সর্বশেষ

রাখী বন্ধন ও ধামাচাপা দেয়া ইতিহাসের সঙ্গে বুঝাপড়া

রাখী বন্ধন ও ধামাচাপা ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়া
~~~
১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী 'রাখী/রাঁখি/রাঁখী বন্ধন' ছিলো সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণ্যবাদীদের জমিদারি রক্ষা ও পূর্ববঙ্গ লোপাট করাকে চলমান রাখার বা দীর্ঘায়িত করার সাংস্কৃতিক সঙ। এতে নিপীড়িত মুসলিম ও দলিত, শুদ্র সনাতনীদের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ ছিলোনা। এসব যে ব্রিটিশপূজারি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভাওতাবাজি তা বোঝা গিয়েছিল ১৯৪৭ 
-এ। তখন কিন্তু এই রাখী/রাঁখি/রাঁখী বন্ধনের ধার না ধেরে দিল্লির পদলেহন করতে বাংলা ছেড়ে ভারতের কাছে ইজ্জত বেচে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি আজ্ঞে 'রাখীর ঠিকাদারপাল' এই ডাডাড়া।
২)
দেশবিভাগের সময় পূর্ববঙ্গের সাধারণ দরিদ্র নমশুদ্র হিন্দু কিন্তু বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতবর্ষে যায়নি। এমন কী পশ্চিমবঙ্গের দরিদ্র মুসলমানও পূর্ববঙ্গে আসেনি। অধিকাংশ ব্রাহ্মণ্যবাদী সুবিধাবাদী পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিম্বঙ্গে চলে যায় এবং কিঞ্চিত সেখানের সম্পদশালী মুসলমানদের কেউ কেউ এপারে আসে। কলকাতায় যে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ তাও দিল্লিপন্থীরা গ্রাস করে। আমাদের টেগোর বাবুর কুষ্টিয়া ইত্যাদির জমিদারি হারানোর ভয়ও আসে এ সময়। ইনাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন আড়ালে 'সন্ত্রাসবাদী' রূপও নেয়। আমরা যে ক্ষুদিরামকে নিয়ে গাই ও কাব্য লিখি, তাকে মগজ ধোলাই দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বোমা মারতে পাঠানো হয় বঙ্গভঙ্গ রদ করাতে বাধ্য করতে, বিসৃঙখলা তৈরি করতে। 

১৯১২ এর মধ্যে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং ১৯১৩ তে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ব্রিটিশ দখলদারদের ভারতীয় উপমহাদেশের সমর্থন প্রয়োজন কারণ উসমানী তুর্কি খেলাফতও ব্রিটিশবিরোধী জোটে। ভারতে এক নোবেল অনেক কিছুকে ভুলিয়ে রাখতে পারে। রেখেছিলোও। বাঙালি পল্টনের কথা জানেন নিশ্চয়ই। ব্রিটিশরা পালালেও বাঙালি মুসলিম ও হিন্দু ঠিকই লড়াই করেছে ফ্রন্টলাইনে। সে জন্য আমি রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিকে রাজনৈতিক দুরভীসন্ধির ঊর্ধ্বে মনে করিনা। এই নোবেল পুরস্কারের রাজনৈতিক দিক নিয়ে তো অবশ্য আলাপ কেউ করেনি, করেনা। 

৩)
আপনি অবাক হবেন শ্রীরবীন্দ্রনাথদের সময়ে বা তাদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে একটি সময়ে "বাঙ্গালী বলতে কেবল হিন্দুদের, বিশেষত কথিত ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণের হিন্দুদের" বোঝানো হতো! ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে আজ পূর্ববঙ্গের মুসলমান বাঙালী/বাঙালি/বাঙ্গালি আর ওরা কাগজে কলমে 'ভারতীয়'--যদিও সেখানের একটি ক্ষুদ্র সচেতন সমাজ আজো নিজেদের বাঙালী জাতীয়তা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে যেমন---"জাতীয় বাংলা সম্মেলন"৷  

ঘরে দুয়ারে সে সময় মুসলমান বা অব্রাহ্মণ হিন্দু গেলে এরা ঘর ধুতো, তাদের খাবার খেতে দিতে আলাদা পাত্র থাকতো। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও এম আর আখতার মুকুল তাঁর 'আমি বিজয় দেখেছি' তে ব্যথাভরা মনে লিখেছেন৷ আপনি মনসুরের 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরও পড়তে পারেন'। নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের এরাই 'নোমো বা চণ্ডাল' বলে অচ্ছুৎ করেছিলো (আজকে বাংলাদেশে অনেক অশিক্ষিত সাম্প্রদায়িক মুসলমান পরিচয়ধারী ইতর যেমন হিন্দুদের 'চাঁড়াল' বলে ঘৃণ্য আচরণ করে সেটা এই কলকাতার ব্রাহ্মণ্যবাদী বাবুদের মাধ্যমে উদ্ভূত 'চণ্ডালেরই' বিকৃত রূপ!)। 
আর সে সময়ের ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ও মধ্য ও উত্তর প্রদেশে মুসলমান কেমন ছিলো? সে তো যবন! শরৎচন্দ্র গড়ের মাঠে 'বাঙ্গালী ও মুসলমানদের ফুটবল খেলার বর্ণনা দিয়েছেন'; বঙ্কিম বাবু ''মুসলমান ম্লেচ্ছ যবনকে কচু কাটা করে তাড়াতে লুটেরা ইংরেজদের শাসনকে দেবতার আশির্বাদ বলেছেন নিম্নমানের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় ঠাসা 'আনন্দমঠ' উপন্যাসে; আর আমাদের ঠাকুরমশায় লিখেছেন উগ্র আরএসএসের গুরু শিবাজীর স্তুতি কিংবা ব্রিটিশ দখলদারদের প্রধানকে 'জনগণমন অধিনায়ক'!
৪)
অথচ তখন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ যদি এক হয়ে আসাম ও ত্রিপুরাকে নিয়ে আন্দোলন করতো তবে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি বৃহত্তর বাংলাদেশ গড়ে উঠতো। একটু ইউটোপীয়ান অখণ্ড ভারতের লোভ সামলে রাজনৈতিক চাল দিলে বিহার ও উড়িষ্যা, মিজোরাম ইত্যাদিকে নিয়ে বাংলাদেশেই বিশাল যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা যেতো। এতে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী জিওপলিটিক্যাল এনটিটি হতো বাংলাদেশ। আর এটা সম্ভব হতো যদি ১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম এক হয়ে আগে শক্ত একটি পাটাতন গড়ে উঠতো 'বাঙালিদের', অথবা নিরপেক্ষভাবে লিখলে 'বাংলাদেশীদের'। 

রবীন্দ্রনাথ সে সময় দেখবেন লেখায় 'বাংলাদেশী' ও 'হিন্দুস্তানী' আলাদা লিখেছেন। কিন্তু বাংলা সব সময় গোটা ভারতের আগে অনেক কিছু ভাবলেও ১৯৪৭ ও তৎপূর্ববর্তী ১৯০৫ সালে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে ভঙ্গুর সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলার বাঘা বাঘা নেতা  উড়ে এসে জুড়ে বসা হিন্দুস্তানী নেতা মহাত্মা, নেহেরু আর জিন্নার সাংস্কৃতিক দাসত্বে মুগ্ধ হয়ে নিজের আত্মপরিচয়কে সর্বভারতীয় ও পাকিস্তানী ইউটোপীয়ায় জলাঞ্জলি দিল। তবে এর জন্য আমি ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দায় বেশি দিবো। এতো শিক্ষিত ব্রাহ্মণ্যবাদীরা থাকতেও কলকাতায় দাঙ্গা হয় কীভাবে? 'মূর্খদের আড্ডাখানা' নোয়াখালী পশ্চাতপদতায় না হয় করলো, তোমরা তো বাবু ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, তোমাদের কী হলো স্বজাতির ভাই/বোনকে হত্যা করে দিলে কেবল আলাদা ধর্ম পরিচয়ের জন্য? এভাবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ বৃহৎ বাংলা গঠন সম্ভব হয়নি।

কলকাতাকেন্দ্রীক শোষকেরা সেটি চায়নি। কারণ, ঢাকার কাছে, আগরতলার কাছে, করিমগঞ্জের কাছে, মুর্শিদাবাদের কাছে কলকাতা গৌণ হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা তাদের ছিলো। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো জমিদারি ও সম্পদ হারানোর ভয়। কলকাতাকেন্দ্রীক কথিত বাবুগিরি চলতো বাংলার সম্পদ দিয়ে, যেভাবে বাংলার সম্পদ দিয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান চলতো। ১৯৪৭ এ করিমগঞ্জ ভোট দিয়েও পূর্ববাংলায় আসতে পারলোনা। আরাকানকে নেয়া হলোনা (অথচ আরাকানের বোঝা আমরা আজো টানছি ঠিকই) আর কলকাতা ছেড়ে দেয়া হলো (অথচ বিনিময়ে তৎকালীন সময়ের ৩৩ কোটি টাকা দেয়ার চুক্তি হলেও একটা কানাকড়িও ভারত দেয়নি)! এ কারণে, দিল্লিপন্থীরা ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট বলেছিলো, ''আরে ভারত ভাগ হইছে কে বলে? ভাগতো করেছি আমরা মূলত বাংলাকে এবং কদাচিত পাঞ্জাবকে!''।
৫)
বাংলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর্যন্ত বিরোধীতা করেছিলো এই কলকাতাকেন্দ্রীক শোষকেরা৷ বঙ্গভঙ্গ রদের বিনিময়ে ইংরেজ দখলদাররা ঢাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় করলো ভাগ্যের নির্মম প্রহসনে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই কলকাতার মানসিক দাসত্ব করা একাডেমিক ঝাঁকে ঝাঁকে তৈরি হলো, এখনো হচ্ছে। ১০০ বছরে ১০০ টি মৌলিক গ্রন্থই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে আসেনি। এখানকার শিক্ষকরা বসে আছে কলকাতার প্রেমে মশগুল হয়ে! এদের একজনকে ধরে এনে আহমদ ছফা নীলক্ষেতে নিয়ে গিয়েছিলেন দেখাতে যে কীভাবে সেখানে বই বেচে কলকাতার লেখকদের জীবীকা হয়।
৬)
এখন, এই সময়ের তরুণ-তরুণীরা এ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করতেছে৷ কিন্তু সেলেব্রেটি, কবি-সাহিত্যিক, মিডিয়ার কর্ণধারেরা, একাডেমিশিয়ান শিক্ষক/শিক্ষিকা বা নব্য ধনিক ও ক্ষমতাবানেরা সেই কলকাতা আর দার্জিলিংয়ে অর্থ খরচ করে আসে দেদারছে। মানে সাংস্কৃতিক দাসত্ব করে এরা ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের। ভুলে যায় ঢাকার সঙ্গে তুলনীয় দিল্লি, কলকাতা নয়। কলকাতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের খুলনা বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের তুলনা করতে পারেন। 

আমি সব সময় বলি, দুটি পশ্চিম আমাদের মগজে সাংস্কৃতিক দাসত্ব তৈরি করে---পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিম ইউরোপ। এদের ভাঙতে হবে বিউপনিবেশায়িত হতে হলে। রাঁখীবন্ধনওয়ালা ও ওয়ালীদের মাথায় ইতিহাসের এসব ধামাচাপা টীকাগুলোও রাখতে হবে, রাখা উচিত। না রাখলে যারা ইতিহাসের খোঁজখবর আমরা রাখি তারা রাঁখীর মধ্যে এসে এগুলোও রেখে দেবো। এটাই হবে মিথ্যার উপর ফুলশয্যা করা সর্বভারতীয় শরবতখোরদের ঐতিহাসিক চপেটাঘাত। 

সবার মগজ দখল করা যায়না, যায়নি। বাংলাদেশকে ভালোবেসে পালটা প্রতিরোধের জন্য অনেকের মস্তিষ্ক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শাণিত হয়, হচ্ছে, হবে। পঁচা ও/বা সতেজ যেকোনো ইতিহাসের সঙ্গে বন্ধন রাখতে হলে আগে আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী লেখাপড়া করা ও বিশ্লেষণীক্ষমতাসম্পন্নদের  সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া শেষ করতে হবে, হে দাদাগাছা ও দাদানুরাগীপাল। অপ্রিয় সত্য শুনতে, জানতে বা হজম করতে আপনাদের মগজের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি আছে তো?

(কথিত রাখি বন্ধন, দুই বাংলা ইত্যাদি নিয়ে কোনো একটি ফেসবুক গ্রুপে আদিখ্যেতার জবাবে লিখিত।)
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments