সর্বশেষ

বুদ্ধের দর্শন, বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমা ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স)

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। 

মহামতি গৌতম সিদ্ধার্থ বুদ্ধ বৈশাখ মাসের পূর্ণিমার এই ভরা চাঁদের আলোয় প্রায় ২৫০০ বছর আগে এ পৃথিবীতে আসেন। 

এমনই এক বৈশাখী পূর্ণিমার নিশিতে তিনি মহান প্রতিপালক মহাস্রষ্টার নিকট থেকে ঐশী বাণী লাভ করেন।

সুদীর্ঘ ধ্যানে প্রাপ্ত এই বোধিজ্ঞানের মূল কথা ছিল 'অহিংসা পরম ধর্ম'। 

ধ্যানের মাধ্যমে প্রাপ্ত এই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কারণেই সিদ্ধার্থ গৌতমকে বলা হয় বুদ্ধ অর্থাৎ আরাধনায় জ্ঞানপ্রাপ্ত।
বুদ্ধ যে সময়টিতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন সে সময়ে ভারতবর্ষে ঘৃণানির্ভর বর্ণবাদী আর্যদের দাপট। তাদের নানা বিধি-বিধান সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর দিয়ে সমাজে গরীব ও ক্ষমতাহীন শ্রমিক-মজুর শ্রেণিকে অচ্ছুৎ, অবহেলিত করে রাখা হতো। নারীদের জীবন্ত পোড়ানো ও নারী-পুরুষ  নির্বিশেষে শোষকদের প্রয়োজনে বলীর শিকার হতো। সুবিধাবাদী বিভাজনবাদীদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেও নিপীড়নের ভয় ছিল! অধর্মের প্রচলন ছিল ধর্মের নামে।

উঁচু-নিচু জাত, নানা বর্ণপ্রথা, দলিতদের ধর্মগ্রন্থ ছুঁতে না দেওয়া ইত্যাদি হিংসা-বিদ্বেষ ছিল স্বাভাবিক! সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবারের সন্তান হলেও বুদ্ধকে ভীষণভাবে ভাবায় এই অনাচার। সাধারণের প্রতি হিংসা ও দ্বেষ দেখে তাঁর হৃদয় কাঁদতো!

তাই তিনি ঘর ছেড়ে, এ জগৎ সংসার ছেড়ে পরমের স্বরূপ খুঁজতে ধ্যানে বসলেন। মানুষ ও সমস্ত প্রাণীর মুক্তির জন্য এ ধ্যান। 

সেই একাগ্রচিত্ত ধ্যানের ফলে এমনই এক বৈশাখী পূর্ণিমায় তিনি সেই পরম জ্ঞান বা বোধি নিয়ে এলেন--'অহিংসাই প্রকৃত ও চূড়ান্ত ধর্ম'; 'জীবহত্যা মহাপাপ' এবং 'দুঃখ মোচন করে জগতের সমস্ত প্রাণের সুখ-শান্তি কামনাই' ধর্মের পরম প্রার্থনা।

সে সময়ে তাঁর এই বাণী ছিল প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার শ্রেণিবৈষম্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা। তাঁর আগে এই একই ধরনের অধর্মকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন নবী ইব্রাহিম (আ)। তাঁর পরে এই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন নবী মূসা ও ঈশা ইবনে মরিয়াম আ এবং তারই ধারাবাহিকতায় নবী মুহাম্মদ (স)। মুহাম্মদ (স) দাস-দাসীদের নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের সুবিধাবাদীদের সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ পূর্বপ্রাচ্যে সেটিই করেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে। 

তাঁরা উভয়েই মধ্যপন্থাকে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা বলে গেছেন। উভয়েই শান্তির জন্য বোধিজ্ঞান লাভ করেছেন ধ্যানে।

বুদ্ধের প্রচারে সে সময়ের উপরমহল রেগে গেলেও ভারতবর্ষের পূর্বদিকের লোকে দলে দলে এ ধর্মে দীক্ষিত হতে লাগলো। বিশেষ করে প্রাচীন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ইত্যাদি অঞ্চলে এ ধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। এর বাইরে আফগানিস্তানের শাসকেরাও এক সময় বৌদ্ধ ছিলেন। 

বাংলায় পাল রাজবংশের সময়ে এটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পায়। এখনো, বাংলা ও বিহারের নানা জায়গায় এ অঞ্চলে বৌদ্ধদের অজস্র নির্মাণ ও স্থাপত্য পাওয়া যায়। দ্রুতবর্ধনশীল এ ধর্ম আর্যদের বাঁধায় দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে একেবারেই যেতে পারেনি। 

আর্যদের বর্ণবাদী ব্যবসা, শাসন ও শোষণকে চ্যালেঞ্জ করে বুদ্ধের দর্শন। এ কারণে প্রতিটি আর্য শাসক বা আর্য বিশ্বাসী শাসকের সময় বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে৷ এই অত্যাচারের সর্বশেষ সংস্করণ বুদ্ধিবৃত্তিক যে গৌতম বুদ্ধও আর্যদের এক 'অবতার' যা সত্য নয়। আর্যদের 'অবতারদের' অনুসারীদের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধের দর্শন জন্ম নেয়। দুটি এক নয়।

এতো প্রতিবন্ধকতার পরেও বৌদ্ধ ধর্ম কিন্তু বাংলা থেকে বার্মা ও তিব্বত, কোরিয়া থেকে জাপান হয়ে একেবারে থাইল্যান্ড, লাওস, চীন পর্যন্ত চলে গেছে। আমাদের বাঙালি অতীশ দীপঙ্কর তিব্বত ও চীনে বৌদ্ধ দর্শন প্রচার করতে গিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। আমাদের চর্যাপদের কবিরা বৌদ্ধই ছিলেন।

তবে নানা সময়ে এ ধর্মের ওপর অত্যাচারী শোষকেরা নিপীড়ন চালায়। এর ফলে ভারতবর্ষের এই পূর্ব অংশ থেকে বৌদ্ধরা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। আবার, মুসলমান শাসনামলে দলিতদের সঙ্গে ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিতও হয় একটি বড় অংশ।

আজ যখন বুদ্ধের ধর্মের কথা বলে মিয়ানমারের সন্ত্রাসী বৌদ্ধ ভীক্ষুরা রোহিঙ্গাদের হত্যা করে এবং/বা সে হত্যায় মৌনসম্মতি দেয় তখন বুঝি এরা, নামে ভীক্ষু কাজে সন্ত্রাসী। 

বুদ্ধের শিক্ষা এদের অন্তরে যায়নি। বৌদ্ধের শিক্ষা কারো হৃদয়ে গেলে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে, হাক্কুল ইবাদে মুসলমানদের সঙ্গে বৌদ্ধদের মৌলিক বিশ্বাসে কোনো তফাৎ নেই। বরং হুবহু একই বিশ্বাস দুটি ভিন্ন সময়ে দুই মহামানব প্রচার করে গেছেন।

আমাদের এ অঞ্চলে জন্ম নেওয়া একটি ধর্ম বৌদ্ধ। আমার খুব কাছের মনে হয়। মনে হয়, কেবল হিমালয়ের ওপর বা আরব মরুভূমিতেই নয়, আমাদের এই বাংলার কাদামাটি, এই পূর্ণিমা, এই বৈশাখী ঝড়েও পরম জ্ঞান অর্জন করা যায়। সাধনা করলে সব হয়। 

ড. এম. এ.  রহিমের 'বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস' পড়ছি। তিনি লিখেছেন, মুসলমানদের মধ্যে উমাইয়াদের দ্বারা নিপীড়িত শিয়াদের বিশ্বাস ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যদের দ্বারা নিপীড়িত বুদ্ধের অনুসারীদের বিশ্বাসের মিশ্রণে বাংলার সূফিধারার বেশ কয়েকটি তরিকা গড়ে ওঠে। 
আমার মনে হয়, বিভিন্ন মারেফতপন্থীরা যে মানুষকে সবার উপরে স্থান দেয়, সবাইকে নিয়ে হিংসা না করে ভালোবেসে বোধি-সিদ্ধি লাভ করতে চায় এতে বৌদ্ধের 'অহিংসা পরম ধর্ম' এবং মুহাম্মদ স এর 'আল্লাহর চোখে সবাই সমান' এর মিশ্রণ ঘটেছে। 

প্রায় ৮০ বছর বয়সে এমনই এক বৈশাখী পূর্ণিমায় এ ধরা ত্যাগ করে চিরবিদায় নেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। এই প্রয়াণকে বলা হয় মহানির্বাণ। মৃত্যু বৌদ্ধদের নিকট শেষ হয়ে যাওয়া নয়, বরং এটি মুক্তির পথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযাত্রা হয়ে ওঠে! মুসলমানরাও ঠিক এটিই ভাবে যে, পরম জগতের পথে মৃত্যু সামান্য একটি ঘটনা। 

জাগতিক লোভ-লালসা থেকে মুক্ত হয়ে অহিংসার বরপুত্রের অহিংসা পরম ধর্ম ফের জেগে উঠুক অধর্মে পূর্ণ ধরায়...।

শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধ পূর্ণিমা। এ ধরায় এক বুদ্ধের আধ্যাত্মিক জন্মলাভের পূর্ণিমা। সকলের মন পবিত্র হোক। হিংসা পরাজিত হোক। ভালোবাসা বিজয়ী হোক।

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।

ছবি: টোকিও যাদুঘরে থাকা বুদ্ধের প্রাচীনতম প্রতিকৃতির একটি৷
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments