''সুলতান' দক্ষিণের আরো একটি চমৎকার সিনেমা৷ বক্কিরাজ কাননের কাহিনী পরিচালনায় এ ছবিতে অভিনয় করেছেন কার্তিক, রেশমিকা, যোগী বাবু, নবাব শাহ প্রমুখ। খলনায়ক হিসেবে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন কেজিএফ এর গাড়ুরা (গারুদা) হিসেবে জনপ্রিয় রামচন্দ্র রাজ।
কাহিনী একদল গুণ্ডাকে নিয়ে যাদের এ দুনিয়ায় তেমন চাওয়া নাই। তিন বেলা খেয়েই তারা সুখে। তাদের উস্তাদ বিশাল বড় বাহিনীর নেতা। এ পান্ডাদল শহরে ত্রাস হিসেবে পরিচিত।
ভালো-মন্দ মিলিয়ে তাদের জীবন চলার মধ্যে জন্ম নেয় বিক্রম (কার্তিক)। মনসুর নামের উপদলনেতা এর নাম রাখেন সুলতান। সুলতানকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা যায়। এই মাস্তানরা তখন তাকে মায়ের স্নেহে বড় করে এবং নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে সুলতানকে লেখাপড়া করায়। সুলতান হয় উচ্চ শিক্ষিত প্রকৌশলী।
গ্রাম থেকে একজন নিরীহ মানুষ এসে সুলতানের বাবা সেতুপথিকে জানায়, এক কর্পোরেট ব্যবসায়ী তাদের কৃষিজমি নিয়ে খনি-ইন্ডাস্ট্রি ইত্যাদি করতে চায়। ব্যবসায়ীর ভাড়াটে গুণ্ডা খুনী জয়সিলান (গাড়ুদা)কে মেরে ফেলতে গ্রামের মানুষ নিজেদের সোনা গয়না দেয়। সুলতানের বাবা সেতুপথি জানায়, জীবনে অনেক পাপ করছে। এই কর্পোরেট দখলদার ও তাদের গুণ্ডাদের মেরে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ আসছে। বিনা অর্থে তিনি এ কাজে রাজি হলেন।
ইতোমধ্যে শহরে ক্রশফায়ারে বিশ্বাসী এক দুর্ধর্ষ পুলিশ এসেছে। সে শহরকে সন্ত্রাসী মুক্ত করতে লিগ্যাল সিস্টেমের মধ্যে গুন্ডাপাণ্ডাদের এনকাউন্টার দিয়ে মেরে ফেলায় বিশ্বাসী। সুলতান তাকে গিয়ে জানায়, কেউ জন্মগতভাবে সন্ত্রাসী হয়না। তাদের ভালোভাবে গ্রুমিং করলে এ কাজ করবেনা। ক্রশফেয়ার দিলে সে সুযোগ তারা পাবেনা৷ পুলিশ সুলতানকে ৬ মাস সময় বা সুযোগ দেয় তার বাবার বাহিনীর গুন্ডাদের ভালো হওয়ার বা করার। এর মধ্যে একটি মামলা বা অভিযোগ তাদের নামে এলে সোজা ক্রশফায়ার---পুলিশের হুমকি!
এই আল্টিমেটাম মাথায় রেখে মাস্তানদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সুলতান গ্রামে যেতে রাজি হয়। কিন্তু মনসুর বাহিনীর গোপন উদ্দেশ্য সেতুপথির মরার আগে গরীব গ্রামবাসীকে সহায়তা করার ওয়াদা। তারা যায় এই ওয়াদা বাস্তবায়নের জন্য।
দুটো সাংঘর্ষিক ঘটনা পাশাপাশি চলে। মনসুরের নেতৃত্বে গুন্ডারা চায় সুলতানের বাবার দেয়া ওয়াদা রক্ষা করতে গাড়ুরাকে হত্যা করতে। আর সুলতান চায় এই ৬ মাসে এদের নামে থানায় যেন একটি মামলাও না যায় সেটি। কেউ কারো ইন্টেনশন প্রাথমিকভাবে না জেনে মুভির থিসিস-এন্টিথিসি চলতে থাকে। এরমধ্যেই দলের মধ্যে নানা সংকট আসে। নেতৃত্বের লড়াই ইত্যাদি।
গাড়ুরাসহ মাস্তানদের একা সুলতানই ফেস করে। মানে তার ভাই-বেরাদারদের রক্ষা করতে।
সুলতান দক্ষতার সঙ্গে গুন্ডা নামে পরিচিত (তামিলরা রাউডি বলে, বাংলায় রংবাজ বলা যায়) এদের কৃষিকাজে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়। রুকুমনি নামে যে গ্রামের মেয়েটির প্রেমে সুলতান পড়ে সে শর্ত দেয় তাকে পেতে হলে গ্রামে ফের ফসল ফলাতে হবে এবং সেই ধানের ভাত দিয়ে বৌভাত করা হবে। এ শর্ত, ক্রশফায়ার থেকে বাঁচাতে চেষ্টা খাপে খাপ মিলে গেলে সবাই কাজ করে।
ফসল ফলায় এই মাস্তানেরাই। এর মধ্যে নেতা হতে যে চায় সে একটি অংশ নিয়ে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শহরে চলে যখন সুলতান মনসুর হত্যার বদলা নিতে নিষেধ করে৷
এর অনেক দিন পর সুলতান ও গ্রামবাসী মিলে লড়াই করে কর্পোরেট নেতা নবাবের সন্ত্রাসী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে৷ হঠাৎ গাড়ুদাএ আগমনে লড়াইয়ে ক্লান্ত সুলতান পরাজিত হয়ে যাবে এমন সময় পরিবর্তিত সেই বাহিনী ফিরে এসে সুলতানকে সহায়তা করে গ্রামবাসী ও ফসল রক্ষা করে!
তারা ফিরে আসে কেন? আইনজীবীর মাধ্যমে জানতে পারে, সুলতান তাদের ক্রশফায়ার থেকে রক্ষা করতে পুলিশ কমিশনারের দেয়া আল্টিমেটামের মধ্যে তাদের পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেছে। তাদের প্রত্যেকের নামে কৃষিজমির ব্যবস্থা করেছে ইত্যাদি। মজার সমাপ্তি! তবে গাড়ুরার মৃত্যু দেখায়নি। সম্ভাব্য সিকুয়েন্স আসার হয়তো পথ খোলা রেখেছেন পরিচালক।
ছবিতে দক্ষিণের সেই প্রতিবয়ান বা কাউন্টার ন্যারেটিভ আপনার চোখে পড়বে। এন্টি এস্টাবলিশমেন্ট পদে পদে। সুলতানরূপী কার্তিককে বলছে 'রাবণ' যার ১০০ টি মাথা আছে (১০০ জন নিম্নবিত্ত গুন্ডা প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়ছে, যেন মেঘনাদের বাহিনী)। ইচ্ছে করলে বক্কিরাজ কানন কিন্তু 'রাম বা লক্ষণ'ও বলতে পারতো কার্তিককে। কিন্তু অনার্য রক্তবাহী দক্ষিণ তাদের ভূমিপুত্র লঙ্কান রাবণকেই চিত্রিত করেছে সুলতানের মাধ্যমে। যেভাবে কর্ণতে দেখবেন, অনার্য ভূমিপুত্র দলিত শ্রেণির নিপীড়নকে তুলে ধরা হয়েছে। ম্যান্ডেলাতে দলিত নাপিতকে করা হয়েছে নায়ক ইত্যাদি।
শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগাররা কোথা থেকে সমর্থন পেতো সেটি বুঝতে আপনার দক্ষিণের কাহিনীগুলো বা চিত্রনাট্যের সংলাপ ভালো করে বুঝতে হবে। এ বছরই নেটফ্লিক্সে মুক্তিপ্রাপ্ত ধনুষের জাগামে থান্ডিরাম যদি দেখেন, দেখবেন স্বাধীনতাকামী তামিলদের উপর শ্রীলঙ্কার সরকারের অত্যাচারের সময় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নীরবতার কঠোর নিন্দা রয়েছে।
যাহোক, আমি আপনাদের এতো গভীর তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক আলাপে নিবোনা। সিনেমার গান, সংলাপ, একশন, প্রেম, মিলন সব কিছুই চমৎকার! কাহিনী সব জানার পরেও আপনার ভীষণ ভালো লাগবে---এটা আমার বিশ্বাস।
সুলতান নামের এ ছবি থেকে একটি জিনিস আপনার মধ্যে ধারণ করতে পারেন,'দুনিয়ায় কেউ চিরস্থায়ী খারাপ না'--সঠিক পরিচর্যায় মানুষের আচরণের রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটতে পারে। দেখা ভালো হোক। শুভ দর্শন।
0 Comments