সর্বশেষ

চাপিয়ে দেয়া বিরাট অঙ্কের দেনমোহর : যৌতুকের অনালোচিত জাত ভাই


একটা লোকের সাথে কথা হলো আজ। সঙ্গত কারনেই তার নাম লিখছিনা। ধরুন, তার নাম ক। লোকটা খুবই বেচারা। বউ তাকে বেশ ঝাড়ির উপর রাখে। বউকে তালাক দিতে চান। আমি বললাম, দেখেন ভুলত্রুটি সবার থাকে। আপনারও নিশ্চয়ই আছে, আপনার স্ত্রীরও আছে। তালাক না দিয়ে সমঝোতা করতে পারেন। তিনি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ভাইরে ! সমঝোতা করেই এতবছর সংসার চালাচ্ছি। তালাক চাইলেই আমি দিতে পারবোনা। সেই ক্ষমতা নেই আমার। আমি বললাম, কেন ? আপনার ক্ষমতা আবার কে কেড়ে নিলো?( আমি ভাবলাম তিনি পুলিশ বা কেসাকেসির ভয়ে আছেন। অথবা তার সন্তানটির মাতৃত্ত্বহীনতার।) তিনি বললেন, আরে পড়াশোনা করে কি শিখতাছো ? কিছুই বোঝোনা? আমার বিয়ের সময় দেনমোহর লিখছে ৫ লক্ষ টাহা। এই টাহা আমি কই থেকে আইন্যা দেবো? আমি ছোটখাটো ব্যবসা করি,, দিন আনি আর খাই। তালাক দিলি এই টাহা আমার বউরে দিতে হবে...।

২।
আমি পরে ভাবলাম যা তার সক্ষমতার ধারেকাছেও নেই সেই পরিমাণ টাকা এই লোকটির উপর চাপিয়ে দেয়া কি একটি নিপীড়ণ না। এই দেনমোহর পদ্ধতিটার সবটুকু দায় ছেলের কাঁধে যায়। সুতরাং এটিকে যত সাধ্যের মধ্যে রাখা যায় তত ভাল। এটা এ কারণে নয় যে এটি তালাক দিতে উপকারী। এটি একারণে হওয়া উচিত যেন স্বামী বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই এটি তার স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। কারণ এটি স্ত্রীর প্রাপ্য ।অথচ দেনমোহরের পরিমাণ এত বেশি হয় যে , আমাদের দেশের কোন মেয়ে নিজের চোখে এই মোহর দেখছে কি না আমি সন্দেহ পোষণ করি। পরে বণিবণা না হলে তালাক বা ডিভোর্সের সময় এই টাকা নেয়া দেয়া নিয়ে বর ও কনে পক্ষের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব চলে। বিষয়টি চরম নিচু মানসীকতার প্রকাশ। সম্পর্কটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। দুটি মনের বেদনার জায়গাটি এই অর্থ লেনদেনে গিয়ে ঠেকে থাকে। কি নির্মম! কি জঘন্য!
আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নেয়া হয়, দেনমোহর কম হলে ছেলে তালাক দিয়ে দিতে পারে তাও তো উত্তম। কারণ টাকা দেয়ার ভয়ের যে ছেলে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেনা সে নানাভাবে দূর্ব্যবহার করে স্ত্রীকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই এমন মনোমালিন্য হলে ছেলে ও মেয়ের ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা যত দ্রুত হবে তত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।


৩।
আমাদের দেশে যে নারীবাদ চলে তা যেীতুক প্রথা নিয়ে যেভাবে সোচ্চার তার ছিটেফোঁটাও চড়া দেনমোহরের ব্যাপারে নয়। নারীবাদ ধর্মের সাথে বহু জায়গায় সংঘর্ষে লীপ্ত হয়। তবে কখনোই কোন নারীবাদীকে দেনমোহর প্রথার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়না। ব্যাপারটি এমন যে হিন্দু ধর্মের যেীতুক তার বিরুদ্ধে গেছে তাই এর বিরুদ্ধে নারীবাদীরা আর ইসলাম ধর্মের দেনমোহর তাদের আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে তাই এটির ব্যাপারে নিরব তারা। যেীতুক নি:সন্দেহে একটি নিকৃষ্ট অনাচার। আর যেসকল পুরুষ বিয়ের জন্য যোীতুক গ্রহণ করে তাদের মানুষ ভাবতে ঘৃণা হয়।আর দু:খ তখন লাগে যখন দেখি ছেলের পিতার পাশাপাশি তার মা,বোন, দাদী, নানী কিংবা ভাবী আরেক নারীর কাছ থেকে যেীতুক আনার ব্যাপারে একমত পোষণ করে এবং না দিলে সমানে নির্যাতন করে। এ ব্যাপারে নারীবাদ বা যেকোনবাদ যে প্রতিবাদ জানায় তা উত্তম ও প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু অযেীক্তিক, অতিরিক্ত ও বোঝাস্বরূপ যে দেনমোহর ছেলেটির উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তা নিয়ে নারীবাদ বা কোন বাদ কি আলোচনা করে? কেন করেনা? নারীর জন্য একজন পুরুষ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে অদৃশ্য এক দাসত্ত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা থাকে তা নিয়ে এ সমাজের কেউ কি নেই কথা বলার? আর কতকাল নিজের তীব্র অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও বিশাল অঙ্কের এ দেনা নিয়ে সংসার করবে স্বামীরা?


 বিষয়টি এমন যে ভালবেসে মেয়ে ও ছেলে বিয়ে করছে তবু অভিভাবকেরা এসে সেই দেন-দরবার শুরু করছেন। আর তার ঘানী টানছে ছেলে। এ কথা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে যে , প্রচারণা ও সচেতনতা এবং আইনী তৎপরতার কারণে বাংলাদেশে যেীতুকের প্রচলন একেবারেই প্রকাশ্যে নেই , এমন কি কেউ যেীতুক নিয়ে বিয়ে করলে সমাজে সে ঘৃণা ও অবজ্ঞা এবং উপহাসের পাত্র হয়। চমৎকার এক সামাজিক প্রতিরোধ অভিশপ্ত যেীতুক কুপ্রথার বিরুদ্ধে। কিন্তু চড়া দেনমোহর বেড়েই চলেছে। কাবিননামায় মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে অর্থের অস্ত্র তাক করে রাখা হচ্ছে স্বামীর দিকে। এ থেকে উত্তোরণ না হলে সামাজিক অশান্তি ও উৎকন্ঠা এবং দাম্পত্য দ্বন্দ্ব বেড়েই চলবে। আর একটা কথা, যারা ধর্মের কথা বলে দেনমোহর চালু রাখেন তাদের মতকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু অতিরিক্ত বা প্রতিযোগিতা করে চড়া দেনমোহর কি ধর্ম সমর্থিত? আচ্ছা, ধার্য দেনমোহর যদি বিয়ের রাতেই না দেয়া হয় তবে কি বিয়ে বৈধ হয়? যদি না হয়, তবে অতিরিক্ত দেনমোহর যােঐ বর ছেলেটির পক্ষে দেয়া অসম্ভব তা ধার্য করে নয়া দম্পতিকে বছরের পর বছর ধরে সামাজিকভাবে ব্যভিচার করানো হচ্ছে কি ?
এর দায়ভার কে নেবে?
অতিরিক্ত বিরাট অঙ্কের দেনমোহর আর যেীতুকের মধ্যে কোন তফাৎ আছে কি? জাত ভাইদের আলাদা করা যায় না। যায়?
পাঠ অনুভূতি