সর্বশেষ

আহমদ ছফা : সৃজনশীলতা যাঁর পিছু ছাড়েনি

সহজ সরল প্রকাশভঙ্গী; প্রতিটি বাক্যই যেন একেকটি পটভূমি; সম্পূর্ণ সৃষ্টিকর্ম মানুষের বাস্তব জীবনের জীবন্ত প্রস্ফুটন এই হচ্ছে একজন আহমদ ছফার লেখার বিশেষত্ব। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে কয়েকজন সাহিত্যিক কালের বিবর্তনে অপরিবর্তিত রয়েছেন তাদের মধ্যে আহমদ ছফা অন্যতম।(VIDEO: ইভটিজিং যে করে তার বোনকে যখন অন্য কেউ ইভটিজ করে?)
চট্রগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন জন্ম হয়েছিল এই মহান সাহিত্যদিশারীর। আহমদ ছফা পিতা হোদায়েত আলী ও মাতা আসিয়া খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন।
আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১)

আহমদ ছফার শিক্ষাজীবন ছিল বৈচিত্রময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। তবে পড়া শেষ করতে পারেননি। তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক আহমদ শরীফের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে আহমদ শরীফ তাঁর সঙ্গে দুব্যর্বহার করেন। শিক্ষকের ওপর রাগ করে তিনি পড়াশোনা না করে বাংলা বিভাগ থেকে বেরিয়ে যান। পরে ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে ব্যক্তিগতভাবে স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমীর পিএইচডি গবেষণার জন্য মনোনিত হন যা তাকে পরবর্তীতে মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে লিখতে উৎসাহ ও উদ্দীপন যোগায়। ১৯৭১ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পর তাঁর আর একাডেমিক লেখাপড়া হয়নি। এরপর ১৯৮৬ সালে জার্মান সরকার তাকে গ্যাটে ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে একটি গবেষণা বৃত্তি দেয়। এই বৃত্তি তাঁকে পরবর্তীতে জার্মান ভাষায় দক্ষ করে তোলে এবং গ্যাটের বিখ্যাত গ্রন্থ ফাউস্ট বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে উৎসাহ যোগায়।
(VIDEO:১৮ টা বিয়ে করার পর করুণ অবস্থা এই ছেলের)
বাংলা সাহিত্যে এমন কোন শাখা নেই যেখানে আহমদ ছফা বিচরণ করেননি। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ এমনকি ইতিহাস পর্যন্ত লিখেছেন আহমদ ছফা। তবে এ কথা অপ্রিয় ও দু:খজনক হলেও সত্য চর্চা ও প্রচারণার অভাবে আহমদ ছফার সব রচনা পাঠক-সাধারণের কাছে পেীছুতে পারেনি। এই দায় এদেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং সবকটি সরকার কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেনা।   
(VIDEO:অপু বিশ্বাসকে নগ্ন অবস্থায় অন্য নায়কের সাথে ধরেছেন শাকিব খান)
প্রথাগত সামাজিক অসঙ্গতি,সমাজতন্ত্রের বর্তমান পেক্ষাপট ও ভবিষ্যত্ বিশ্বব্যবস্থা, বামপন্থীদের জনসাধারণ থেকে বিচ্যুতির নিগূঢ় কারণসমূহ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত, মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির বিশুদ্ধ ইতিহাস রচনায় অভাবনীয় নিপুণতা দেখিয়েছেন আহমদ ছফা। তাঁর অভিনব রাষ্ট্র র্দশন এখন সাহিত্যপ্রেমী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে তুমুল আলোচনার বিষয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে বিচরণ করতে চায় তার প্রথম পছন্দের মধ্যে অবশ্যই আহমদ ছফা থাকেন। এর কারণ ছফার লেখার বিষয়বস্তু তার মৃত্যর সঙ্গেই মুছে যায়নি ,বরং বিপুল প্রজ্ঞার অধিকারী আহমদ ছফার বিচক্ষণ লেখাগুলো সমাজ, কাল ও প্রেক্ষাপটের ঊর্ধে¦ উঠে আজ এতকাল পরে সাহিত্যপ্রেমী ও জ্ঞানপিপসুদের আকৃষ্ট করছে।(VIDEO: মাশরাফির অবসর ঘোষণায় সাধারণ মানুষের আহাজারি দেখুন)
আজকে আমরা যে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদকে পেয়েছি তিনি তো আহমদ ছফারই নিজ হাতে গড়া, কিন্তু কজন তা জানে? হুমায়ুন আহমদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের ভূমিকা লিখেছিলেন আহমদ ছফা। হুমায়ুন সেই কথা কোনদিন না ভুললেও হুমায়ুনপ্রেমীরা ঠিকই ভুলে গিয়েছে। আজকে ব্রাত্য রাইসু যে কিছু লেখে এর পিছনে আহমদ ছফার স্নেহ কাজ করেনি বলে রাইছু কখনো অস্বীকার করেননি। ছলিমুল্লাহ খান নামের যে বুদ্ধিজীবী বা দার্শনিকককে আমরা পাই তার জ্ঞান ও প্রসারতার কারণ এই আহমদ ছফাই।

উপন্যাস এর প্রকৃত সৌন্দর্য যদি কেউ পেতে চায় তবে তাকে অবশ্যই আহমদ ছফার উপন্যাসগুলোর একটি অন্ততপক্ষে পড়তে হবে। ১৯৬৭ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত ' সূর্য তুমি সাথী ' বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতম ধারার  পাশাপাশি সম্পর্কের নানামাত্রিক দ্বন্দের সৃষ্টি করেছে। এ উপন্যাসে প্রেমের কারণে ধর্মান্তরিত একটি পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের অস্তিত্ত্ব সংকটকে নিপুণ হাতে বর্ণনা করেছেন আহমদ ছফা। এ উপন্যাসটি স্বাধীনতার আগেই তিনি লেখা শুরু করেন। ছফা বলেছিলেন, এই উপন্যাসটি অচিরেই বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাসের তালিকায় চলে যাবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। যারা এই উপন্যাস একবার পড়েছেন তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছেন এবং একবারেই সবটুকু পড়ে শেষ করেছেন এবং তারপর বলতে বাধ্য হয়েছেন, ছফাই সঠিক।
(ভিডিও: ফুলকুচি বা টেঁটা দিয়ে মাছ কোপানো)
(ভিডিও: আঁখি আলমগীরের শরীরের বিষ দেখুন)
(ভিডিও:সেইন্টমার্টিন্স যাওয়ার আগে এই ভিডিওটি দেখবেন একবার)
আহমদ ছফা রচিত 'ওঙ্কার' হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। একটি বোবা মেয়ের জীবনের সঙ্গে সংগ্রামকে একীভূত করে কি এক অদ্ভূত উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন ছফা সেটা যারার এ উপন্যাস পড়েছে তারা বুঝতে পেরেছে। চিরকুমার আহমদ ছফার জীবনে যেসব নারীদের আগমন ঘটেছে তা নিয়ে তিনি লিখেছেন তাঁর অন্যতম আলোচিত উপন্যাস “ অর্ধেক মানবী অর্ধেক ঈশ্বরী”। এই উপন্যাসে তিনি ব্যক্তিগত ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে নারী-পুরুষের সম্পর্কের অপ্রকাশিত কিছু দিক নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। এই উপন্যাসটির মাধ্যমেই আমরা প্রয়াত সর্বহারা আন্দোলনের  বিপ্লবী সিরাজ শিকদারের বোন নিভৃতচারী শামিম শিকদারের ব্যাপারে জানতে পারি, জানতে পারি ভাইয়ের কারণে বিভিন্ন সময়ে শামিম শিকদারকে কতটুকু প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে।
গান লিখেছেন অনেক।গাইতেনও ছফা।

১৯৭১ সালে কলকাতায় অবস্থিত বাড়িতে প্রবাসী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও কর্মকর্তা কর্মচারী কিংবা কিছু লোকের নানা দুর্নীতি, অনৈতিকতা ও দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে উদাসীনতাকে যারা মিথ্যা ভাবেন তারা আহমদ ছফার সাহসী উপন্যাস “ অলাতচক্র ” পড়তে পারেন। এই উপন্যাসে অতি সুনিপুণভাবে কলকাতায় অবস্থানের সময়ে এদেশের কথিত কিছু দেশপ্রেমিক ব্যক্তি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে কি কি ভাল ও অভাল করেছেন নিজের কলকাতার জীবন বর্ণনার মাধ্যমে আহমদ ছফা তা প্রবল বিক্রমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে সমালোচনার পরেও ছফা বাংলাদেশর স্বাধীনতার ইতিহাসে আওয়ামী লীগকে সবসময় অগ্রাধীকার দিতেন। ছফাই করেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি যা এখনো আলোচিত হয়। আলোচিত সেই উক্তিটি হলো: আওয়ামী লীগ জিতলে কেবল আওয়ামী লীগই জেতে আর আওয়ামী লীগ হারলে হারে পুরো বাংলাদেশ। স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্ম ব্যবসায়ী অপশক্তিকে সর্বদা ঘৃণা করতেন ছফা, লিখতেন তাদের বিরুদ্ধে। বামপন্থীদের নানা ত্রুটি ও বিচ্যুতি এবং সূক্ষ ফাঁকিবাজিও লেখনির মাদ্রমে জাগিয়ে তুলতেন আহমদ ছফা। সম্ভবত এসব কারণে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আহমদ ছফা চর্চায় ততটা উৎসাহী নয়।
(ভিডিও: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভ্যানচালক এসব কি বলছে?)
বাংলাদেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যেসব অনাকাঙ্খিত স্বার্থপরতা ও কলুষিত শিক্ষক রাজনীতি চলে তা আমাদের অনেকের কাছে অজানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি ,তাদের নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যূতি, দলবাজি, জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রভাব, শিক্ষক নিয়োগে নীতি বিসর্জন, শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের স্বজনপ্রীতি ও পরিবাবরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গোপন কথা জানতে আগ্রহী হলে আহমদ ছফা রচিত তার জীবনের অন্যতম সেরা উপন্যাস “ গাভী বিত্তান্ত ” পড়তে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ, সভাপতি ও ডীন নিয়োগ এমনকি  হলের আবাসিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও কী পরিমাণ রাজনীতি চলে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফাকে নিয়ে গবেষণাকারী অনেকে বলেছেন,এই উপন্যাসটি লেখার কারণে সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের শিক্ষার্থীদের আহমদ ছফার রচনা পড়াতে বা পড়তে আগ্রহ প্রদান করেননা।
একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন, মরণবিলাস, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরান আহমদ ছফার আরো কয়েকটি উপন্যাস। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত “ পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরান ”  ব্যাপক সমাদৃত হলে দুই বছর পর এ উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়।
(ভিডিও: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগ)
আহমদে ছফা গদ্য কবিতায় নতুনত্ব এনেছেন। তাঁর 'লেনিন ঘুমোবে এবার ' বিষয়বস্তু ও শব্দচয়ন উভয় দিক থেকে বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এ কাব্যে তিনি সাম্যবাদের নিখুঁত বিশ্লেষণ করেছেন যুগের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে। ' দুঃখের দিনের দোহা 'ও ' একটি প্রাচীন বটের কাছে প্রার্থনা' কাব্য বাংলা সাহিত্যে নতুনত্বের অন্যতম ধারক । “ জল্লাদ সময় ” লিখে তিনি সমসাময়িক রাজনীতিবিদ ও তাদের অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানান। “ জল্লাদ সময় ” ১৯৭৪ সালের কাব্যিক রূপ।
(ভিডিও: বঙ্গবন্ধুর কবর, পৈতৃক বাড়ি ও টুঙ্গিপাড়ার সমাধি )
আহমদ ছফার একটি অসামান্য কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি সমালোচনাকে শৈল্পিক ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত করেছেন। অন্যের সাহিত্যকর্মের স্বার্থকতা ও ব্যর্থতার গঠনমূলক সমালোচনাও যে একটি সাহিত্য-এ সত্য আহমদ ছফাই আবিষ্কার করেছিলেন। তসলিমা নাসরিনকে তিনি বলতেন “ ভারতের ছেড়ে দেওয়া উপগ্রহ ” যার কাজ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা। হুমায়ূন আজাদকে তিনি বলতেন উদ্ধত ও অহংকারী। সমসাময়িক কোন সাহিত্যিকই নীতি আদর্শে অটুট থাকতে না পারায় আহমদ ছফার সঙ্গে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী  হয়নাই।
“ বঙ্কিম রচনাবলী ” নামক সমালোচনাগ্রন্থে তিনি সমালোচনার প্রখরতা দেখিয়েছেন। এ প্রবন্ধে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যক্তিজীবনের সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে তার সাহিত্যের প্রতিটি স্তরে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তার আগে এ সত্য আর কোন সাহিত্যিক বলতে সাহস করেননি। তিনি স্বণামধণ্য সাহিত্যি অধ্যাপক আহমদ শরীফেরও সমালোচনা ও প্রশংসা উভয়ই করেছেন।
(ভিডিও: মুজিববাদ আসলে কি ছিল তা শুনুন বঙ্গবন্ধুর নিজের মুখে)
আহমদ ছফার আরেকটি পরিচয় তিনি একজন সফল প্রাবন্ধিক। তাঁর “ জাগ্রত বাংলাদেশ ” ও “ উপলক্ষের লেখা ” দুটি অতুলনীয় প্রবন্ধ গ্রন্থ । এর মধ্যে জাগ্রত বাংলাদেশ হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। “ বাঙালি মুসলমানের মন ” প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৃতাত্বিক বিবর্তন পর্যালোচনা করে তিনি আলোড়ন তুলেছিলেন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মুসলমানদের মনস্তাত্বিক বিবর্তন ও পরিবর্তন জানার জন্য আহমদ ছফার এ প্রবন্ধের সহায়তা নিতে বাধ্য হন গবেষক ও সমালোচকরা।
আহমদ ছফা অনেক বেশি পরিমান রাজনীতি সচেতন সাহিত্যিক ছিলেন। রাজনীতিকে চোরের মত পাশ কাটিয়ে যাওয়াকে তিনি জনগণের সাথে প্রতারণা বলে মনে করতেন। সমসাময়িক লেখকেরা যেখানে প্রকাশ্যে রাজনীতিকে এড়িয়ে গেছেন অথবা কোন না কোন রাজনৈতিক বিচ্যুত আদর্শের সাথে যুক্ত হয়েছেন সেখানে আহমদ ছফা নিজ আদর্শ, বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বে অটুট ছিলেন। তাঁর রচনা কোন প্রতিবন্ধকতা ও পাশবিকতা অথবা রাজনৈতিক লাঠিয়ালদের ভয়ে কখনেই ভীত হয়নি। যদি কোন পাঠক তাঁর দুঃসাহসিক ও অভূতপূর্ব উপন্যাস “অলাতচক্র ” পড়ে থাকেন তবে আহমদ ছফার মাহাত্ম ও অবস্থান অনেকখানি বুঝতে পারবেন বলে আমি মনে করি। তিনি ১৯৭৫ সালে “ জল্লাদ সময় ” কাব্য প্রকাশ করে তৎ্কালীন রাজনৈতিক অবস্থার ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণকারীদের রোষানলে পড়েন। কোন কাব্য প্রকাশের পর আহমদ ছফাকে গ্রেফতারের ভয়ে এতটুকু সন্ত্রস্ত দেখা যায়নি বলে তাকে সচক্ষে দেখা মানুষদের বিভিন্ন স্মৃুতিচারণ থেকে জানা যায়। তাঁর অন্যকিছু আলোড়ন তোলা প্রন্ধগ্রন্থ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে (১৯৭৫), বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা (১৯৭৭), শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবনধ( ১৯৮৯), নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ (১৯৯৫), আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০০) ইত্যাদি।
(ভিডিও: বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরের স্মৃতিচারণ)
মানুষের স্বাভাবিক কথাবার্তাও যে সাহিত্য হতে পারে আহমদ ছফার সাক্ষাৎ্কারগুলো না পড়লে তা বোঝা যাবেনা । অনেক জটিল বিষয়, বিতর্কিত ব্যক্তি ও তাদের কর্ম, চলতি রাজনীতি,ধর্ম ও দর্শন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে প্রতিটি সাক্ষাৎকারকে একেকটি সাহিত্যকর্ম হিসেবে রেখে গেছেন আহমদ ছফা। জীবিত থাকতেই তাঁর সাক্ষাত্কারগ্রন্থ “ আহমদ ছফা বললেন...” প্রকাশিত হয়। প্রতিটি সাক্ষাৎকারে তিনি অগ্নিঝরা সত্যেও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। সাক্ষাতকারগুলোতে তিনি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে “ বঙ্গবন্ধু ” বলেননি কখনো। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন কংগ্রেস যেমন দেশবন্ধু বানিয়েছিল চিত্তরঞ্জনকে ঠিক তেমন কিছু এই শব্দটি। যদিও তাঁর মতের বিরোধীতাকারী অনেকেই রয়েছেন। আমার মতে, এটা ছিল ছফার গোঁড়ামী। কারণ সাধারণ জনগণ যে বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করেছেন সেই বঙ্গবন্ধুকে তিনি গ্রহণ না করতে পারা মানে তিনি গণবিরোধী একটি অবস্থানে চলে যান।
একজন সফল অনুবাদক হিসেবেও আহমদ ছফা নিজেকে পরিচিত করিয়ে গেছেন । গ্যেটের বিখ্যাত “ ফাউস্ট ” সর্বপ্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি। “ তানিয়া ” তাঁর আরেকটি  প্রশংসনীয় অনুবাদ কর্ম। ফাউস্ট অনুবাদের সময় তিনি জার্মান দূতাবাসের সহায়তা পান।
আহমদ ছফা শিশুদের জন্য “ গো হাকিম ” নামের ছড়া লেখেন। কিশোরদের জন্য তিনি লেখেন গল্পগ্রন্থ “ দোলো আমার কনকচাঁপা ”।

“ যদ্যপি আমার গুরু ” আহমদ ছফা জীবনের অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত এ গ্রন্থটি মূলত আহমদ ছফার নিজের লেখা আত্মজীবনী। এ জীবনীটি পড়ে ছফার ব্যক্তিজীবনের নানা কথা জানার পাশাাশি তার বিশ্বাস ও আদর্শ সম্পর্কে জানা যাবে।
আহমদ ছফা একজন সফল ঐতিহাসিকও ছিলেন বটে। ইতিহাস রচনার সময় তিনি সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও তথ্যেও সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন। উপমহাদেশের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৮৫৭ সালের বিখ্যাত “ সিপাহী বিদ্রোহ ” নিয়ে ইতহাস গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এ ইতিহাস গ্রন্থেে নাম “ সিপাহী যদ্ধের ইতিহাস ”। সিপাহী যদ্ধ সম্পর্কে অনেক না বলা কথা এ গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়। সেই সাথে এই সিপাহী যুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ ও এদেশীয় বর্ণহিন্দুদের দ্বারা সুবিধাবঞ্চিত মুসলমান ও শুদ্রবর্ণ হিন্দুদের উপর চালানো দমন, নিপীড়ণও এখানে প্রকাশিত হয়।
কখনো তথাকথিত প্রগতিবাদী দুশ্চরিত্র নাস্তিক, কখনো প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রহারা আস্তিক- মানবতার জন্য হুমকীস্বরূপ এই উভয় গোষ্ঠীর তীব্র বিদ্রপকারী ছিলেন আহমদ ছফা। এর জন্য তাঁকে কথনো “ মৌলবাদী”  অথবা কখনো “ নাস্তিক ” উভয় দলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে আহমদ ছফা সম্পূর্ণ অপরাজিত ছিলেন। ধর্মান্ধ অথবা ধর্মবিমুখ উভয়গোষ্ঠীই আজ পতনের শেষ পর্যায়ে- আহমদ ছফার বিশ্লেণের বাস্তবতা এটি।
(ভিডিও:জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১ তম আবর্তন)
ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত আহমদ ছফা এক বৈচিত্রময় ও সমৃদ্ধ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। জীবনের শুরুর দিকে সাম্যবাদ ছফাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে। এমনকি চট্রগ্রামে একবার কম্যুনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ট্রেনের লাইন উড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। তবে শেষ জীবনে হালকা ধর্মানুরাগী হয়েছিলেন ছফা। একারণেই তাঁর লেখায় কখনোই কোন ধর্মবিদ্বেষ পাওয়া যায়না।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমৃত্যু গর্ববোধ করেছেন আহমদ ছফা। ১৯৬৭ সালে প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের পরেই অধিকাংশ সাহিত্য রচনা করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাংবাদিক বলা যেতে পারে তাঁকে। তাঁর সম্পাদনায় ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা “ প্রতিরোধ” প্রকাশিত হয়।

প্রবল আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আহমদ ছফা বেঁচে থাকতে কারো প্রত্যয়ন অথবা নিন্দার তোয়াক্কা করতেন না । কলকাতার তথাকথিত বাঙালি বাবুদের এদেশপ্রীতি যে “ কেবল নিজেদের বইয়ের কাটতি বাড়ানো ” আহমদ ছফাই তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। আনন্দবাজার, দেশ এসব পত্রিকাকে তিনি পাত্তাই দিতেননা এবং এদেশের সাহিত্যিকদের ভারতপ্রীতিকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। কলকাতার কোন এক বই মেলায় বাংলাদেশের তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী (এবং বর্তমানও)  শেখ হাসিনাকে “ মূখ্যমন্ত্রী ” বলে ঘোষণা করায় ভারতের ও পশ্চিমবঙ্গের তীব্য সমালোচনা করেন আহমদ ছফা এবং এ নিয়ে সর্বপ্রথম তিনিই প্রতিবাদ লেখেন। এমনই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন আহমদ ছফা।
বেঁচে থাকতে কারো তোষামুদি করেননি কখনো। নিজকর্মের স্বীকৃতি সময় ও প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন আহমদ ছফা । তাই নিজহাতে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের “ লেখক শিবির পুরস্কার ” ও বাংলা একাডেমী থেকে দেওয়া “ সাদত আলী আখন্দ ” পুরস্কার সানন্দে এবং সগর্বে প্রত্যাখান করেছিলেন, যদিও মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া পুরস্কারটি প্রত্যাখানের কোন সুযোগ ছিলনা।
২০০১ সালের ২৮ জুলাই বাংলা সাহিত্যের আধুনিকীকরণে মূখ্য ভূমিকা পালনকারী এই প্রবাদপুরুষের জীবনাবসান ঘটে।
২০০২ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয় ।
অতুতোভায় এই কলমসেনার লেখাগুলো বেশি করে প্রকাশ ও প্রচারে কেন যে খুব উদাসীন আমাদের পত্রিকা, মিডিয়া ও সাহিত্যিকরা তা এখনো আমার মত শিশুমনের অধিকারীর বোধগম্য নয় !
“ আমার নির্ভীকতা ও সততা একদিন তরুনরা নিজ থেকেই খুঁজে নেবে ” এই সত্য বিশ্বাস করতেন আহমদ ছফা।
আহমদ ছফার সেই বিশ্বাসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তার প্রয়াণ দিবসে।
(২০১২ সালের ২৮ জুলাই গ্রামের বাড়িতে বসে লিখিত। পরে সম্পাদিত ও পরিমার্জিত। ঘাসফুল নামের সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত। চারকোল নামের সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত এবং বিভিন্ন পোর্টালে প্রকাশিত।)
পাঠ অনুভূতি