সর্বশেষ

ইসলামে পুরুষের একাধিক বিয়ে নিয়ে মুনশিদের ফতোয়াবাজির মুখোশ উন্মোচন || বহুবিবাহের নেপথ্যে ভোগবাদ ও খায়েশ

ইসলামে পুরুষের এক সঙ্গে একাধিক বিয়ে নিয়ে ফতোয়াবাজির সত্যতা কি আদৌ আছে?
একটি নির্মোহ অনুধাবন 
~~~
এই আবু ত্বহা-আহমাদুল্লাহ-আজহারি-এন্টার্কোটিক ইব্রাহিম-আব্বাসি বাটপার মুনশি-মোল্লা গং যুগের পর যুগ ধরে বিয়ের ব্যাপারে অপপ্রচার ও অনৈসলামিক ফতোয়াবাজি করে এসেছে এই বলে---

'বিবাহিত পুরুষ সমর্থ বা সক্ষম হইলেই একাধিক বিয়ে করতে পারে যেকোনো নারীকে (এমনকি প্রথম বা অন্যান্য স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই)'-

এই যে মিথ্যাচারযুক্ত খণ্ডিত ফতোয়া, এটি যে চলছে বা চালাচ্ছে এর ভিত্তি কী?

কেবল নিজেদের জৈবিক খায়েশ পূর্ণ করতে কিংবা যারা এমন করে বা করতে চায় তাদের সমর্থন করতে পবিত্র কোরানে প্রদত্ত আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশকে আংশিকভাবে প্রচার করছে এবং কোরান ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে আলেম নামের জাহেলরা। আর এর সুযোগ নিচ্ছে কওমী, আলিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সবাই, এমনকি গ্রামের নিরক্ষর, মাতুব্বর, রাজা, সেনা, উজির, নাজির ও হাল আমলের ইউটিউব মুফতি গং। সত্যটা কী?

কোরানের সুরা নিসা'র ৩ নম্বর আয়াত দেখি চলেন আল্লাহ কী বলছেন আর মোল্লার দল আমাদের কী জানায়...

"সূরা আন নিসা (النّساء), আয়াত: ৩

وَاِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تُقۡسِطُوۡا فِی الۡیَتٰمٰی فَانۡکِحُوۡا مَا طَابَ لَکُمۡ مِّنَ النِّسَآءِ مَثۡنٰی وَثُلٰثَ وَرُبٰعَ ۚ  فَاِنۡ خِفۡتُمۡ اَلَّا تَعۡدِلُوۡا فَوَاحِدَۃً اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ ؕ  ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَلَّا تَعُوۡلُوۡا ؕ 

অর্থঃ আর যদি তোমরা ভয় কর যে,  ইয়াতিম মেয়েদের হক যথাথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সে সব মেয়ের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে, একটিই অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে (বিয়ে করো); এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা

ভালো করে পড়ুন আয়াতটি। আল্লাহপাক স্পষ্ট বলেছেন, কেবল ইয়াতিম মেয়েদের থেকে একাধিক বিয়ে করা যেতে পারে (করতে হবে এ বাধ্যতামূলক বার্তা নয়)। তাও কোন ক্ষেত্রে? যখন তাদের হক্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারবেনা বলে আশঙ্কা দেখা দেবে। 

এখন, এই এতিম মেয়েরা যদি কারো দ্বিতীয়/তৃতীয়/চতুর্থ স্ত্রী হতে না চায়? কিংবা কারো প্রথম স্ত্রী যদি পরের বিয়েতে অনুমতি না দেয়? অথবা ধরুন, ইয়াতিম মেয়ের অভিভাবক মামা-বা খালা এসে তাদের ধীরে ধীরে বড় করবেন। তাদের আপনি চাইলেই বিয়ে করতে পারবেন? ইয়াতিম মেয়ে বলে সতীনের ঘরে পাঠাবে? 

এই সব সংকট আসতে পারে বলেই এই আয়াতের শর্তের পরের অংশে মহান আল্লাহ নিজে বলেছেন, যদি এরূপ আশঙ্কা করো যে, এই একাধিক বিয়ে করে তুমি ন্যায়সঙ্গত আচরণ (মোহরানা, সমান ভরণপোষণ, সমান সময়, সমান প্রেম, সমান মূল্য ইত্যাদি) করতে পারবেনা তবে 'একটিই' উত্তম।

আল্লাহ বলেছেন একটি স্ত্রীই উত্তম। যদি আল্লাহর আইনেই আপনি বিশ্বাস করেন এরপর আর কিন্তু থাকে? 

কারণ, মানুষ নামের এই ডিভাইস তিনি বানিয়েছেন। এর প্রোগ্রামে ঝামেলা বা ম্যালফাংশন কীসে হতে পারে সেটি তিনি জানেন। যেহেতু নবী মুহাম্মদ (স) এর মাধ্যমে আল্লাহ বিদায় হজ্বে দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত করেন এই বার্তায় 'তোমরা যা খাবে তাদের তা খাওয়াবে, যা পরবে তাদের তা পরাবে, যেভাবে নিজেরা থাকবে তাদেরও সেভাবেই রাখবে' সেহেতু দাসী বলে আর কিছুর অস্তিত্ব থাকেনা (যদিও নিজ স্বার্থে অপব্যাখ্যা দিয়ে এই প্রথা পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে মানুষ রেখেছে টিকিয়ে আর এই আধুনিক যুগে গৃহকর্মী, চাকুরে ইত্যাদি নামে চলমান)। 

আবার, সুরা নিসার ১২৯ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, মানুষের পক্ষে একাধিক স্ত্রীকে একসঙ্গে সঙ্গে সমান চোখে দেখা সম্ভাবনা যদিও এটা পারবে বলে মানুষ ভাবতে পারে। মানে আপনার মনে হবে একাধিক স্ত্রীর প্রতি আপনি সাম্য করতে পারবেন, কিন্তু এটা আদৌ সম্ভব না। এটা কে বলেছেন? যিনি আপনাকে বানিয়েছেন।

এরপরেও কারা নিজেদের যৌন খায়েশ চরিতার্থ করতে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী রাখতে চায়? তাও ধর্মের নামে! এরা এবং একাধিক নারী ও পুরুষের সঙ্গে লিভ টুগেদারের নামে যৌনসম্পর্কে থাকতে চাওয়াদের মধ্যে গুণগত তফাৎ থাকে? নাহ!
অন্যদিকে একটা বহুল জিজ্ঞাসিত বা আলোচিত কুতর্ক আছে যে, ইসলামমতে, নারীও একাধিক স্বামী রাখতে পারবে কী না। মোল্লারা গোঁজামিল দিয়ে পুরুষের চার বিয়েকে অধিকার করে নারীকে এক স্বামীতেই সন্তুষ্ট থাকার ফতোয়া দেয়। নারী যখন প্রশ্ন করে, তুমি স্বামী একাধিক স্ত্রী রাখতে পারলে আমি নারী পারবোনা কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা যৌন খায়েশকেন্দ্রীক চিন্তা করা আলেম নামের জালেম জাহেলরা। কারণ, যে কনটেক্সটে নারীরা এ প্রশ্ন তোলে সেটিই গোঁজামিল দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে। 

আমার ব্যাখ্যা বা অনুধাবন একেবারেই ভিন্ন। আমি মনে করি, এই এক সঙ্গে চার বৌ রাখার ফতোয়া বাদ না দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়না। এখানে যারা মুহাম্মদ (স) এর ১৩-১৪ টি বিয়ের কথা আনবে তারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই অনুধাবন করেনি বলে আমি মনে করি। কারণ, মহানবী (স) এর জীবনের সঙ্গে আমাদের ঢালাও তুলনা সব সময় হবেনা। কেননা তার স্ত্রীগণ তিনি মৃত্যুর পর কিন্তু সাহাবীদের বিয়ের পাত্রী হননি। বরং নবী মুহাম্মদ স এর স্ত্রীদের সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে আমরা 'উম্মুল মুমিনিন' বা 'বিশ্বাসীদের জননী' নামে ডাকি। তারমানে মুহাম্মদ (স) এর স্ত্রী একাধিক ছিলো বলে আপনি নিজের খায়েশে একাধিক বিয়ে করতে পারেন না। আর মুহাম্মদ (স) এর কোনো বিয়েই যৌনতাসর্বস্ব ছিলোনা, প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা) এর মৃত্যুর আগে তিনি বিয়েই করেননি আর। আর বিয়ের পর স্ত্রীগণকে মধ্যে পালা করে সমান সময় দিতেন। স্ত্রীরা নিজেদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার পরেও স্বাভাবিক খুনসুটি মনোমালিন্য ছিলো এবং কখনো এক স্ত্রী তার জন্য বরাদ্দ সময় অন্যকে দিতে পারতেন। এসব আপনি পারবেন? ফলে নিজের খায়েশ চরিতার্থ করতে দয়া করে মুহাম্মদ (স) এর নিষ্কলুষ জীবনকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনবেন না। এটা জাহেলিপনা হবে।

দেখুন, নারীদের এক সঙ্গে একাধিক বর বা স্বামী নিয়ে ইসলামে কোথাও আলাপ নেই। এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে ইসলাম কোরানের মাধ্যমে আপনাকে উত্তম পরামর্শ ইতোমধ্যে দিয়েছে যে 'এক স্বামী ও এক স্ত্রী উত্তম' জীবনব্যবস্থা। বাকি যে চারটা পর্যন্ত আপনি রাখতে চাচ্ছেন, এইটা আপনার নিজের খায়েশের জন্য---নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই। ইসলাম নারীকে যেভাবে একাধিক বিয়ের অনুমতি দিয়েছে, স্বামীকে নিজে বা অভিভাবকের মাধ্যমে তালাক দেয়ার এখতিয়ার দিয়েছে (নিসা ১২৮ এর মিমাংসাকে পৃথক হওয়া হিসেবেও পাঠ করার সুযোগ আছে) তদ্রুপ পুরুষকেও দিয়েছে। ফলে নারী ও পুরুষ মনোমালিন্য হলে পরস্পরের সঙ্গে একসঙ্গে থাকার জন্য চেষ্টা করবে সমস্যা সমাধান করে; আর অমিল বাড়লে তালাক দিয়ে নতুন স্ত্রী বা স্বামী গ্রহণ। একেবারে সিম্পল নিয়ম। সঙ্গীর সঙ্গে বনিবনা না হলে বা তাকে ভালো না লাগলে (কিংবা মরে গেলে বা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিখোঁজ থাকলে) তালাক দিয়ে নতুন সঙ্গী খোঁজো। খোঁজার যোগ্যতা না থাকলে রোজা রাখো। এটাই ছিলো সিরাতুল মুস্তাকিম---সহজ সরল পথ। 

এ পথ ভুলে উমাইয়াদের ভোগবাদী জীবনধারাকে দরবারি ফতোয়াবাজ দ্বারা মূল ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এভাবে যারা ইসলামকে বিতর্কিত করছে তাদের বুঝ কবে আসবে? যেখানে কোরানে স্পষ্ট নির্দেশ আছে সেখানে ফতোয়া আসার কোনো উপায় ইসলামে নেই। যারা কোরানকে অসম্পূর্ণ ভেবে মনগড়া ব্যাখ্যা দেয় এরাই জাহেল, অথচ পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছে আলেম! কী বিভৎস প্রহসন!

[উপরের সকল বিষয়ে মহান প্রভু আল্লাহই সর্বোত্তম জ্ঞানী]
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments