কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলস্রোতে চলে আসা ছাত্রনেতা নুরুলহক নুরসহ গণঅধিকার পরিষদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অনেকেই অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে শ্লেষাত্মক স্বরে অভিযোগ করেন।
অনেকেই মাইর খেয়ে, লড়াই করে টিকে থাকা এই তরুণদের 'বিকাশ অধিকার পরিষদ' বলে অনলাইনে বা অফলাইনে অপমান-অপদস্থ করেন।
একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র ও গবেষক হিসেবে এ অভিযোগটিকে আমার নিকট খুবই হাস্যকর মনে হয়।
এ নিয়ে আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই।
রাজনৈতিক দল অর্থ সংগ্রহ করবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
কোনো রাজনৈতিক দল পাবলিকের নিকট অর্থের জন্য সাহায্য না চাওয়া বা ধর্ণা না ধরা অস্বাভাবিক ঘটনা।
রাজনৈতিক দল কী?
একটি জনসমষ্টি কোনো ভূখণ্ডে এক বা একাধিক অধিকার আদায়ের জন্য যখন ঐক্যবদ্ধ হয় এবং রাজক্ষমতাকাঠামোতে অংশগ্রহণ করতে নানা কর্মসূচি পালন করে সেটিই সহজ কথায় রাজনৈতিক দল।
এই দল যখন কোনো ব্যক্তির সম্পদে গড়ে ওঠে তখন সেটি সামষ্টিক স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করে না। বা করলেও ঐ দাতা ব্যক্তির স্বার্থেই তা করতে হয়।
এ কারণে ধ্রুপদী রাজনৈতিক পরিসরে রাজনৈতিক দল গঠিত হয় সামষ্টিক অর্থে।
যে রাজনৈতিক দল গণঅর্থ বা পাবলিক ফান্ডিং এর মাধ্যমে গড়ে ওঠে সেটি গণবান্ধব হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্যে তহবিল গঠন একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
এর কারণ, বড় বড় পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী বা অন্যান্য বড় দাতারা যদি দলে অর্থে দেয় তবে তাদের স্বার্থ বাস্তবায়নের একটি দায়বদ্ধতা থেকে যায়৷
এ কারণে পশ্চিমা বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার স্বার্থে কোন রাজনৈতিক দলের দাতা কে বা কারা এবং তার বা তাদের অর্থের উৎস কী সেটি প্রকাশ করতে হয়।
কেউ যেন অবৈধ অর্থ রাজনৈতিক দলকে দিয়ে তার অবস্থানকে বৈধ না করে অথবা পরবর্তীকালে এ দল সরকার গঠন করলে বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গেলে ঐ অর্থদাতার তাঁবেদারি করে তার স্বার্থ কায়েম করে কী না এজন্যও দাতার পরিচয় থাকা দরকার৷
বাংলাদেশের বা ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখবেন রাজনৈতিক দল গণচাঁদা বা মুষ্টি সংগ্রহ করে চলেছে।
ফকির-সন্ন্যাসীরা এই মুষ্টি দিয়েই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছে।
খেলাফত আন্দোলনের সময় বাংলার মা-বোনেরা হাতের চুড়ি, মাথার টিকলি খুলে দিয়েছিলেন তুর্কি খেলাফত রক্ষা করার জন্য।
কৃষক-প্রজা পার্টি চালাতে শেরে বাংলা ধান চাল উঠিয়েছেন কৃষকদের নিকট থেকে!
মওলানা ভাসানীও সাধারণের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থে দল চালাতেন।
বামধারার সব দল এখনও মুষ্টি (টাকায়) সংগ্রহ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো সিনেমার টিকেট বা অন্য কিছু দিয়ে মুষ্টি সংগ্রহ করে থাকেন।
অতীত ও বর্তমান উভয় সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দুটি বড় দলেরও মুষ্টি সংগ্রহের ইতিহাসের পাশাপাশি বড়-ছোট দাতা রয়েছে।
বাম বা ডানে-- জামাতি-হেফাজতিরাও কিন্তু নিজস্ব দাতা ও সাধারণের দেওয়া টাকায়ই চলে।
এ আলোচনা এজন্য করলাম যে, রাজনৈতিক দল পরিচালনার উদ্দেশ্যে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুলহক নুরদের অর্থ নেওয়াটা রাজনীতির মাঠে কোনোক্রমেই নয়া ঘটনা নয় এবং টাকা উঠানো খারাপও নয়।
দল পরিচালনার জন্য সদস্যদের নিকট থেকে চাঁদা গ্রহণ বা জনগণের নিকট থেকে টাকা নেওয়া অসাংবিধানিক বা আইনগতভাবে অবৈধও নয়।
তবে এ অর্থের একটি স্বচ্ছ হিসাব থাকতে হবে। সেটি বাধ্যতামূলক। এ অর্থ যে বা যারা দিচ্ছে সে বা তাদের অর্থের বৈধ উৎস থাকতে হবে।
এমন কারো অর্থ গ্রহণ করা যাবেনা যার অর্থ, সম্পদ বা টাকা গণবিরোধী বা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌলিক উদ্দেশ্যবিরোধী।
অর্থাৎ রাজনৈতিক দল গঠন ও পরিচালনার জন্য সাধারণ মানুষের থেকে মুষ্টি সংগ্রহ বা সাহায্য প্রার্থনা করা একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং এটি ভালো রাজনৈতিক প্রথা।
শেরে বাংলা, ভাসানীর সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেল সহজলভ্য ছিলো না। ধামায়-বস্তায় ধান চাল নিয়েছেন। এটাই তাদের 'বিকাশ'। সে সময়ে বিকাশ থাকলে নিঃসন্দেহে তারাও এতে অর্থ পাঠাতেই বলতেন।
এ কারণে বৈধ পথে উপার্জিত বাংলাদেশের নাগরিকদের নিকট গণঅধিকার পরিষদ পরিচালনার জন্য নুরুলহক নুর ও তার দলের অন্যদের বিকাশে টাকা চাওয়ায় বা নেওয়ায় কোনো ধরনের অন্যায় নেই।
তবে দলের অভ্যন্তরে এ অর্থের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। স্বচ্ছতার স্বার্থেই পার্টির ডোনারদের নাম সংরক্ষণ করতে হবে৷ দলে অডিট হতে হবে। তবে এই নাম যেন বিরোধীমত বা কাউকে দমনে ব্যবহার না করা হয় সেদিকটাতেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
সুতরাং, যারা নুরুলহক নুরদের বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায় ইত্যাদি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমে অর্থ বা টাকা নিয়ে দল পরিচালনা করার নিন্দা করেন তারা নীতিসঙ্গত রাজনৈতিক সংস্কৃতি গভীরভাবে না বুঝে করেন।
এ নিন্দুকদের উচিত বাংলাদেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস খোঁজার দাবি জানানো।
রাজনৈতিক দলগুলো কার কার কী কী পথে উপার্জিত অর্থে পরিচালিত হয় এটি জানা জনগণের রাজনৈতিক অধিকার।
যদি রাজনৈতিক দল পরিচালনার আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
সবাই সেই আওয়াজ তুলুন।
ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দলের অর্থের উৎস খুঁজুন।
খুঁজবেন তো?
নাকি দুর্বলকে আঘাত করে বিরাট সিপাহী হয়ে গেছেন---এ আত্মতৃপ্তিতে ঢেঁকুর তুলছেন?
[নুরুলহক নুর মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক করলে সেটি নুরের রাজনীতির শুরুতেই বড় ধরনের রাজনৈতিক ভুল। নুরের উচিত এ বিষয়ে জনসম্মুখে ক্ষমা চাওয়া। এতে তার রাজনীতির ক্ষতির বদলে উপকারই হবে। একাডেমিক হিসেবে আমি এ ঘটনা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করি এবং আমার মতামত মেন্দি এন সাফাদি নুরের দুর্বল মুহূর্তে যেহেতু তাদের সাক্ষাৎকারের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সেহেতু নুরুলহক নুর মহাভুল করে সাফাদির সঙ্গে আলাপ করলেও সে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য।
নুরুলহক নুর অসততা করলে, তার পরিবার অবৈধ অর্থ আয় করলে সেটির বিচার হওয়া উচিত।
কিন্তু ব্যক্তি নুরের 'ভুলে' গণঅধিকার পরিষদের মৃত্যু যারা চায় তারা ঐতিহাসিক সম্ভাবনা হত্যা করতে চায়। কীভাবে?
কেন বা কীভাবে সে উত্তর ইতিহাসই দিবে।]
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ফেসবুক থেকে নেওয়া ব্যবহৃত ছবি দুটি গণঅধিকার পরিষদের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রচারণায় ব্যবহৃত হলেও এটি ব্যহারের কারণ নিন্দুকদের একটি যৌক্তিক আলোচনায় অংশগ্রহণের নিমিত্ত ক্লিক করানো।
[বিএনপি-জামাতের সমর্থকরা একটা দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক কার্যক্রম করেনি। আরামে আয়েশে বা আতঙ্কে কাটিয়েছে৷ সেই সময়ে নুরুলহক নুররা রাজনীতি করেছে।
মাইর খেয়ে হোক, জেল খেটে হোক এরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছে। সেই সময়ে রাজনৈতিকভাবে নিস্ক্রিয় বিএনপি-জামাতের সমর্থকরা নুরুলহক নুরদের খুব পছন্দ করেছে। এমন কি তারুণ্যের এ শক্তিকে আওয়ামী লীগ ও বামের অনেকেও পছন্দ করেছে।
যেই না নুরুরা নিজেরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দৃপ্ত অঙ্গীকার নিয়েছে অমনি এসব দলের লোজে খেপেছে! এখন নুরুরা খারাপ। বিকাশ, হ্যান আর ত্যান।
মেন্দি সাফাদির সঙ্গে বড় দুই দলের কেউ না কেউ মিটিং করেছে। বাট, দোষ নুরুর। যদিও আমি মনে করি নুরের এ জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।
বড় দলের বড় বড় ডোনার আছে৷ অথচ নুরের বিকাশে টাকা নেওয়া অন্যায়! অথচ অর্থের স্বচ্ছতার জবাবদিহি এ দেশে কোনো দলই করে না। সেদিক থেকে নুররা অধিকা করে। আমি মনে করি এ স্বচ্ছতা আরো আসা উচিত।
যাহোক, মূলকথা যারা এতদিন ক্যাথার্টিক সাপোর্ট তাকে করেছে, এখন সে নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়ায়ে চায় এটি তারা মানতে পারছে না।]
0 Comments