জসীমউদদীন (দ এ হসন্ত দিতে পারছি না) এর "ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়" (বইটি অনেক আগের। আমার হাতে পলাশ প্রকাশনী থেকে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে বের হওয়া সংস্করণ। এটি ১৯৬৩ সনের সংস্করণ থেকে মুদ্রিত) পড়ে এক নতুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানলাম।
কয়েকটি বিষয় এখানে জানিয়ে রাখি যা এখানে আছে। পরে সময় পেলে বিস্তারিত লিখবো।
বইটি কলকাতায়ও শেষ হয়ে যায় সমস্ত সংস্করণ! এতোটা পাঠকপ্রিয় হয়!
এ বইয়ে আসা তথ্যের ব্যাপারে ঠাকুর পরিবার আনুষ্ঠানিক আপত্তিও কোনোকালে দেয়নি৷ সত্য ধরে নেওয়া যায় এ কারণে।
আবার, জসীমউদদীন ঠাকুর পরিবারের একজনের নিকট থেকে কামরা ভাড়া করে ঠাকুরদের সঙ্গেই 'বছরখানেক' থাকায় তার বর্ণনাও নির্ভরযোগ্য ধরা যায়।
বই থেকে কী জানলাম?
১। দখলদার ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ঠাকুর পরিবার দেশবিভাগের একটু আগে থেকে নিঃস্ব হতে শুরু করে এবং এ পরিবারের অনেকে দেশবিভাগের পরে প্রায় পথে বসে যায়।
২। জসীমের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতো উদার হওয়ার পরেও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণদের দ্বারা প্রভাবিত হতেন। তিনি অধিকাংশ তৎকালীন 'হিন্দু পত্রিকা' পড়তেন বলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক মগজে বা জগতে মুসলমানদের বয়ানটি কোনোকালেই জায়গা পায়নি।
৩। বামপন্থায় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের এক রক্তের আত্মীয় সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের পরিবারের ভোগ, বিলাসীতা, রাজনৈতিক অদূরদর্শীতা, গণবিচ্ছিন্নতা দেখে জসীমের কাছে বলেন, এদের ধ্বংস অনিবার্য।
৪। রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্পর্কে ভীষণ 'অজ্ঞ' ছিলেন৷ এমন কি সাধারণ সনাতনধর্মীদের সাংস্কৃতিক আচারও তার ভালো করে জানা ছিলো না। পুঁথি যে এতো সমৃদ্ধ সাহিত্য এটি তিনি অনেক পরে জানতে পারেন৷ শান্তি নিকেতন থেকে পুঁথির সংস্করণ বের করার কথা ছিল, অথচ অজ্ঞাতকারণে তা করা হয়নি!
৫। জসীমউদদীন এর নিকট দেওয়া বয়ানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন 'বন্দে মাতরম' গানে মুসলমানদের আপত্তি করার মত ধর্মীয় বিষয় রয়েছে। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি তিনি দেননি বলে জসীম তার সমালোচনা করেছেন।
৬। রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনে 'হিন্দু মহাসভা' এর সাম্প্রদায়িক এক নেতা মুসলিম বিদ্বেষসহ নানা মিথ্যাচার 'ম্যাজিক লন্ঠনের' মাধ্যমে প্রকাশ করলে জসীম তার প্রতিবাদ করেন৷ এতে শান্তি নিকেতন কর্তৃপক্ষ জসীমের চাকরিটিও খেয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়! জসীম চাকরি খাওয়ার আগেই ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন।
৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জসীমউদদীনের প্রথম পরিচয়ে 'নকসী কাঁথার মাঠ' ও 'রাখালী' পুস্তক উলটে পালটে জসীমের দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, "আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলাদেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখেছ। তোমার বই আমি পড়বো।"
৮। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ পড়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জসীম উদদীনকে শান্তি নিকেতনে চলে আসতে বলেন। জসীম দীনেশচন্দ্র সেনের পরামর্শে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যেটির জন্য পরে তিনি আফসোস করেন! অবন ঠাকুর সম্পর্কে জসীমকে খুব আপ্লুত মনে হল।
৯। দীনেশচন্দ্ররা যে পূর্ববঙ্গের গীতিকা যেমন ময়মনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেন তাতে আধুনিক রাবীন্দ্রিক বলয়ের সংগ্রাহক বা কারো কারো হাতের মিশ্রণ আছে বলে জসীম অভিযোগ করেন। এটি রবীন্দ্রনাথও জানতেন। রবীন্দ্রনাথের সিল নিয়ে এই ব্যাপারটা প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তিনি। সম্ভব হয়নি।
১০। জসীমউদদীন খুব একটা নজরুলের ভক্ত ছিলেন বলে মনে হলো না। জসীম তার গুরু রবীন্দ্রনাথের প্রতি এক অর্থে অন্ধপ্রেমী ছিলেন। ঠাকুররা তাকে 'নজরুলের চেয়ে ভালো লেখক ভাবে' এই কথা গদগদ করে তিনি লিখেছেন! রবীন্দ্রনাথের নানা সীমাবদ্ধতাকেও তিনি গ্লোরিফাই করেন। হতে পারে ঠাকুর পরিবারের কাছ থেকে নানা সুবিধা পাওয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এই স্তুতি।
১১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে এই বাংলার আদি সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে পশ্চিমা অনুকরণে অন্যদিকে নিয়ে গেছেন এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় জসীমউদ্দিন সাক্ষ্য দিয়েছেন। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে 'বিশ্বভারতী' এর উপাচার্যকে এ নিয়ে আমি প্রশ্ন করায় তিনি গোঁজামিল দেন। আর বাংলাদেশের সামাদি নামের এক রাবীন্দ্রিক শিক্ষক ভারতের ঐ ব্যক্তির তেলবাজি করতে এতোই আগ্রহী ছিলেন যে, আমাকে পালটা আর প্রশ্ন করতে সময়ই দেননি৷
এখনকার মত তখনো কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার জন্য তদবির ও সুপারিশপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো! বিসমিল্লাহর সেই গলদ আজো চলমান...
আরো অনেক আকর্ষণীয় বিষয় এ বইটিতে আছে। আমি সময় পেলে একদিন এ নিয়ে আলাপ করতে পারি অথবা একটি নিবন্ধও লিখতে পারি।
0 Comments