ইতালীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইতালীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা আন্তোনিও গ্রামসি (১৮৯১-১৯৩৭) বলেন, আমাদের ওপর আমাদের জানতে বা অজান্তে ক্ষমতাকাঠামোর আদর্শ ক্রিয়া করে। তারা আমাদের মন দখল করতে চায়। আমাদের মনের ওপর তাদের ব্যক্তিগত চাওয়া, পাওয়া, খায়েশ আরোপ করে আমাদের মনের স্বকীয়তাকে বিলোপ করতে চায়।
মন দখলের এই ক্রিয়াটি নিরীহ নয় এবং এটি স্বতঃস্ফূর্তও নয়। এই ক্রিয়া জন্ম দেওয়ার জন্য একটি সুচিন্তিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় রাষ্ট্র বা যেকোনো শক্তিকে।
গ্রামসীর সময়ে এতো এতো গণমাধ্যম ছিলো না। অর্থাৎ রাজনৈতিক ভাষ্য উৎপাদনের হাতিয়ার অপেক্ষাকৃত এখনকার সময়ের চেয়ে কম ছিল।
সে সময় (ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির আমল) বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ যেমন--বিদ্যালয়, পত্রিকা, পানশালা, সিনেমা ইত্যাদিতে ক্ষমতাসীনের রাজনৈতিক বয়ান উৎপাদন ও প্রচার করা হতো।
এই যে শাসকশ্রেণী (বা অধিক সত্যার্থে শোষক) পুঁজির মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এমন একটি সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের আঁতাত করায় যেটি আদতে সমাজের বাস্তব অবস্থান (Status quo) নয়।
পুঁজিবাদীরা যে নিজেদের সংস্কৃতিকে সবার সংস্কৃতি হিসেবে উপস্থাপন করে এটাই গ্রামসির সাংস্কৃতিক আধিপত্য (Cultural Hegemony)।
বাংলাদেশের মিডিয়ায় এদেশের অধিকাংশ মানুষের সংস্কৃতি, প্রথা, সামাজিক রীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে মাত্র ১% শহুরে বিত্তশালীদের (বা নব্য ধনিক শ্রেণী) সাংস্কৃতিক আচরণ তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম বা অন্যান্য গণমাধ্যমে সঞ্চালনা বা বিভিন্ন চরিত্রে যে নারী বা পুরুষদের নিয়মিত দেখা যায় তারা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের গায়ের রঙের বা মুখের ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে না৷
যারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে তাদের প্রভুদের কথামতো এই অপ্রতিনিধিত্বশীল মিডিয়া গঠিত হয়েছে। গুটি কয়েক শিকড়হীন বা শিকড়ত্যাগী মন দখলের যুদ্ধে আমাদের মন কেড়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক মফিদুল হক ১৯৮৫ সালেই লিখেছিলেন 'মনোজগতে উপনিবেশ: তথ্যসাম্রাজ্যের ইতিবৃত্ত'। এখন মন দখল নিয়ে একাডেমিয়া, সাহিত্য, মিডিয়া কোথাও আলাপ নাই। সংসদ দখল করে আছে মন হরণকারীরা। ম্যাকব্রাইড কমিশনের মত তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিয়ে কোনো উদ্যোগও নাই ৫ মোড়লের বাটোয়ারা ক্লাব নপুংসক জাতিসংঘের।
মার্ক্স যেভাবে বলেছিলেন, বুর্জোয়ারা 'মিনস অব প্রডাকশন' এ মিডিয়া ব্যবহার করবে এবং উপরতলার দখল নিয়ে নিচের তলার মানুষদের মিডিয়া থেকে গুম করে দেবে সে রকম আর কী!
কীভাবে গুম করবে?
প্রলেতারিয়েতের মনকে দখলে নিয়ে তার স্বকীয় সত্তার বিনাশ করবে। তারপর সেখানে একটি বুর্জোয়া সত্তা ইনস্টল করবে। তখন আকারে সাধারণ হলেও কার্যক্রমে বুর্জোয়া হয়ে দাঁড়াবে প্রলেতারিয়েত!
মন দখল নিয়ে এ যুগেও কেউ কেউ ভাবছেন। রবার্ট ম্যাকচেজনি নামক একজন মার্কিন দেশীয় গবেষক মার্ক্সের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদী কর্তৃক এই মিডিয়া দখলকে আধুনিক ইন্টারনেটের সাপেক্ষে ব্যাখ্যা করতে ২০১৩ তে Digital Disconnect: How Capitalism is Turning the Internet Against Democracy নামক বইটি লেখেন। এখানে ম্যাকচেজনি বলেন, পুঁজিবাদ কেবল যে ইন্টারনেট দখল নিয়েছে তা নয়, সে ইন্টারনেটের দখল নিয়ে গণতন্ত্রকেও দখল করেছে। কীভাবে?
কেম্ব্রিজ এনালিটিকার কথা মনে আছে? নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের তথ্য হাতিয়ে তার বয়ান অধিক প্রচার করেছিল সেটিই দখল।
ফেইক নিউজ, পোস্ট-ট্রুথ সিন্ড্রোম, ইনফরমেশন ডিজওর্ডার তো আছেই বিপজ্জনক পর্যায়ে৷
এর মধ্যে আসতেছে ডিপ ফেইক আর এআই! স্পাই টেকনোলজি আমাদের মনে ওঁৎ পাতছে। গোপনে কী করছি বা কী বলছি, কাকে বলছি তা জেনে আমাদের দখল করার প্রচেষ্টা চলছে।
নোয়াহ হারারি বলছেন, ইন্টারনেটের এই যুগে এতো এতো তথ্যের ভীড়ে ব্যাখ্যা করাটাও একটি ক্ষমতা। সাধারণকে কে এইসব তথ্য ডিকোড করে দেবে?
মতমোড়লরা তো নিজ ধান্ধায় তথ্য আদান-প্রদান করবে। আর একসাথে অনেকের কাছে পাঠানোর জন্য যে ম্যাস মিডিয়া দরকার তা মন দখলকারীদের দখলে চলে গেছে!
ইন্টারনেট, গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিকটকসহ ম্যাসেজ ডিসেমিনেইট করা সর্বমাধ্যম গুটিকয়েক বিলিয়নার পুঁজিবাদীর হাতে। তারা মানবমুক্তির কথা না ভেবে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। এটি ব্যক্তিসাম্রাজ্যবাদ।
সাধারণ মানুষ, ওয়ার্কিং ক্লাস এর সঙ্গে রুলিং ক্লাসের ক্লাশ তাই অনিবার্য এটি আর বলা যাবে না৷ 'ডিজিটাল ডিভাইড' ইতোমধ্যে প্রলেতারিয়েতকে বিপ্লবের ময়দান থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে! (ডার্ক ওয়েবে যে বিপ্লব আসবে তা সত্য নয়, কারণ মুনাফালোভীরাই এর দখল নিয়েছে)।
থিসিস ও এন্টি-থিসিসের এই দূরত্ব নব্য সিন্থেসিসের আগমন থেকে মানবসভ্যতাকে দূরেই রাখছে! মন দখল হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ এখন পুঁজির স্বার্থে ভাবে! তাদের মূল্যবান মূল্যবোধ খুন হয়েছে!
স্নোডেন তো তথ্য ফাঁসই করলো কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলো গোটা পৃথিবীর যে কোনো নাগরিকের ইন্টারনেট পদচিহ্নকে ট্রাক করতে পারে!
রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও যদি এলগোরিদম সরকারগুলোর হাতে যায় তাহলে? সেটিই ভাবনার বিষয়।
আপনার মগজের নিয়ন্ত্রণ নিতেই যাবতীয় নরম ও কঠিন লড়াই। মূলধারার গণমাধ্যমে ইতোমধ্যে পঁচে গেছে। সামাজিক মাধ্যমের দখলও চলে গেলে? জার্গন হ্যাবারমাসের 'পাবলিক স্ফিয়ার' কাগজে কলমেই থাকবে!
গ্রামসীর ভাবাদর্শী এবং ফরাসী মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক লুই অলথুসার (১৯১৮-১৯৯০) গ্রামসীকে (এবং কার্ল মার্ক্সকেও) আরো পরিষ্কার করেন আমাদের সামনে। তিনি বলেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বুর্জোয়া সর্বগ্রাসী শ্রেণীর মাধ্যমে সব ধরনের (ফসল, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদি) উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
এই নিয়ন্ত্রণের সময় সরাসরি বল প্রয়োগ যেন না করতে হয় সে জন্যই বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতাসীন শ্রেণি নিজস্ব এজেন্ডা আরোপ করে।
১৯৭০ এ প্রকাশিত লুই অলথুসারের এ সংক্রান্ত লেখাটি আমাদের মতাদর্শ ও মতাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্র (Ideology and Ideological State Apparatuses) সম্পর্কে জানায়।
বলপ্রয়োগ করে রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের স্বার্থে এবং তাতে চড়া শোষকশ্রেণীর মুনাফার সপক্ষে যে সম্মতি করে সে প্রক্রিয়ার নাম অলথুসার দিয়েছিলেন Repressive State Apparatuses (RSA)।
আর বলপ্রয়োগ ছাড়া যে প্রক্রিয়া সেটি Ideological State Apparatuses (ISA)।
RSA কী সেটি সবাই জানেন। আর্মি, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, আমলাসহ নিজস্ব সরকারি বা বেসরকারি লাঠিয়াল বাহিনী।
তাদের দিয়ে জনসাধারণের মন দখল নিতে হয়। মিশেল ফুকোর মতে, পুলিশ বা লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা নিজেদের মতের বাইরের মানুষকে সমাজচ্যূত করেই ক্ষান্ত হয়না, তাদের শাস্তিও দেয়, দরকারে মানসিক রোগীও বানায়।
ক্ষমতার সাপেক্ষে জ্ঞান উৎপাদিত হতে থাকে। এতে গরীবের কোনো অংশীদারত্বের ছিটেফোঁটাও থাকে না। জ্ঞান হয় ক্ষমতার পাহারাদার। নানা প্রপাগান্ডা সেল গঠন হয় মানুষের মগজকে দখল করতে। মন দখলের সেই লড়াইয়ে জ্ঞান ও অর্থ এক হয়ে যায়৷ জ্ঞান আর অর্থের নেক্সাসে পুঁজির সাপেক্ষে ও সপক্ষে ক্ষমতা টেকসই হয়। এই ক্ষমতা ও অর্থের যোগসাজসে উৎপাদিত জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করতে যে প্রতিজ্ঞান ও চিন্তা প্রয়োজন তার পৃষ্ঠপোষকতা কোথাও পাওয়া যায় না। ফলে বিপ্লব একা একা বিপ্লবীর আশায় নিভৃতে অবস্থান করে।
তাহলে, ISA কী? সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, মোল্লা-পুরোহিত-ভীক্ষু-পাদ্রী, গায়ক, খেলোয়াড়, আলোকচিত্রী, উন্নয়নকর্মীসহ বলপ্রয়োগ ছাড়া যারা কাজ করে। যাদের কাজ নরম উপায়ে মানুষের মন জয় করা। জনপ্রিয় হয়ে অন্যের মন ও কখনো মানসিকতাও দখল করা।
অর্থাৎ, মিডিয়া, বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, সিনেমা, মসজিদ, খেলার দল ইত্যাদিও রাজক্ষমতার স্বার্থের সাপেক্ষে ও সপক্ষে জনসম্মতি বা অসম্মতি উৎপাদন করে মন দখলের লড়াইয়ে শামিল হয়।
বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খান কারেন্ট এফায়ার্সে আগ্রহী না হয়ে মধ্যযুগের ইতিহাস বা লাকা-ফুকোতে মগ্ন থাকেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চলতি বিশ্ব বাদ দিয়ে ষাটের দশকের মওলানা ভাসানী আর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে চলে যান।
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের গণমানুষের সাপেক্ষে নিস্ক্রিয়তা ডা. জাফরুল্লাহর প্রলেতারিয়েতের সাপেক্ষে সরব অবস্থানের কাছে ম্লান হয়।
ফরহাদ মজহারের কাল্ট ইমেইজ মানুষের থেকে তাকে দূরে সরায়।
মুজাহেদুল ইসলাম সেলিমসহ অন্যরা গণবিচ্ছিন্ন!
সাকিব আল হাসান বা মাশরাফি বিজ্ঞাপনে এসে আমাদের ক্রয়বার্তা দেন।
ভাঁড় হিরো আলম ওদিকে নির্বাচনে দাঁড়ায়, মাইর খায়। আবুল খয়ের মোহাম্মদ রইছুদ্দিন ঢালী নামের আরেক ফ্যাসিস্ট ভাঁড় আবার সেটিকে নেতিবাচক বলে জ্ঞান জাহির করেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দাসদাসীদের সব স্বাভাবিক চলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার-মাস্টারনীদের নির্বাচন, ক্লাব, অবৈধ তেলবাজ নিয়োগ সব চলে!
যুগের সাপেক্ষে প্রতিবয়ান হাজির করার সাহস নাই। বুদ্ধিবৃত্তির জগতে মন দখল হয়ে গেছে! মনদস্যুদের সঙ্গমে চক্রবৃদ্ধি হারে মন দখলদার বেড়ে যাচ্ছে।
জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট মক্তবের ফারেগ ম্যাক্স হোরখেইমার (১৮৯৫-১৯৭৩) ও থিওডর এডর্নোও (১৯০৩-১৯৬৯) গ্রামসিকে সমর্থন করে 'Dialectic of Enlightenment' (১৯৪৭) গ্রন্থে 'সংস্কৃতি কারখানা' (Culture Industry) সম্পর্কে ধারণা দেন। অলথুসার এসব তত্ত্বকে সমর্থন করেই তার তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করান।
হোরখেইমার ও এডর্নোর মতে, সংস্কৃতি রাজনীতিনিরপেক্ষ নয়। সংস্কৃতি নিরীহ নয়। জনপরিসরে মানুষ কীভাবে আচরণ করবে, তার সাংস্কৃতিক রূপ কী হবে সেটি যখন শাসকশ্রেণী ঠিক করে দিতে লেখাপড়া, কলা, সঙ্গীত, আলোচনা, সংবাদ, সিনেমা ইত্যাদি ব্যবহার করে সেটিই কারখানা থেকে উৎপাদিত সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতিও পণ্য। এটাতে মুনাফা আছে। এই সংস্কৃতির ভোক্তারা মন দখলের লড়াইয়ে হেরে যায় হাসতে হাসতে, নিজেদের অজান্তে।
এই কারখানাই পলিটিকাল কারেক্টনেস (Political Correctness) বা রাজনৈতিক আদর্শিক বিশুদ্ধবাদিতা ফেরি করে যেটি ক্ষমতার সপক্ষে বয়ান উৎপাদন করতে প্রকাশ্য, সুপ্ত অথবা গুপ্ত শক্তি হিসেবে কাজ করে।
সংস্কৃতি কারখানার মালিক হয় পুঁজিবাদী শ্রেণী৷ (কেবল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে এটি হয় তা নয়, হিটলারের প্রপাগান্ডা মিনিস্ট্রির নাম ছিল মিনিস্ট্রি অব এনলাইটেনমেন্ট আর সোভিয়েত ইউনিয়নের ট্রেনে 'এজিট ট্রেন' নামে ছবি দেখানোর অপপ্রচার সিস্টেম ছিল।
আধুনিককালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ হলিউডের সঙ্গে কোলাবোরেশান করে মুভি নির্মাণ করছে। হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী ভারতে 'কেরালা স্টোরি', 'কাস্মির ফাইলস', 'সীতা-রাম' ইত্যাদির মত অপপ্রচার মুভি নির্মিত হচ্ছে।)
অধ্যাপক ড. Azfar Hussain এখন টিভিতে বড়লোক বিষয়ক আলোচনায় ঠিক এটিই বলেছেন যে, বড়লোক তার রাজনৈতিক বা অন্য কোনো মতাদর্শ টিকিয়ে রাখতেই যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে। তার শিল্প, সাহিত্য, চিন্তা ও কর্ম শ্রেণী বৈষম্য টিকিয়ে রাখার সাপেক্ষে সক্রিয় থাকে। বড়লোক হওয়ার এই শ্রেণীস্বার্থের দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক বা ব্যবসায়ী সবাই কম-বেশি অংশ নিচ্ছে। লক্ষ্য বুর্জোয়া হওয়া এবং বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রিত শাসনকাঠামো ঠিক রাখা।
অধ্যাপক আজফার হোসেন, সংস্কৃতি কীভাবে বুর্জোয়া চিন্তায় আবদ্ধ রেখে ক্ষমতাসীনদের সপক্ষে বয়ান উৎপাদন করে সেটি বোঝাতে 'নন্দনতাত্ত্বিক ঘোর' বর্গটি ব্যবহার করেন। আমার সঙ্গে একটি ওয়েবিনারে তিনি বলেছিলেন, নজরুলের মধ্যে বিপ্লবী সত্তা আছে, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নন্দন আর শিল্প আছে। আমাদের সাহিত্যিক ও একাডেমিয়া রবীন্দ্রনাথের ঘোরে থাকে আবদ্ধ হয়ে যেন নজরুলের মত ' পুঁজিবাদী ভগবান বুকে পদচিহ্ন' এঁকে দেওয়া না লাগে! সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথের ছায়ায় যে বিপ্লববিরোধী ভাষা শিক্ষার সাম্প্রদায়িক রূপ দাঁড়িয়েছে একে নাম দিয়েছেন 'ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়'!
গুরু আজফার হোসেন ভূমি, শ্রম, ভাষা ও দেহ দিয়ে দুনিয়ার সমস্ত নির্যাতন-নিপীড়নের দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যা হাজির করতে চান৷
গণমাধ্যমও এর বাইরে নয়। সংস্কৃতি ভাষার খেলা, গণমাধ্যম ও এর মালিকানা স্থান তথা ভূমির খেলা এবং এখানে কর্মরত ও এর অডিয়েন্স শ্রমিক এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ধারী।
এডওয়ার্ড স্যামুয়েল হারমান (১৯২৫-২০১৭) এবং নোয়াম চমস্কি (১৯২৮-) যখন ১৯৮৮ সালে 'Manufacturing Consent: The Political Economy of Mass Media' প্রকাশ করলেন তারাও মূলত মার্ক্সপ্রভাবিত গ্রামসির 'বুর্জোয়া আধিপত্য তত্ত্ব'কে সমর্থন করেন।
তারা দেখালেন, ৫ টি নেতিবাচক ছাঁকনীকে অতিক্রম করে তথ্য বা সংবাদ মানুষের নিকট আসে।
মিডিয়া মালিক, বিজ্ঞাপনদাতা ব্যবসায়ী, তথ্যের বা কন্টেন্টের উৎস, লাঠিয়াল বাহিনী এবং সাম্যবাদবিরোধীতা--এ পাঁচটি ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে একটি তথ্য জনসম্মুখে আসলে তা আর জনসাধারণের থাকে?
মার্কিন দেশের সাপেক্ষে এই মডেল দেওয়া হয়।
আমার অনুসিদ্ধান্ত বাংলাদেশে এই পাঁচটি ছাঁকনি একীভূত হয়ে কাজ করে। এদের উদ্দেশ্য ক্ষমতাধরদের অনুকূলে সাধারণ মানুষের মন দখল করে সেখানে বুর্জোয়া চিন্তার সপক্ষের বয়ান অনুপ্রবেশ করানো।
এই পাঁচটিকে এক করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ গণমাধ্যমের মালিক যদি ক্ষমতাসীন দলের আদর্শে বিশ্বাস করে তবে তার সম্মতি বা অসম্মতি উৎপাদন প্রক্রিয়াটি সরকারের চাওয়া পাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সরকারের সাপেক্ষে মন দখলের লড়াইয়ে শামিল হলে বিজ্ঞাপন পাবে, বাহবা পাবে এবং নানা প্রণোদনা পাবে। সরকারের বিপক্ষে মন দখলের লড়াইয়ে গেলে বা মন দখল থেকে মনদস্যুদের উচ্ছেদ করলে বিজ্ঞাপন বন্ধ, আইনী ঝামেলা ও নানা অসহযোগিতা আসবে। আবার, স্থানীয় পর্যায়ে মন দখলকারীর বিরুদ্ধে থেকে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক মনমাফিয়ার সপক্ষে জ্ঞান তথ্য উৎপাদন করলে সেটিও দখলদারত্বই।
মন দখল আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক মাতব্বরির পক্ষে হলে অবাধ সুযোগ আর বিরুদ্ধে হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তির নিকট থেকে এজেন্ডা প্রচারে বাঁধা আসে না৷ বিরোধী মতের সপক্ষে মিডিয়ার টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়৷
এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী বুর্জোয়াদের সময়ে সুবিধা নিতেও দুঃসময়ে অনেকে সময়, শ্রম, মেধা ও অর্থ বিনিয়োগ করে থাকেন--- তথ্যপ্রচারে বিরোধীমতের মানুষের মন দখল করতে।
মন দখলের এই সংগ্রাম বহু পুরাতন। নানা সময়ে নানা রূপে এটি চলছে। মূলত RSA এর মাধ্যমে জোর করে এবং জোর সম্ভব না হলে ISA এর মাধ্যমে সুকৌশলে মন দখলের যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে জয় লাভ করতে কেবল রাষ্ট্র, সরকার, মিডিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়, জনপরিসর অধিগ্রহণ করেই থেমে থাকেনা মুনাফালোভীরা, তারা প্রাণ-প্রকৃতির বাসস্থান ধ্বংস করে শহর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানও দখল করে। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ডেভিড হার্ভি (১৯৩৫-)। সামাজিক ন্যায়বিচার করতে হলে তিনি পরিবেশের দখলদারত্বের অবসানের ওপর জোর দেন। আর এই জোর সম্ভব হবে যদি মন দখলকারীদের হারিয়ে দেওয়া যায়। কারণ, পরিবেশ ধ্বংসাকারী ভূমি ও মনদস্যুরা প্রাণ-প্রকৃতি ও সহবস্থানের সাম্যবাদী ধারণা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে দেয় না৷ তারা গণমাধ্যম দখল করে উন্নয়নের বিষাক্ত তবে সুস্বাদু বাণ ছুঁড়ছে।
সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, গণমাধ্যম গণমানস গঠন করতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। এ অবলম্বনে বুর্জোয়া চেষ্টা থাকে। একটি পুঁজিবাদী সামাজিক কাঠামোতে গণসম্মতি বা অসম্মতি উৎপাদনের জন্য আধুনিক সমস্ত মিডিয়া সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তাদের উদ্দেশ্য মন দখল। মন লোপাট। মনে আগ্রাসন। মন থেকে এই দখলদারি, এই লুটতরাজ, এই আগ্রাসন মগজে চলে যায় মুহূর্তের মধ্যে।
মন দখলদার সেই সব মিডিয়ায় কন্টেন্ট হিসেবে আসা মানুষ অথবা মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম মানুষ মূলত আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে চায়।
বুর্জোয়া সমাজে উৎপাদিত তথ্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিটি কর্মকাণ্ড এ কারণে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
তাহলে বোঝা যাবে কী ভাবি আমরা, কেন ভাবি, কখন ভাবি, কীভাবে ভাবি এবং এই ভাবনার সঙ্গেই কেন আমাদের মন দখল বা বেদখল সরাসরি সম্পর্কিত।
কে বা কারা আমাদের মন দখল করছে বা করতে চায়---এই প্রশ্নটি আমাদের করতে হবে। কারণ--
প্রশ্নই উত্তর।
0 Comments