সর্বশেষ

সাবধান! শিয়া - সুন্নী বিভাজন তৈরি করবেননা, হে 'সাংবাদিক', হে মিডিয়া

এই যে গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত ১ টা ৫৫ মিনিটে শোকাবহ মহররমের তাজিয়া মিছিলের পূর্বরাতে পুরোনো ঢাকায় হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটলো এবং তা দেখছি আমাদের জাতীয়তাবোধহীন মিডিয়া অতিরঞ্জিত করে সম্প্রচার ও প্রচার করছে।এর যে কি ভয়াবহ প্রভাব রয়েছে তা এদেশের মিডিয়া মালিক ও সংবাদকর্মীরা অনুধাবন করতে পারছেনা অথবা অনুধাবন করে দেশকে War on Terrorism নামের সন্ত্রাসী প্রকল্পের দিকে ঠেলে দিতে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে নেমেছে।আন্তর্জাতিক রাজনীতিজ্ঞানহীন মিডিয়াকর্মীদের এই সাধারণ জ্ঞানটুকু নেই যে, এই ঘটনাকে কৃত্রিম সংকট(Pseudo Crisis)হিসেবে তুলে ধরা মারাত্মক একটি ভুল হবে।এর কয়েকটি কারণ এখানে উল্লেখ করছি-
১।
বাংলাদেশে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই,ছিলনা।এখানে শিয়া সুন্নী দাঙ্গাও কোনকালে হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ দেয়না।বরং শিয়া সম্প্রদায়ের নানা প্রভাব যেমন মর্সিয়া,কারবালার জারি,পুঁথি ও ইমামতি বিশ্বাস বাংলাদেশ প্রবল।ধর্মীয় শাখাগত বা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত(Sectarian conflict and Violance)কতটা ভয়াবহ রক্তাক্ত রূপ নিতে পারে তা আমরা ইরাকে দেখছি,ইয়েমেনে ও পাকিস্তানে দেখছি।এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জায়োনিস্ট মিত্র এক পক্ষকে মদদ দেয় এবং এই ধর্মীয় দ্বন্দ্ব কিছু দিনের মধ্যে রাজনৈতিক অংশীদারিত্ত্বের আন্দোলনে পরিণত হয়।শিয়া ও সুন্নীদের পারস্পরিক বিশ্বাস নষ্ট হওয়ায় উভয়পক্ষ বহিরাগতদের শরণাপন্ন হয়।শুরু হয় টিকে থাকার রক্তাক্ত লড়াই।হয় মারো,না হয় মরো।অতএব হোসেনী দালানের এই হামলা মিডিয়ায় গুরুত্ত্ব দিয়ে প্রচার করে দেশের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলা উচিত হবেনা।এটিকে ক্ল্যাসিফাইড করে দ্রুত সমাধান করতে হবে।দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
২।
বাংলাদেশে সৌদি আরবের নীতি তথা ওয়াহাবি ও ইবনে তাইমিয়ার রক্তাক্ত মতাদর্শের সমর্থক গোঁড়া শ্রেণীর কাছে শিয়ারা উত্তম মুসলিম বলে এখনো বিবেচিত নয়।এরা সাধারণত কওমী ও আলীয়া মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষক এবং ওয়াজ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের তৈরিকৃত অনুসারীগণ।সব কওমী আলেম শিয়াদের অমুসলিম ভাবে তা নয়,ইদানিং অনেক বিচক্ষণ আলেম মুসলিম ঐক্যের কথাও বলছে দেখেছি।তো যা বলছিলাম,এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ চার মাযহাবী অথবা লা মাযহাবী ও আহলে হাদীসের সৌদি আরবপন্থীরা শিয়াদের উপর তাকফির(কাফির ঘোষণার প্রক্রিয়া) করলে তা ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিতে পারে।তাই মিডিয়ার উচিত হবেনা ঘন ঘন শিয়া ও সুন্নী শব্দ ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উস্কে দেয়া।আগামীকাল যদি পত্রিকার প্রথম পাতায় 'শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা'(যদিও সেটি মিছিলের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল বলে সংবাদে এসেছে)এই সংবাদ হয় তবে তা মনোজগতে একটি বিভাজন রেখা এঁকে দেবে।কারণ এই ঘটনা ইরাকে মানায়,বাংলাদেশে এটি নতুন।ইরাকের ঘটনা দেখে অনুপ্রাণিত ঘুমন্ত সুন্নী নামধারী সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ অথবা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ওঁত্‍পেতে থাকা গোষ্ঠী এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে উত্‍সাহিত হতে পারে।অতএব এই ঘটনা ফলাও করে প্রচার ও সম্প্রচার জাতীয় স্বার্থে সীমিত করতে হবে।অন্যথায় এ বিভাজন বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের জন্য কাল হয়ে যেতে পারে।সিরিয়ায় এই যে রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধ এর কারণ কিন্তু শিয়া ও সুন্নী দ্বন্দ্ব।ইরাকেও তাই।এসব ভুলে গেলে আমাদের ভবিষ্যত্‍ কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে।
৩।
শিয়া ও সুন্নী প্রতিশব্দদ্বয় কেবল বাংলাদেশ পরিচিত নয়।এটি সমগ্র পৃথিবীর গণমাধ্যমে বহুল ব্যবহৃত দুটি শব্দ।মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত বোঝাতে শিয়া ও সুন্নী গণমাধ্যমে আনবেই ইহুদীবাদী ও পশ্চিমা মিডিয়া।এর মাধ্যমে ওরা Divide and Rule নীতি কার্যকর করে।বাংলাদেশের ঘটনায় ইতোমধ্যেই 'শোক জানিয়ে'টুইট করেছে আমেরিকান দূতাবাস।এটি কিন্তু খারাপের পূর্বাভাস।আমেরিকা জানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে কারবালায়,কূফায়,করাচিতে কারা বোমা হামলে করে।তাদের অস্তিত্ত্ব প্রিয় বাংলাদেশে নেই অথচ সেই 'জাতীয় হামলা' হিসেবে এদেশের বিবেকবোধহীন সাংবাদিকগোষ্ঠী সংবাদ প্রচার করছে।অথচ তাদের উচিত ছিল এই ঘটনায় এজেন্ডা সেট করে তা ডিফোকাস করা।সেটি করতে তারা ব্যর্থ অথবা ইচ্ছে করেই করেনি।তারা যেন ইরাকের গাড়িবোমা হামলার নিউজগুলো বাংলাদেশে টেনে আনতে ইচ্ছুক।কিভাবে এদের বোঝাই,হে আরামে বাস করা সাংবাদিগোষ্ঠী,যদি এ দেশে আগুন জ্বলে তবে আপনার হাউজেও জ্বলবে।মাথার উপর দিয়ে ড্রোন উড়ে গেলে টিভিতে বা পত্রিকায় নিজের অতিরঞ্জিত সংবাদ দেখার মানসিকতা আর থাকবেনা।অতএব সাবধান হোউন জনাব।এবং গুরুত্ত্বের সাথে নিন।
৪।
বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের শিয়া সম্প্রদায়ের নেতৃত্ত্ব দিচ্ছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল উজমেয়ি খামেনি।তিনি মহররমের আগেই অভিমত দিয়েছেন যে,১০ মহররমে কারবালার ট্রাজেডির কথা স্মরণ করে নিজেকে রক্তাক্ত করা ইসলামসম্মত নয়।এরমানে শিয়াদের রক্তাক্ত করার ব্যাপারটা অতোটা গুরুত্ত্বপূর্ণ না।তারপরও কেউ রক্ত ঝরাতে চাইলে তাকে স্বেচ্ছায় রুগীদের বা হাসপাতালে রক্ত দিতে বলেছে ইরানী আলেমরা।এমন শান্তিপূর্ণ চমত্‍কার ফতোয়ার পরেও শিয়াদের প্রতি বিদ্বেষ রাখা জুলুম।তদুপরি কেউ তাজিয়া মিছিল করে শোক প্রকাশ করতে চাইলে তাতে হামলা করা কোনক্রমেই ইসলাম সম্মত নয়।যদি ইসলামের নাম করে কেউ এটা করে সেটি ইয়াজেদি ও উমাইয়া ইসলাম,আল্লাহপাক কর্তৃক মনোনীত মহানবী স এর ইসলাম নয়।অতএব এই হামলার সাথে সুন্নী ইসলামকে সম্পৃক্ত করে সংবাদ করা বন্ধ রাখতে হবে।
৫।
ইরানী সংবাদমাধ্যম রেডিও তেহরানের সংবাদ ভাল করে দেখেছি। সেখানে একবারও চেষ্টা করা হয়নি আইএস বা আল কায়েদা সংশ্লিষ্টতা দেখানোর। এটিই বুদ্ধিমানের কাজ। সেক্টেরিয়ান দ্বন্দ্বকে প্রশমিত রাখার উত্তম উপায় ঘটনাকে আড়ালে নিষ্পত্তি করা। জনসম্মুক্ষে এলেই তা গণবিদ্বেষের উদ্ভব ঘটাতে পারে। রাশিয়া ইরানের মাধ্যমে শিয়াদের প্রতি সহানুভূতিশীল।বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরান ও রাশিয়ার ব্লকে।শিয়াদের আক্রমণের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ত্ব তৈরি হলে তা রাশিয়ার সঙ্গেও দূরত্ত্ব তৈরি করবে।সুতরাং এই ঘটনাকে অতোটা বৃহত্‍ ক্রাইসিস হিসেবে প্রকাশ না করে গোপনে সর্বাধিক গুরুত্ত্ব দিয়ে সমাধানের চেষ্টা চালাতে হবে।অতএব এই ঘটনা নিয়ে মাতামাতি বন্ধ করতে হবে।

শিয়া সুন্নী বিভেদ তৈরি হতে দেয়া যাবেনা।বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ইমেজকে নষ্ট করা যাবেনা।

২৪ অক্টোবর, ২০১৫
পাঠ অনুভূতি