অক্সফোর্ডের শিক্ষক কেট সুলিভানের সম্পাদনায় ২০১৫ সালে পালগ্রেভ ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত এ বইটির নিবন্ধগুলো আমার কাছে ভারতবর্ষের পরাশক্তি হওয়ার সপক্ষে লিখিত বলে মনে হলো।
এমনকী Forward লিখেনও তৎকালীন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রঞ্জন মাথাই।
বইটির আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ভারতের 'মাতুব্বর' [প্রমিত (অ)শুদ্ধ মাতব্বর] হওয়ার ধারাবাহিক কার্যক্রম।
অনেক আগে শুরু করছি৷ অর্ধেক পড়ে আর পড়িনি। তারপর সাম্প্রতিক সময়ে একটানে আবার প্রথম থেকে শেষ করলাম।
এই বইয়ের কোর আর্গুমেন্ট কেইট সুলিভানের৷
তিনি যা বলতে চান সেটির সাপেক্ষে অন্যান্য লেখকগণ তাদের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেছে এবং প্রায় সবার কথাই 'ভারত বিশাল প্রভাবশালী' হওয়ার দৌড়ে আছে এমন ইঙ্গিত৷
সম্পাদিত এই বইয়ের নিবন্ধগুলোও বেশ ইন্টারেস্টিং।
কেট তার নিবন্ধ ''India's Ambivalence Projection of Self as a Global Power: Between Compliance and Resistance'' এ আলোচনা করেন যে, ভারত যে বিশ্বে সুপারপাওয়ার হতে চায় তা তার দুটি বিপরীতমুখী নীতির আলোকে চলমান।
ভারত নিজের স্বার্থে ভীষণ নমনীয় যেমন হয়, তেমনই তার স্বার্থে কঠোরও হয়৷ এ বিষয়ে কেট স্পষ্ট বেশ কিছু উদাহরণ যদিও দেননি, কিন্তু আমার মনে হয় ভারতের ক্ষেত্রে এ কথা সত্য৷
ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে যেকোনো ক্ষেত্রে অনমনীয়। কিন্তু আরব দেশগুলোর ব্যাপারে বেশ নমনীয়।
আবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে অধিকার আদায়ের সময় ভারত 'মার্কিন চশমায় পৃথিবী দেখে', কিন্তু ভারতের নিজের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখলে সে তার নিজস্ব চাণক্যের নীতিতেই অটল থাকে৷
এ বিষয়টি ব্লক পলিটিক্সের সময় 'ন্যাম' গঠনে ভারতের সক্রিয়তায় দেখা যায়।
আবার ১৯৭১ সালে ভারত মার্কিন চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন করে৷
নানা উদাহরণ টেনে ভারতের ব্যাপারে কেটের অভিমত, ভারত তিনটি সুপ্ত শক্তিকে ধারণ করে যা তাকে পরাশক্তি হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী করে।
কেটের মতে, ভারতের মিশ্রণের (Synthesizing Power) একটি শক্তি আছে। ভারত যেভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন বলয়কে মেইনটেইন করেছে তা অনন্য।
এখনো, রাশিয়া ও ইউএসএ কোনো দেশই ভারতকে তার বলয়ের বাইরে ভাবেনা।
দেশে মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতি থাকার পরেও আরব দেশে গিয়ে কাজ করে, কাজ আদায় করে দেশে টাকা আনতে আরব শেখদের সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক রয়েছে৷
একদিকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সমর্থক, অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রাণের দোসর ভারত! প্রয়োজনে আমেরিকায় যাবে, সেখানের টেক কোম্পানিতে কাজ করবে আবার আমেরিকার পতাকাও বিধ্বস্ত করবে মার্কিন কূটনীতিককে অপদস্থ করলে।
একদিকে সীমান্তে চীনের সঙ্গে বিরোধ, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চলে!
আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান করে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালে আমেরিকা আর সেই পোড়া কাবুলে ছাই দিয়ে আলু পোড়া খায় ভারত। তালেবানরা টেইকওভার করার আগে আফগানিস্তানের থেকে ভারতই সবচেয়ে সুবিধা গ্রহণ করে। সেটি আর্থিক বা ভূরাজনৈতিক যা হোক না কেন।
বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র আবার রোহিঙ্গা সংকটের ঐ সময়ে মিয়ানমারের পাশেও দাঁড়ায়!
ভারতের দ্বিতীয় শক্তির নাম এর নিরপেক্ষ থাকার শক্তি (Didactic Power)। বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারত একটি দেশ দীর্ঘদিন থেকে যার বাইনারি কোনো পজিশন নেই। সে সব শক্তির সঙ্গেই মিলে চলে এবং কেউই এতে তাকে খারাপ জানতে পারেনা।
ভারত World Bank বা IMF এর থেকে সমস্ত সুবিধা গ্রহণ করেও BRICS এর সঙ্গে সদর্পে যুক্ত।
নিরাপত্তা বা সাধারণ পরিষদের যেকোনো ভোটে ভারতকে দেখবেন নিজের স্বার্থে ভোট দেয় এবং প্রয়োজনে 'বিরত' থাকে।
তৃতীয় শক্তি হচ্ছে বিকল্প শক্তি (Alternative) হিসেবে ভারতের টিকে থাকা।
এশিয়ায় চীনের বিকল্প কোন শক্তি আছে যাকে ইউরোপীয় আন্তর্জাতিকতা স্বীকৃতি দেবে?
পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর তবে একে বিশ্বাস করে না ইউরোপ-আমেরিকা।
জাপান অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার সামরিক সক্ষমতা বাংলাদেশের চেয়েও দুর্বল।
দক্ষিণ কোরিয়াও চলে না৷ বাকি থাকে ভারত।
চীনকে কাবু করতে একটি সমশ্রেণীর বিকল্প শক্তি দরকার ইউরোপ ও আমেরিকার।
সেই বিকল্প শক্তি ভারত।
চীন না থাকলে ভারতের এই উত্থানে আপত্তি জানাতো পশ্চিম। কিন্তু চীনের বিকল্প (সে অল্প শ্রমের বাজার বা অন্য যেকোনো কারণে হোক) শক্তি হিসেবে ভারতকে দাঁড় করাতে চায় ওরা। বইয়ের একটি জায়গায় কেট বলতে চেয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নীতি ভারতের চোখে দেখার একটি চল আছে।
এর মানে কি ভারতের সক্ষমতা নাই?
সেটি নিয়ে অবশ্য আলাপ বেশি নাই।
বইটির নানা সীমাবদ্ধতা সম্পাদক নিজেও স্বীকার করেছেন।
তবে আমার চোখে পড়েছে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকার চোখে ভারতকে দেখলেও মধ্যপ্রাচ্যের চোখে কিন্তু দেখা হয়নি। সৌদি, কাতার, আমিরাত থেকে বিলিয়ন ডলার আয় করে ভারত। কেন তারা বাদ গেলো এর কারণ আমি জানি না। হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যকে পশ্চিমা বলয়ে ধরা হয়েছে অথবা মুসলিমদের আলাদা করে বাদ দেওয়া হয়েছে।
অবৈধ ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও কিছু নেই। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পরিমাপ করা হয়েছে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে অথচ এই নিবন্ধটি সমৃদ্ধ ও সামগ্রিক (Critical) নয়।
অন্যদিকে প্রতিবেশি গুরুত্বপূর্ণ 'ছোটো' রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে কোনো আলাপ নাই। পুরো ২৪৪ পৃষ্ঠার বইয়ের কোথাও 'বাংলাদেশ' শব্দটি নাই।
কেন নাই সে বিষয়ে লেখকের 'মেথডলজিক্যাল লিমিটেশন' এ একটি ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু তা আমার যৌক্তিক মনে হয়নি।
তবে এ বই গভীর চিন্তার ক্ষেত্রে কাজে দেবে। ভারতের দীর্ঘদিনের চেষ্টা পশ্চিমাদের নিকট 'সুপারপাওয়ার ইন্ডিয়া' স্বীকৃতি। এ লক্ষ্যে একাডেমিক আলোচনায় থাকার 'ইন্টেলেকচুয়াল পরিকল্পনা' আছে ভারতের।
এ কারণেই এ বইটি আপনি পড়তে পারেন।
0 Comments