সর্বশেষ

রাজশাহী, আম নেশা ও বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় : আমালাপ

বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে প্রায় আধাবছরের একটু বেশি সময় আমি রাজশাহী থেকেছি। 
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রমআইন বিরোধী ৯-৬ বন্দিত্বটাও উপভোগ্য ছিলো কিছু প্রবল সৃজনশীল আর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য। 

এদের অনেকেই এখন জাবি, ঢাবি, রাবি, চবি ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যবাদী পৈতার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের হারিয়ে ভালো ভালো কাজে নিয়োগ পেয়েছে, জড়িত হয়েছে নানা উদ্যোগে। 

আমার ভালো লাগে৷ এরা আমার স্বল্পসময়ের অমূল্য মণিমুক্তা। এদের সাফল্য আমাকে ভালো রাখে, এখন---তখনের মতই।

রাজশাহীতে আরো ভালো লাগতো আমার প্রিয় শুদ্ধস্বর শাতিল স্যার, প্রয়াত রাসেল স্যার, রিয়াজ ভাই,  তারেক ও অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে কাটানো স্বল্প তবে প্রাণ বাঁচানো সময়গুলো।

রাজশাহীর প্রচণ্ড গরম, হাড় কাঁপানো শীত ও রুক্ষ প্রকৃতির মধ্যেও পদ্মার চর, পুরাতন নগরী, বরেন্দ্র মিউজিয়াম, রাবি ক্যাম্পাস ও আম-লিচু আমার ভীষণ ভালো লাগতো! 

আরে হ্যাঁ, আম নিয়ে লিখতে চাইছি! তাতে কত স্মৃতি চলে এলো!

যাহোক, আমে আসি। রাজশাহীতে থাকার সুবাদে আম চিনেছি। আগে বাজারের সব আমই আমার এক গাছের বড় ছোট মনে হতো। রাজশাহী গিয়ে আমি ক্ষীরশা, ল্যাংড়া, হাড়ি ভাঙা, কইতর, গুটি, আম্রপলিসহ কত যে আম চিনছি। 
এখন বাজারের ভীড়ে আমি আম দেখে নাম বলতে পারি। 

রাজশাহীতে একা থাকতাম। ছোট ভাই জাহিদের পরিচিত বন্ধু নাহিদের মাধ্যমে মুন্নাফের মোড়ের একটি হোস্টেলের ছোট্ট রুমে প্রথম হলের বাইরের আবাস! এতো ছোট রুমেও যে পরম শান্তি ৬ টার পরে এসে গা এলালে বুঝতাম। 

মুন্নাফের মোড়ে খুবই অল্প টাকায় নানা ধরনের বার্গার, স্যান্ডুইচ, হটডগজাতীয় বিদেশী খাবার ইত্যাদি পাওয়া যেতো। পাশেই ছিলো কালাই রুটির দোকান। 

এ সম্পূর্ণ অপরিচিত নগরে খাওয়া, পড়া, আর পড়ানো ছাড়া আমার কোনো কাজ ছিলোনা। 

ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ল্যাবের আড্ডাটার কারণে ফেস রিকগনিশনে বন্দি ৯-৬ টার দাসত্বটা কম অনুভূত হতো৷ 

তো মুন্নাফের সেই মোড় ছেড়ে আমি এক রুমের বেশ বড় একটি রুমে উঠলাম! আমি শিক্ষক হওয়ায় ও বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় বাড়িওয়ালার মায়ায় অবশেষে বাসা পেলাম! 

কেবল যে ঢাকায় অবিবাহিতদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয় এটা সত্য নয়---পুরো বাংলাদেশে বাড়িওয়ালা নামের চশমখোররা অবিবাহিত ছেলেদের সঙ্গে এই জুলুমটা করে চলেছে৷ নিজ স্ত্রী, কন্যা, ভাড়াটিয়াদের স্ত্রী-কন্যাদের সামলাতে না পারার সবটুকু দায় কেন অবিবাহিত ছেলেদের কাঁধেই দেয়া হয় এ নিয়ে অবশ্য কোনো আলাপ করতে আমি আসিনি। আমি এসেছি আমার আমালাপ করতে।

নতুন বাসায় আমি একলা একলা ঘুমাই আর এক খালা বাসা থেকে রান্না করে খাবার দিয়ে যান। তার নাম আমি মোবাইল টেলিফোনে সেইভ করে রাখি 'ভাত খালা' নামে। 

আমি মুরগীর কলিজা পছন্দ করি এটা জেনে খালা কলিজা আমার জন্য রেখে দিতেন। আমি সেই ভাত খাইলেও ঘুম আসতোনা! 

বাসাটা অনেক আগের, একটু ভৌতিক। আমি লাইট ওয়াশরুমে জ্বালিয়ে আসলে বন্ধ হয়ে যায়, আর বন্ধ করলে একলা জ্বলে ওঠে। বাড়িওয়ালাকে বললে তিনি বলেন, আরে বাবা, আমরা তো তোমার পাশেই থাকি! ভয় কীসের? এতে আমার ভয় একটুও কমতোনা।

তো, আমি কী করতাম? আমি এই সময়ে অফিস শেষে নানা ধরনের আম নিয়ে ঘরে ফিরতাম। 

যেহেতু আমি একজন অধূমপায়ী এবং আজ পর্যন্ত কোনো মাদকদ্রব্য গ্রহণ করিনি এবং করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই, আমি আমই খাইতাম। টাটকা ফরমালিন ছাড়া আম খাইতে আমার ভীষণ আরাম লাগতো। ফলে খালার দেয়া ভাত আর খাওয়া হতোনা। 

সকালে ভাত দিতে এসে রাতের খাবার দেখে খালা বলতেন,'হে বাবা,  ভালো রান্না হয়নিইই?' বলতাম, আমি আম খেয়েছি খালা। 

ক্ষীরশা আমার অনেক পছন্দ। লোকে অকারণে অন্য আম পছন্দ করে। একটু আগে খালার ফোনে কল চলে গেছে ভুলে। কল কেটে দিয়েছি। খালা পালটা কল করছেন মিসকল পেয়ে। মোবাইল ফোনে লেখা এসেছে 
'ভাত খালা ইজ কলিং'। 

খালার বিলের খাতায় আমার নামে মাস শেষে বিল আসতো, শিক্ষক মামা...জমা ২৫০০৷ খরচ ২৪৪৫ বা এ জাতীয়।

রাজশাহীর লোকেদের চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে মেজাজ চড়া থাকে। এই চড়া মেজাজেও এরা একে অপরের সঙ্গে সুরেলা কণ্ঠে আলাপ করে, এমন কী ঝগড়া লাগলেও৷ 

তবে আশেপাশের নানা জেলার লোকের সঙ্গে তাফালিং করলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোকেদের বেশ সমীহ করে চলতো রাজশাহীর লোকে। অবশ্য ঢাকায় যেমন, নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল ইত্যাদি অঞ্চলের লোকেদের বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন, রাজশাহীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কারোও এমন হয়। 

এর একটি কারণ চাঁপায়ের লোকের মাথা গরম, এরা তীব্র প্রতিবাদী ও একটু চাপা স্বভাবের---মানে হিসেবী। 

বিভাগীয় শহর হওয়ার পরেও রাজশাহীকে ফেলে বগুড়া ও রংপুরকে উন্নত করেছে নিজ নিজ জেলার শাসক---এই ক্ষোভ রাজশাহীর অনেকেরই আছে। তবে মেজাজ কড়া ও পর্যটকদের সঙ্গে ভালো করে ব্যবহার না করার কারণে কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় চমৎকার এই নগরী পিছিয়ে আছে।

'পাশতে পাইরছি না' ইত্যাদি বলে যে লোকটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষা বলে সে নাকি না রাজশাহী না চাঁপাই কোনো ভাষাই সঠিকভাবে তুলে ধরেনি---এটাও জেনেছি। এরশাদের সর্বশেষ স্ত্রী বিদিশার বাড়ি এখানে। 

প্রেম-প্রীতি এখানে স্বাভাবিক নয়। তবে গানে এ এলাকা সমৃদ্ধ। আমি ট্রেনে চড়ে বাড়ি গিয়ে এসব আলাপ করলে সবাই খুব মজা পেতো। 

জাতীয় চার নেতার একজন রাজশাহীর। তার ছেলে এখন মেয়র। চার লেনের বিশাল রাস্তা। তবুও এখানে এন্টি-আওয়ামী লীগের সংখ্যা অধিক। বুঝলাম না এর কারণ। ধর্ম হতে পারে।

আবার, আমেরিকান কর্নার আছে, সিআইএ এর পরোক্ষ ফান্ডে চলা অর্গানাইজেশন আছে। কারণ কী? কী জানি!

তবে আমার দুঃখের একটি জায়গা ছিলো রাজশাহী নিয়ে। এই পুরো নগরীর বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশের জীবন জীবীকা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এর ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক, কর্মচারীদের উপর নির্ভরশীল হলেও স্থানীয় কিছু লোক ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করে, এটা একেবারেই স্বাভাবিক এখানে। 

একদিন অফিসে আসার সময় দেখি একটি মেয়েকে মেস এর আশেপাশের লোকাল নামের ছ্যাঁচড়াপাল ভীষণ বাজেভাবে বকছে। মেয়েটির অপরাধ আরেকটি মেয়েকে মেসে এনেছে। আরেকদিন মুন্নাফের মোড়ে রান্না করা এক গৃহকর্মী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে পেটাতে তার লোকাল পোলাপান নিয়ে আসে! আমি ভীষণ বিরক্ত হই। 

একদিন এভাবে একজন ছাত্রের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা দেখে আমি রেগে বলি, নিজের বাড়িতে বসে এতো মাস্তানি করেন বলে আপনাদের মত লোকদের ঢাকায় কেউ গুনবেওনা, গোণেনা--গিয়ে দেখতে পারেন, এইখানে দুর্ব্যবহার করছেন আপনি, ঢাকায় আপনাদের বেল নাই৷ ও আরো নানা স্মৃতি!

আমি একটি ক্ষীরশাপাত হাতে নিয়ে এসব ভেবে ভাত খালার কল ধরবো বলে ভাবছি। এ নগরে একে, এই আমকে বলা হয় হিমসাগর। এই কাজের সাগরে মানুষের ছোট ছোট আবেগগুলো অবশ্য উড়ে যায়...মিথেনের মিতালিতে মানুষের কলরব এখানে দুর্লভ! এখানে যন্ত্রের সঙ্গে কথা বলে মানুষ, এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হয়না অনেক অনেক কাল, বহুকাল---এখানে জীবনের ভীষণ আকাল!

#আমালাপ
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments