আমলা কোষাধ্যক্ষ/ট্রেজারার: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গোস্বা কি যুক্তিসঙ্গত?
~~~
একজন অতিরিক্ত সচিব একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ বা ট্রেজারার হয়েছেন বলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেশিরভাগ গোস্বা করেছেন! এর আগে একজন রেজিস্ট্রার বা নিবন্ধক সাময়িকভাবে উপাচার্য হওয়ায়ও তারা আতঙ্কিত বোধ করেন। এই আমলাভীতি বা আতঙ্ক কি তাদের একাডেমিক পড়াশোনা গবেষণা হবেনা এই জন্য? উঁহু, আমার তা মনে হয়না। এই শঙ্কা সায়ত্তশাসনের নামে তাদের যে অস্বচ্ছ রাজত্ব সেই রামরাজত্বে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভাগ হওয়া বা হারানোর আতঙ্ক। তারা যে স্বেচ্ছাতন্ত্র কায়েম করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই তন্ত্র ভেঙে পড়ার ভয়ে।
তাদের গোস্বার দৃশ্যমান কারণ অন্য 'সব প্রতিষ্ঠানের মত' করে আমলারা 'বিশ্ববিদ্যালয় দখল করবে' ইত্যাদি। আমলাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা এদেশের প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি কর্মচারীদের কমবেশি রয়েছে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে পরিমাণ স্বেচ্ছাতৈরী সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা যেকোনো সীমাকে অতিক্রম করবে। তা নিয়ে তাদের কদাচিৎ আলাপ। নিজেদের স্বার্থে তারা আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত, বাম এক হয়েই কর্মযজ্ঞ চালাতে পারে। এ গালগল্প নয়, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মম তবে বাস্তবচিত্র।
শিক্ষকদের দুর্নীতি, পাপ, অন্যায় ও অবিচার সব ধরনের নৈতিক ও ফৌজদারি অপরাধের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেক আগে। অন্য সব পেশায়ই কম বেশি খারাপি আছে। কিন্তু যারা কেবল বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হওয়ার কথা তাদের পঁচা বিবেকের দুর্গন্ধ সমাজ ও রাষ্ট্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সে জন্যই শিক্ষকদের অনাচার-অজাচার-দুর্নীতি অন্য সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক আর শিক্ষকদের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর তারা যদি বিবেকহীন হয় তবে গোটা দেশেরই বারোটা বাজার সমূহ সম্ভাবনা জাগে। সে জন্য আমি শিক্ষকদের দায় অধিক দিই।
শিক্ষক হিসেবে অপেক্ষাকৃত অযোগ্যদের নিয়োগ প্রদান, বেছে বেছে মেধাবীদের বাদ দিয়ে স্বল্প মেধার বা মেধাহীন মুখস্তবিদ্যাধারী মেরুদণ্ডহীনদের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে আসা সবচেয়ে বড় নৈতিক স্খলন। এরপর এই অযোগ্যরা কেবল পরীক্ষার নম্বর ব্যবহার করে প্রায় ৫-৬ টি বছর জিম্মি করে রাখে মেরুদণ্ড বন্ধক না দেয়া সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তেলবাজ, লবিংবাজরা চোখের মণি হয়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য নামের অথর্ব কোটার আধিক্য। রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য---গাভী বিত্তান্ততে ছফা যেসব লিখেননি তাও শুরু করেছে যেমন, কনস্ট্রাকশন থেকে আয় রোজগার, সরাসরি টাকা ডিল, যৌন নিপীড়ন, ছাত্রদের ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, একে অপরকে গায়ে হাত তোলা ইত্যাদি! এসব কিছুর সূত্রপাত হয় অযোগ্যদের নিয়োগের মাধ্যমে।
সারাদেশে একটি 'এক্সটার্নাল সিন্ডিকেট' রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। নিজেদের বলয়ের/একই বিভাগের অমেরুদণ্ডী ছাত্রছাত্রী/শিক্ষকদের সন্তান-স্বজনদের বেছে বেছে এই সিন্ডিকেট নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগে অস্বচ্ছতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'অযোগ্যতার দুষ্টুচক্র' খুলেছে---শেষ ১৫-২০ বছরে প্রতি শিক্ষকের নিয়োগ বোর্ড ঘাঁটেন। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেধাবী অন্য এক বা একাধিক ছেলে বা মেয়ের হক্ব মেরে এক বা একাধিক বিশেষ সিন্ডিকেট মেইনটেইন করে নিয়োগ পেয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে একজন অযোগ্য হিসেবে নিজের চেয়ে আরো অযোগ্যদের নিয়োগ দিয়েছেন। তো যাদের শিক্ষক হওয়াই বা অন্যকে শিক্ষক করাই জুলুমের মাধ্যমে তারা নিজেদের 'মজলুম' দাবি করার নৈতিক অধিকারী হয় কীভাবে?
আমি আমলার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, নিবন্ধক হওয়াকে ডিফেন্ড করছিনা। কিন্তু আপনারা মেরুদণ্ড বন্ধক রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবর্গ এই গর্ত তৈরি করেছেন। আমলাদের অনেক ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু বিবেকের স্বাধীনতাকে যে পরিমাণ অপপ্রয়োগ আপনাদের অনেকে করেছে আর কোনো পেশার কেউ তা করেনি।
আবার আমলারা 'এমসিকিউ নির্ভর পরীক্ষার' মাধ্যমে এলেও সে আসার মধ্যেও যতটুকু স্বচ্ছতা রয়েছে তার ধারেকাছে যাওয়ার মত রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া আপনাদের রয়েছে ছার/ম্যাঁদাম? বাস্তবতায় এলে আপনাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যাবে, সরকারি একটি পিওন পোস্টের চাকরিতেও যতটা স্বচ্ছতা মেইনটেইন করা হয় ততটুকুও শিক্ষক নিয়োগে নেই। আর ৯ম গ্রেডের একজন প্রভাষক ও উন্মুক্ত সরকারি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ৯ম গ্রেডের একজন সরকারি কর্মকর্তাকে পাশাপাশি এনে স্বচ্ছতার শক্তি যাচাই করতে পারেন। আমলারা বা সরকারি অন্যান্য চাকরির লোকে এ জন্যই আপনাদের কটাক্ষ করতে সময় নেয়না। কারণ তারা মক্কা বা লন্ডন থেকে আসেনি, এ দেশেরই সন্তান। আপনাদের যোগ্যতা ও কীর্তি তারা ভালো করে জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাদেরই জুলুমের শিকার হয়ে তাদের কেউ কেউ রাগ করে সরকারি চাকরির জন্য উঠেপড়ে পড়েছে। এখন তার সময়ে সে হয়তো তার প্রতি জুলুমের বদলা নিচ্ছে সামষ্টিকভাবে।
আমলাদের বা আমলাদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্তদের এই জানা ও স্বচ্ছভাবে নিয়োগ পাওয়ার শক্তির কাছে কথিত বিবেকের কারিগররা হেরে গেছেন। কারণ, বেশিরভাগ তাদের বিবেক বেচেছেন বা পঁচা বিবেকের অধিকারী। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমলা-পুলিশ দেখলে আহ্লাদে আটলখানা হন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ। একই বিভাগের অন্য চাকরি করা ছাত্রছাত্রীদের তাদের কাছে কম গুরুত্ব। আবার, সিনেট-সিন্ডিকেটের তোয়াক্কা না করে, নির্বাচন না করে মন্ত্রণালয়ে ধর্না দিয়ে একজন 'উপসচিবের স্বাক্ষরে' নিয়োগ পেতে সে কি নির্লজ্জ দৌড়ঝাঁপ বাঘ-বাঘিনী অধ্যাপক/অধ্যাপিকাদের! এসব দেখে আমাদের আমলারা হয়তো ভাবেন,'আরে আমরা যাদের স্যার বলে সম্মানে মাথা নত করতে প্রস্তুত তারা দেখি নিজেরাই আমাদের স্যার স্যার করতে নমঃ নমঃ করতে দুই পায়ে রাজি হচ্ছে'! ব্যস, এভাবেই ধীরে ধীরে হেরে যাচ্ছেন শিক্ষকরা।
মহান পেশাকে ব্যক্তিস্বার্থ, অপরাজনীতির কাছে জলাঞ্জলি দেয়ায় মেরুদণ্ড শক্ত নেই। ফলে রাজনীতিবিদদের কাছেও মূল্য নেই। বৃত্তি, বেতন, প্রেষণ ও সুবিধা সীমীত করা হচ্ছে। কারণ? স্বচ্ছতার শক্তি ও মেধা দিয়ে একসময় দেশ পরিচালনাকারী রাজনীতিকদের বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে পরিচালিত করতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা৷ অর্থাৎ পলিসি মেকারদের নিয়ন্ত্রণ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে। আজ নিজেদের অযোগ্যতায় সেই জায়গাটিতে আমলা-পুলিশ চলে গেছে। এ নিয়ে কোনো ক্রিটিক নেই, ক্রিটিক্যাল থিংকিং নেই শিক্ষকদের মধ্যে। তারা ব্যস্ত লালে আর নীলে, তাদের ভারী কান নিয়েছে চিলে। শুধু আছে ' আমাদের বেতন-ভাতা কমাইছে, আমাদের মর্যাদা কমাইছে, স্কলারশিপ কেটে নিছে, বাজেট দিচ্ছেনা আমলারা সব দখল করছে, ' এসব নিম্নমানের ক্লার্কি খাসলত আরো কত কী!
সুতরাং, আমলার কোষাধ্যক্ষ হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে এসব শক্তিশালী যুক্তি নয়। আপনারা নিজেদের কাজকে এতই বিতর্কিত করেছেন যে অন্য পেশা থেকে আপনাদের এখানে লোক আসার মত ফাঁকফোকর বা লুপ হোল তৈরি হয়েছে। চিল্লাইয়া আমলাদের গোষ্ঠী উদ্ধার করলে এই লুপ হোল বন্ধ হবেনা৷ আপনাদের আমলাদের চেয়ে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, স্বচ্ছতায় সেরা হতে হবে। তবেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে মর্যাদা ফিরে আসবে। কলকাঠি কীভাবে নাড়া হয় তাই তো আপনারা মনে হয়ে জানেন না বা ভুলতে বসেছেন!
আমি আবারো বলছি, ঢালাওভাবে আমলাদের নিন্দা না করে নিজেদের আত্মসমালোচনা করুন। নিজেদের প্রখর মেধাসম্পন্ন যোগ্যতায় পরিপূর্ণ করে তুলুন। ছাত্রছাত্রীদের নম্বর জিম্মি করা ছাড়ুন, অস্বচ্ছ নিয়োগ দেয়ার মানসিকতা বাদ দেন, আর্থিক ও নৈতিক সততায় ফিরে আসুন, গবেষণা ও পড়ালেখা করুন, স্বচ্ছতার শক্তি বৃদ্ধি করুন---দেখবেন আমলারা আপনাদের ফের সম্মান করবে, ফের আপনাদের প্রতিটি নাগরিক সম্মান করবে। আপনাদের উপর ছড়ি ঘোরাতে কেউ আসবেনা।
তাই, নিজেদের 'অযোগ্যতার দুষ্টুচক্র' গর্তটি আর বড় করবেন না। এবার কোদালকে কোদাল বলতে শিখে জমা দেয়া মেরুদণ্ড ফিরিয়ে এনে তা সোজা করে পঁচা বা অকর্মা বিবেক পরিচ্ছন্ন বা সক্রিয় করে কলমকোদাল দিয়ে ফাঁকা গর্ত ভরাট করে একাডেমিক জমিনে উত্তম ফসল রোপণ করুন। ফল মিষ্টি হবে। জাক্কুম/ধুতুরা লাগিয়ে ফজলি আম আশা করল তো হবেনা। ...নাকি?
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমলাদের চেয়ে অধিক মেধাবী, যোগ্য, শিক্ষানুরাগী, বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন, নিরপেক্ষ, সৎ ও স্বচ্ছ না হয়ে আমলসংশ্লিষ্ট ট্রেজারার বা রেজিস্ট্রার পদে আমলাদের চলে আসা নিয়ে গোস্বা করতে পারেন---কিন্তু এর যৌক্তিকতা কম বা একেবারে নেই বললেই চলে। কারণ, গোস্বা করে আপত্তি জানানোর মত মোরাল গ্রাউন্ড, ট্রান্সপারেন্সি বা লেজিটিমেসি কোনোটাই আপনাদের নাই। আমি বিশ্বাস করি, মর্যাদার লড়াই করতে লাগে আত্মমর্যাদাবোধ---যা এদেশের অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেই। আপনারা আত্মমর্যাদাবোধ, ব্যক্তিত্ব, বিবেক ও স্বাধীনসত্তার মেরুদণ্ডকে অকার্যকর করতে করতে কখন যে প্রায় 'নাই' হয়ে গেছেন সেই অনুধাবন জ্ঞানও নাই! আফসোস! আপনারা 'নাই' থেকে ছাই হয়ে উড়ে না গিয়ে মেধা, স্বচ্ছতা, যোগ্যতা ও জ্ঞানের আগুন হয়ে ফিরে আসবেন---এই প্রত্যাশা রইলো।
0 Comments