের ওপর অবিচল খলিফা। তিনি সময় নিয়ে উসমান ইবনে আফফান (রা) এর হত্যাকারীদের বিচার করবেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপরও তাড়া দিয়ে তাঁকে দুর্বল করে, তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করে উসমান হত্যার বদলার জন্য চাপ দিয়ে সিফফিনের যুদ্ধ শুরু করার দায় ষোলয়ানাই আমির মুয়াবিয়ার বাহিনীর ওপর যায়—ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সামরিক সমস্ত দৃষ্টিকোণে। কারণ, মুমিনদের দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগলে আগে যারা আক্রমণ করে তাদের শায়েস্তা করার কথা কোরানে আছে। এ কারণে জামালের যুদ্ধে বা সিফফিনের যুদ্ধে আলী (রা) এর ওপর ফরজ হয় এই বিদ্রোহ দমন করার। তথাপি একটিবারের জন্যও তিনি বা তাঁর বাহিনী কাউকে আগে আক্রমণ করেননি৷ এ কারণে কোরান-সুন্নাহ অনুযায়ী এই সকল যুদ্ধে শহীদদের রক্তের দায় পড়বে মূলত খলিফাবিরোধিদের ওপর।
আমরা ছোট্ট একটা মানুষ। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাদেরকে এই বুঝ দিলেন, সিরাতুল মুস্তাকিম চেনালেন আর বড় বড় পণ্ডিত, নামের আগে টাইটেলের বন্যা বয়ে যাওয়াদের কপালে হেদায়েত জুটলোনা! আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিন। আমিন।
৫। আলী (রা) চেষ্টা করেছিলেন, যেন রক্তপাত এড়িয়ে যাওয়া যায়। এ জন্য আমির মুয়াবিয়াকে মল্লযুদ্ধের জন্য ডাকেন। মুয়াবিয়া আলী (রা) এর শৌর্যবীর্য সম্পর্কে জানেন। মুয়াবিয়ার মা হিন্দার (রাসূল স এর প্রিয়তম চাচা হামজা রা এর কলিজা চিবায় খাওয়া জঘন্য ব্যক্তি) বাবা উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা তথা মুয়াবিয়ার জালেম নানাদের ভবলীলা সাঙ্গ তো আলী (রা) ও হামজা (রা) এর হাতে হয়। এ কারণে সে এই মল্লযুদ্ধে অংশ না নিয়ে যুদ্ধ করে! যুদ্ধে আবার হেরে যেতে গিয়ে বর্শার আগায় কোরান বেঁধে প্রতারণা করে!
একবার ভাবুন—আসছিল উসমান (রা) এর বিচার চাইতে, এসে নিজেকে খলিফা বানানোর আবদার করে বসলেন! মুয়াবিয়া আমির হয়ে উসমান (রা) এর হত্যাকারীদের বিচার করেছেন? বিচার করছে এর কোনো একটি দলিল কেউ দেখাতে পারবেনা। কেনো করলো না—এই মৌলিক প্রশ্নই তুলতে পারবেনা এই করুন অবস্থা দাঁড়াইছে আমাদের কথিত আলেম নামের জাহেলদের।
আল্লাহ আমাদের সবার ঈমান রক্ষা করুন। আহলে বাইত তথা রাসূল (স) এর ওপর যেন ভুলেও জুলুম না করি সেই প্রার্থনা করি। কারণ, বিদায় হজ্বে রাসূল (স) দুটি জিনিস রেখে গেছেন আমাদের বিচ্যূতি থেকে সুরক্ষাকবচ হিসেবে—
১। পবিত্র কোরআন এবং
২। আহলে বাইত (যার পরিবর্ধিত ব্যাখ্যায় অনেকে বুখারিসহ বেশ কয়েকজনের সংকলিত হাদিসের কথা বলে থাকেন। তবে তাতে রাসূল (স) এর পরিবারের আদর্শ যা আছে সেদিকে আলাপ আমাদের মুন্সিদের অনেকেরই আগ্রহের বিষয় নয়)।
0 Comments