বছর দুয়েক আগে ৩৮ তম আবর্তনের এক বড় ভাই হলের ওয়াশরুমের আয়নার সামনে শেভ করতে করতে গান গাচ্ছিলেন 'কি আছে জীবনে আমার? শুধু ভাইভা ছাড়া , কি আছে জীবনে আমার ?'। আমি হাসতে হাসতে বলছিলাম, ভাই এইটা তো মজার গান। আরো গান। উনি বলেছিলেন, ছোট ভাই , কালকে মাস্টার্স ভাইভা, ছাত্রত্বের অবসান ঘটবে, বেকারত্বের দিনগুলোর সূত্রপাত হবে, ক্যাম্পাসের বিগত দিনের ভালো-মন্দ সব স্মৃতি মধুর কষ্ট দেবে। বছর দুয়েক পরে বুঝবি...ভাই গুনগুন করে সুর দিলেন ফের 'কি আছে জীবনে আমার...!
দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে আমার প্রিয় বড় ভাই ও রুমমেট ৩৭ তম আবর্তনের জাকারিয়া ভাইকে যখন বলতাম 'ভাই, ক্যাম্পাস আমার ভাল্লাগেনা। পরীক্ষা শেষ করে যেতে পারলে বাঁচি...', ভাই রহস্যজনক হাসি দিয়ে বলতেন, 'আদরের ছোটো ভাই, মার্স্টার্সটা শেষ হওয়ার ঠিক আগে বুঝবা ক্যাম্পাসের মায়াটা কি! এটা ভীষণ রকম খারাপ লাগা অথচ প্রকাশ করার মত না...'। ৩৭ এর ইসহাক ভাই ও রনি ভাই বলতেন,'ক্যাম্পাসের সাথে যে আত্মার বন্ধন তা যখন টের পাই আমরা তখন আর ভাল লাগেনা, কারণ ক্যারিয়ার ও জীবনের প্রবাহ শুরু হয়ে যায়। ক্যাম্পাস তখন ভারী সুন্দর হয়ে যায়'। ৩৪ এর খুকু আপু বলতেন, পিচ্চি, ক্যাম্পাসটা ছাড়ার জন্য এখন অস্থির হচ্ছো , পরে কিন্তু এটাকে মিস করবা খুব! বছর দুয়েক আগে ইসহাক ভাই, রনি ভাই, খুকু আপু বা জাকারিয়া ভাইয়ের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারিনি।
আজ বছর দুয়েক পর। কাল আমার মাস্টার্সের ভাইভা। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, সেই ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ক্যাম্পাসের ছোট, বড়, দুঃখ,সুখ, আড্ডা, তর্ক, ব্যথা, বঞ্চনা সব কিছু ধেয়ে আসছে আজ। বুক ফেঁটে এক ধরনের আহাজারি বের হচ্ছে। এই অনুভূতিটা আজ সন্ধ্যার পর থেকে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। একেকটা সেকেন্ড যাচ্ছে আর একেকটা নিঃশ্বাস পড়ছে! কাল থেকে বারডেমে আমার নানী অসুস্থ সেখানে থাকবো। তার সঙ্গে ছাত্রত্বের শেষ সময়ের বিচিত্র এই স্মৃতিগাঁথা!
সন্ধ্যা থেকে এই হল, চৌরঙ্গী, ট্রান্সপোর্ট, জয়বাংলা, প্রধান ফটক, টারজান, মুরাদ চত্বর, শহীদ মিনার, বিভাগের জন্য আন্দোলন, নতুন কলা, পুরাতন কলা, মুক্তমঞ্চ, বটতলা, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ,আলম ভাই, হক ভাই, মামুনের চা, ইজরায়েল চাচা, আচার ও পিঠা খালা, পিঠাচত্বর, জলসিঁড়ি, জাকসু, মিলনায়তন, ক্যাফেটেরিয়া, প্রেসক্লাব, বরশির মাছ, দুখু, মৃত্মঞ্চ, সুপারিতলা, মোবারক ভাই এবং ২১৩ নম্বরের কথা মনে হচ্ছে, মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে, যেন কিছুই থাকছেনা আর, মনে হচ্ছে যেন জাহাঙ্গীরনগর থেকে দূরে শূন্যতার দিকে যাচ্ছি একা একা এবং একা। প্রত্যেক বড় ভাই ও আপুদের শেষ পরীক্ষা তথা ভাইভাটার আগে কি এমনই অনুভূতি হয়েছিল? তারাও কি পূর্বের রাতটায় ঐ ভাইয়ের মতই নিজের অজান্তে উচ্চারণ করেছেন:
কি আছে জীবনে আমার? শুধু ভাইভা ছাড়া...!
একাডেমিক জীবনের শেষ মৌখিক পরীক্ষাটি সত্যিই অন্য রকম, এই জায়গায়, ঠিক মৌখিক পরীক্ষার আগের রাতটিতে না এসে কেউ তা অনুভব করতে পারবেনা! ক্যাম্পাসের সব বিশ্রি, নজরে না পড়া, পড়ে থাকা জিনিসও এই রাতে ভীষণ সুন্দর হয়ে যায়! যেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এই জীবনে আর কিছুই নাই অথচ এর সঙ্গে আত্মার সূতার বাঁধনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছেই শুধু....!!!
একাডেমিক জীবনের শেষ মৌখিক পরীক্ষাটি সত্যিই অন্য রকম, এই জায়গায়, ঠিক মৌখিক পরীক্ষার আগের রাতটিতে না এসে কেউ তা অনুভব করতে পারবেনা! ক্যাম্পাসের সব বিশ্রি, নজরে না পড়া, পড়ে থাকা জিনিসও এই রাতে ভীষণ সুন্দর হয়ে যায়! যেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া এই জীবনে আর কিছুই নাই অথচ এর সঙ্গে আত্মার সূতার বাঁধনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঢিলে হয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছেই শুধু....!!!
সবাই আমার ও আমার নানীর জন্য দোয়া করবেন।
(৪ আগস্ট ২০১৭ শুক্রবার রাতে লিখিত। পরদিন ৫ আগস্ট ২০১৭ এর দুপুর ২ টার পর আমার স্নাতকোত্তরের মৌখিক পরীক্ষা ছিল।)
(৪ আগস্ট ২০১৭ শুক্রবার রাতে লিখিত। পরদিন ৫ আগস্ট ২০১৭ এর দুপুর ২ টার পর আমার স্নাতকোত্তরের মৌখিক পরীক্ষা ছিল।)