“বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক কিন্তু ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন।”
-মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ (ডেইলি স্টার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯)
এখন দেখবেন খেলা। এতদিন অনেকে অনেকভাবে এই ব্যবসার ক্ষতি নিয়ে বলেছেন। আমরা চিল্লিয়েছি, ছাত্র হিসেবে, সংবাদকর্মী হিসেবে এর বিরুদ্ধে আমাদের যৌক্তিক প্রস্তাবনা জানিয়েছি। আমার পরিচিত অনেক ছাত্র রাজনৈতিক নেতাকর্মী আন্দোলন করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। নীতিনির্ধারকদের কোনো কেউ কিছুই বলেনি। ইউজিসি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বাণিজ্যিক ইভেনিং কোর্স বন্ধ করেনি। হেকেপ নামের পুঁজিবাদের দালালের খপ্পরে পড়ে এর পক্ষে অনেকেই সাফাই গেয়েছে। কিন্তু এখন রাষ্ট্রপতি বলার পরে ঠিকই টনক নড়েছে ইউজিসির। কিন্তু এই টনক কী মানবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? মনে হয় না। কারণ নগদের কাছে বিবেক বিক্রি করে দেয়াদের সংখ্যা এখানে বেশি। প্রকৃতপক্ষে বিবেক নাইও অনেকের। এখন তাই স্বার্থের বেলায় দেখবেন বিএনপি- আওয়ামী লীগ-বাম-জামাতি-সুশীল-কুশীল-নীল-লাল-হলুদ সব এক হয়ে যাবে। সবাই ইনিয়ে বিনিয়ে কেন ইভেনিং কোর্স থাকা জরুরি তাই ব্যাখ্যা করতে ব্যস্ত হবে। মানববন্ধন বা কলাম লিখলেও কিছু বলার থাকবেনা!
আমার আরেকটি দাবি আর সেটি হচ্ছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। কারণ এরা একই সঙ্গে দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে হয় বলে কোনোটিতেই সেরাটি দিতে পারেনা। ক্লাস তাদের কাছে হয় টাকার ভাণ্ডার। অথচ শিক্ষা তো পণ্য হওয়ার কথা না। এই শিক্ষকরা কিন্তু দেশ বিদেশে গবেষণা করে ফিরেও টাকার পিছনে ছোটে! তাদের কাছে নীতি ও নৈতিকতার বালাই থাকেনা। তারা বিবেকপঁচা একেকটি কলাগাছ হয়ে দাঁড়ান। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ধীরে ধীরে পাবলিকের মত অস্বচ্ছ, বিতর্কিত, তেলাসক্ত ও রেফারেন্সকেন্দ্রীক করার পাঁয়তারাও তারা করছেন নিজেদের 'জ্বী ছার/ম্যাদাম'পালকে প্রবেশ করাতে। এতে করে যোগ্য ছেলেমেয়েগুলো বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশে কর্মক্ষম অনেক ছেলেমেয়েরা কাজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগুলো যে গবেষণা ভাতা গ্রহণ করে এর হিসেব নেয়া জরুরি হওয়া উচিত। একজন নিজের ক্লাস, ইভেনিং ক্লাস, প্রাইভেট ক্লাস, টকশো-ফকশো, রাজনৈতিক তৈলবাজি, শিক্ষক কূটনামী করার পর ঠিক কখন গবেষণা করবেন? কী গবেষণা করছেন, দেশ ও জাতি কীভাবে তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে, কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছেন, কীভাবে পছন্দের ছাত্র বা ছাত্রীকে অযোগ্য হলেও নম্বর বেশি দিচ্ছেন, কীভাবে হেকেপের প্রজেক্ট থেকে অর্থ পকেটস্থ করছেন, কীভাবেরচনা ছাত্রের কাজ নিজের বলে চালাচ্ছেন, কীভাবে নিজ রাজনৈতিক আদর্শের বা শিক্ষক দলপন্থী না বলে অনেকের উপর খড়গ চালাচ্ছেন, পাবলিকের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে তিনি পাবলিকের ছেলেমেয়েদের পাঠদান করছেন এসব নিয়ে শুনানী হলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠবে। প্রতি কোর্সে কয়টি ক্লাস নেয়ার কথা আর আমাদের প্রভাষক-অধ্যাপকপাল কয়টি নিচ্ছেন, স্লাইড শেয়ার বন্ধ হলে ক্লাসে যেতে পারবেন কী না, ডেস্কে রাখা নোটখাতা-বই না দেখে দুই লাইন বলতে পারেন কী না সেই খবর নেয়া শুরু করা যেতে পারে। খুবই লজ্জাজনক চিত্র ফুটে উঠবে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার, কলঙ্কজনক সেই সব চিত্র। এক দুইজন হাতেগোনা মানুষ চেষ্টা করছে এ ব্যবস্থার মধ্যেও বিবেককে সচল রাখতে, শেখাতে, শিক্ষাগুরু হতে! আর অধিকাংশই প্রহসন, বাজে চিত্র। সে চিত্র আমাদের নির্মমভাবে জানাবে, আগামীর বাংলাদেশ কেন মেধা ও মননে পিছিয়ে যাচ্ছে এইসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কারণেই। শিক্ষক এখন অশিক্ষিতদের মধ্য থেকেই হচ্ছে! জাতির মেরুদণ্ড ভাঙছে, ভাঙবে...
0 Comments