যে সব লোক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান - Salimullah Khan কে নিয়ে কথা বলছেন এদের মনোবিশ্লেষণ বা সাইকোএনালাইসিস করলে দেখবেন এরা হয় লোকটার স্মরণশক্তি দেখে ঈর্ষান্বিত অথবা সলিমুল্লাহ খান মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিয়ে ইতিবাচক কথা বলেন এটা তাদের অসহ্য, অথবা সলিমুল্লাহ খান কেনো রবীন্দ্রনাথের ক্রিটিক হাজির করেন সেই জন্য তার নিন্দায় এরা মুখর! আরেকটি কারণ হতে পারে, সলিমুল্লাহ খানের বিপুল জনপ্রিয়তা।
বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলামবিদ্বেষী তবে নামে সেকুলার বলয়ে বিভিন্ন সময়ে যে 'স্যারবলয়' গড়ে উঠেছিল—জাফর ইকবাল স্যার, সিরাজুল ইসলাম স্যার, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার, আনিসুজ্জামান স্যার ইত্যাদি— সলিমুল্লাহ খান এসে তাদের সেই বলয় ভেঙে নিজেই সবার উপরে উঠে বসে আছেন৷
পাবলিক স্ফিয়ারে এইটা সলিমুল্লাহ খানের অনিচ্ছায় হলেও হয়েছে। সলিমুল্লাহ খানের ভাষায় দীর্ঘদিনের সাধনার 'স্যার ব্যবসায়' মারাত্মকভাবে ভেঙে 'সলিমুল্লাহ স্যার' একচেটিয়া জায়গা করে নিয়েছেন৷
এ ক্ষেত্রে করোনার দুইটি বছর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সময় লোকে ঘরে বসে টকশো শুনতো আর বাগ্মী সলিমুল্লাহ খানের তথ্যসমৃদ্ধ চমকপ্রদ উপস্থাপন জনমনে বিশেষ জায়গা করে নেয়। আমি বিভিন্ন ভিডিও এর নিচে অনেককে দেখি কমেন্ট করে—'স্যার সলিমুল্লাহ' সম্বোধনে!
এঁরা—সাধারণ লোকে— সলিমুল্লাহ খানকে যে উচ্চাসনে বসিয়েছেন তা অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। এই সাধারণের অধিকাংশ আবার মুসলমানের বাচ্চা মুসলমান হওয়ায় মুক্তমনা নামের বদ্ধমনাদের শ্রেণিঘৃণাটি আরো প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে!
অবশ্য আমি সলিমুল্লাহ খানের ভক্ত হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের অমুসলিমদের মধ্যেও প্রচুর আগ্রহ দেখেছি। বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে রিচার্ড ইটনের তত্ত্ব নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যের নিচের কমেন্টে দেখবেন ভারতীয়রা সলিমুল্লাহ খানে মুগ্ধতার শীর্ষে অবস্থান করছিল। এই প্রভাবটিতেও ভীত হতে পারেন কেউ কেউ। সলিমুল্লাহ খান যে এ বাংলা ও বাংলা সব বাংলায় সমান জনপ্রিয়— তাত্ত্বিকভাবে এটা বাংলাদেশের বিশাল জয় এটা যারা মানতে পারেনা তাদের বেদনার শেষ নেই। সেই ব্যথাবেদনাই ঘৃণা আকারে কখনো কখনো প্রকাশ পায়!
২।
যারা মাকদিসির বইয়ের রেফারেন্স টেনেছেন তারা ঠিক কোথায় কোন কনটেক্সটে উনি কী বলেছেন এটাই জানেন না অথচ খান সাহেবের নিন্দা করে যাচ্ছেন। আমি এ নিয়ে কপিপেস্ট করে যারা লিখেছেন তাদের কাছে রেফারেন্স চাইছি, দিতে পারেননি৷ কিন্তু মাকদিসি পড়েও আমি সলিমুল্লাহ'র বক্তব্যের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখিনি।
খান সাহেব যা বলেছেন তা হচ্ছে, ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থারই সম্প্রসারিত রূপ। এর মানে ইউরোপ মাদ্রাসা হয়ে গেছে বা মাদ্রাসা থেকে হয়েছে উনি তা বলেননি। উনি বলেছেন, ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থায় চার্চের প্রভাব।
এটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই যে, অক্সফোর্ডসহ বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় মূলত খ্রিস্টান মাদ্রাসাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। প্রাচ্যের ফারেগ হওয়া সংস্কৃতি, পাগড়ি দেওয়ার সংস্কৃতিরই ইউরোপীয় রূপ গাউন—আমরা সমাবর্তনে গাউন আর টুপি কেনো পরি তা ভেবেছেন?
আবার, মিশনারী স্কুল বা কলেজগুলো আমাদের দেশেও ভালো। নটরডেম কলেজ যেমন বাংলাদেশে আছে, তেমনই নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ও পশ্চিমে আছে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ধর্মতত্ত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিভাগও খুলেছে।
আমার বুঝে, সলিমুল্লাহ বোঝাতে চান—মাদ্রাসা মানে কেবল মওলানা আর হাফেজ বানানোর কারখানা নয়, মাদ্রাসা মানে ধর্মের প্রভাব থেকে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইউরোপ বা আমেরিকার সরকারে বা সেখানের ক্যাম্পাসে ডানপন্থী ইভ্যাঞ্জেলিক্যালদের কী পরিমাণ প্রভাব সেটি কিছুদিন আগে হার্ভাডের প্রেসিডেন্ট ক্লদিন গে এর অপসারণ তো দেখিয়েই দিয়েছে!
যারা মাকদিসির বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সলিমুল্লাহ খানের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছেন তাদের ভুয়া কথার জবাবের জন্য সলিমুল্লাহ খানের সংক্তান্ত বক্তব্যটি আমি এখানে দিলাম। আশা করি কপি-পেস্ট করে বিদ্বেষের প্রকাশ করে তথ্যনৈরাজ্যের ধারক ও বাহকেরা কিছুটা লজ্জা পাবেন যদি জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী হন। চলুন দেখি উস্তাদ সলিমুল্লাহ খান আসলে কী বলেছিলেন:
*The Idea of the Western University: Remarks on the Researches of George Makdisi (1920-2002)*
by
Salimullah Khan
In this lecture I propose to introduce two remarkable works by George Makdisi (1920-2002): "The Rise of Colleges: Institutions of Learning in Islam and the West" (Edinburgh, 1981) and "The Rise of Humanism in Classical Islam and the Christian West" (Edinburgh, 1990).
Dr. Makdisi was one of the ablest scholars in Arabic and Islamic Studies. After an early education in the US and in Lebanon Makdisi earned a doctorate in Paris in 1964. After stints in both Michigan and Massachusetts till 1973 he moved to the University of Pennsylvania where he retired from his Chair in 1990.
George Makdisi traced sources of European scholasticism and humanism in the Arab-Islamic tradition. In his two books Makdis dispelled the myth of the West as sui generis, offering a pluralist view of human history. In "The Rise of Colleges" he traced the development of institutions of learning in the Islamic lands keeping in focus the formation and development of the madrasa, or colleges devoted to the study of law and to training learned men in law for various juristic occupations.
After reviewing the genesis and structure of the four madhabs or "schools of law", Makdisi traced origins of the madrasa and explicated the areas of specialization in terms of both their subject-matter of instruction and material organization. He showed, for example, that the "masjid/khan" (teaching unit combined with student dormitories) was the forerunner of the madrasa.
He then dealt with financial foundations of the madrasa, namely the institution of the "waqf" and how that institution served as means for funding the madrasa as a scholastic community comprising professors, students and myriad other functionaries.
Makdisi argued that the technique of incorporation, combined with the college system, gave the Western institutions a greater flexibility (and perhaps a longer life- span) than their Muslim counterparts. He also attended to the scholastic methodology ("sic et non") and its roots in the dialectic of the Islamic legal education.
In "The Rise of Humsnism" Makdisi drew attention to "the parallels, in both their number and significance, between the humanism of classical Arabic Islam and that of the Christian Latin West." We learned from the received history of European humanism "what" that movement was and "how" it had risen in Italy but there was no explanation, Makdisi observed, as to "why" the movement began in Italy instead of France, "home of a great literary tradition that appears to have been lacking in Italy".
The origin of the "mysterious urge" for humanism in Italy remains an obscure integral the established literature on the humanist movement in Italy.
Scholasticism and humanism, two major intellectual movements in medieval intellectual history, carry the signature of classical Islam clearly legible on their essential constituent elements," concluded George Makdisi.
Eurocentric historians are at best willing to agree to "a spontaneous movement of the human mind for the orgin of the universities" or to a "mysterious urge" for the rise of humanism. They are, however, at complete odds on the matter of influence of Classical Islam on the Christian West. Thus they are forced to alternately espouse two opposed theories: the theory of common spirits among different peoples and the theory of utter opposite spirits in the one and the other people. None of the two theories can really afford to face even the possibility of influence of Islam on the West.
What is the upshot then? "It is an extraordinary thing," as Edward Said, the author of "Orientalism," has commented, to discover "that the origins of the modern system of knowledge that we call humanism did not originate, as Jacob Burckhardt and many others believed it did, in Italy during the fifteenth- and sixteenth century Renaissance, but rather in the Arab colleges, madrasas, mosques, and courts of Iraq, Sicily, Egypt, Andalusia, from the eighth century on. And in those places were formed the traditions and the curricula of legal, theological, as well as secular, learning--the so called "studia adabiya"--from which European humanists, like Pico della Mirandola, Ficino, Aretino, and Thomas More, derived many of their ideas, not only about learning itself, but also about the environment of learning, where disputation, dissent, and argument were the order of the day."
Dhaka: January 23, 2024
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মাকদিসির কাঁধে বন্দুক রেখে যারা সলিমুল্লাহ খানকে কুপোকাত করতে চাচ্ছেন তারা সলিমুল্লাহর কথা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন৷
এক্ষেত্রে আরেকটি আলাপ হচ্ছে, মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষকদের অধিক যোগ্য করে দেখানো৷ এটা সত্য যে কিছু মাদ্রাসার ছাত্র বা শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র বা শিক্ষকের চেয়ে অধিক প্রজ্ঞা বা মেধার অধিকারী। তবে আমি এ এক্ষেত্রে সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন অনেক ছাত্র বা ছাত্রী বা শিক্ষক রয়েছে যারা মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের চেয়ে বহুগুণে গুণান্বিত। তবে এ সংখ্যা এখন হ্রাস পাচ্ছে শিক্ষক নিয়োগে অস্বচ্ছতার কারণে৷ অপদার্থ, অযোগ্য নানা লবিং, বাণিজ্য বা তেলবাজি করে যখন শিক্ষক/শিক্ষিকা হয় তখন তাদের যোগ্যতা নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ। আমার মনে হয়, সলিমুল্লাহ খান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অযোগ্যতার কথা বলেন, তখন এই গর্দভ শ্রেণিটির কথাই বলেন যাদের একাডেমিক গবেষণাও নেই, আবার ক্লাসে পড়ানোর সমৃদ্ধ দক্ষতাও নেই। তারা কেবল ৯-৪টা চাকরি করে পাবলিকের পয়সায় বেতনভাতা খেয়ে কুরাজনীতি বা সেলফিবাজি করে বেড়াচ্ছে৷
৩।
সলিমুল্লাহ খানের ব্যাপারে দ্বিতীয় আপত্তি হচ্ছে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এ কথা বলেছেন যে, 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন'। আদতে সলিমুল্লাহ খান এই কথা কোথাও বলেননি। বরং তিনি কোনো এক বক্তব্যে বলেছিলেন—যার মর্মার্থ এমন— 'রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় তো আমাদের মধ্যে কেউ নাই। তাই তাকে ছাড়াতেই তাকে ক্রিটিক করতে হবে।'
যারা ধান ভাণতে শিবের গীত গাচ্ছেন 'গড়ের মাঠের সভাপতিত্ত্ব' এর কথা বলে তারা জানেননা, সলিমুল্লাহ খান নিজেও এই গড়ের মাঠ তত্ত্বের বিরোধী।
তিনি না বললেও আমি বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হোক তা চেয়েছেন এর সপক্ষে প্রমাণ নাই, কোনো প্রমাণ নাই! আছে? দেখাতে পারেন?
পড়ালেখা না করাদের আরো জানা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী করেছেন পশ্চিমবঙ্গে এবং এ থেকে বোঝা যায় যে পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের জমিদারি করের পয়সা খেয়ে উনি জীবিকা নির্বাহ করলেও সেই অঞ্চলে উনার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ্রহ ছিলোনা।
সবচেয়ে সরল প্রশ্ন, বিরোধিতা বাদ দেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন এর সপক্ষে রবীন্দ্রনাথের একটি বিবৃতি বা লেখা দেখাতে পারেন? এতো এতো লেখা, চিঠি থেকে দুয়েকটি বের করেন তো! পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় করবেন এমন কোনো প্রমাণ আছে? বরং পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে গঠিত নয়া প্রদেশ এর বিরোধিতায় তিনি 'রাখি বন্ধন'সহ বহু কিছু করেছেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী গোঁড়া আশুতোষ মুখার্জির সঙ্গে সম্পর্কও ভালো ছিল উনার।
আর একটা চমকপ্রদ তথ্য আপনারা তুলনা করলে বুঝবেন, রবীন্দ্রনাথ আদৌ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা চায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই। ঐ একই বছর ৫ মাস পর অর্থাৎ ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। বোঝা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-জ্ঞান ছিলো ঐ বিশ্বভারতী নিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই তার আগ্রহের বিষয় ছিলোনা। এ কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নীরবতাই মূলত এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার মৌনঅসম্মতি ধরে নেওয়া যায়। এটা কেউ না ধরলে বুঝতে হবে সে ঠাকুরের মনস্তত্ত্ব ও ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য ও শুভাকাঙ্ক্ষা থেকে মুসলমান সমাজ বাদ পড়ার বিষয়ে অজ্ঞতার নিম্নাবস্থায় বাস করছে।
এই কথাগুলো সলিমুল্লাহ খান বলেননি কিন্তু আমি বলতে চাই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১ এর বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯১২ এর নাথান কমিশন গঠন, ১৯১৩ এর নোবেল পুরস্কার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং ১৯১৪ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে যুক্ত করে আমি মঈনুল রাকীব বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কারের ভূরাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্রিটিক্যাল ডিস্কাসন করা সম্ভব।
আজকের যুগেও শান্তি ও সাহিত্যে যারা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন সেখানে পশ্চিমা শক্তির রাজনৈতিক স্বার্থ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় উপমহাদেশের ফসল এবং জনসম্পদ ভীষণ জরুরি ছিল ইংরেজদের। বাঙালি পল্টনের বীরযোদ্ধাগণ সে প্রমাণ দিয়েছেন৷ আমার আগে এ নিয়ে আর কেউ কথা বলেনি এটা আমি নিশ্চিত৷ মৌলিক চিন্তা খোঁজা প্রকল্পের লোকজনরা আমার এই মৌলিক চিন্তার ব্যাপারে যৌগিক ভাবনা ভাবতে পারেন। এটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি কোনো দ্বেষ নয়, একাডেমিক আলোচনার বৈশিষ্ট্যই এই যে, গবেষককে নির্দয় হতে হয় সত্যের কাছে পৌঁছাতে।
সলিমুল্লাহ খান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অসম্মান করেননি। তিনি এবং আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদিরূপ—জমিদার ও পুঁজিবাদী রূপকে— ভুলে গিয়ে, চাপা দিয়ে তাঁকে পাঠ করা যাবেনা এটা আমরা বলছি।
কারণ, পাঠকের হাতে পড়ে বিনির্মিত রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিকতা বিরোধী লড়াইয়ে হাজির হতে পারেন, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ তার প্রমাণ। আমরা রবীন্দ্রনাথকে বিপ্লবের টুল হিসেবে ব্যবহার করেছি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে কাজে লেগেছেন নজরুলের পাশাপাশি।
আবার, এই রবীন্দ্রনাথই বিপ্লববিমুখ আত্মকেন্দ্রীক গণবিচ্ছিন্ন একটি সমাজের কাছে বিনির্মিত হয়ে নিরীহ প্রেম ও ভোগের খোরাক হয়ে টিকে আছেন। এই রবীন্দ্রপ্রেমীরা আবার নিরীহ নয়। খুনী পাকিস্তানী হানাদারদের মতই তারা আবার আগ্রাসী।
এ কারণে আদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে যেতে হবে—যে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধী ত্যাগ করলেও ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে যাননি, যে রবীন্দ্রনাথ সিরাজকে বাদ দিয়ে শিবাজি ও ব্রিটিশ রাজাকে নিয়ে কবিতা লেখেন, যে রবীন্দ্রনাথ জসীমউদ্দিন এর 'ঠাকুরবাড়ির আঙিনা' মোতাবেক কেবল হিন্দুদের বয়ান ফেরী করা পত্রিকা পড়তেন, যে রবীন্দ্রনাথ আহমদ ছফার মতে 'গোরাকে দলিত হিন্দু বা মুসলমান' এর গর্ভে জন্ম দেননি, যে রবীন্দ্রনাথ নিজেই ঐকতান কবিতায় উঁচুতলায় থাকায় সমাজের সবার কাছে যেতে পারেননি স্বীকার করছেন—নন্দনতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি আমাদের এই রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও পাঠ করতে হবে। কারণ, মুসলমান ও দলিত সনাতনধর্মীদের ব্যাপারে উদাসীন শ্রেণিটির প্রিয় হচ্ছে 'নান্দনিক রবীন্দ্রনাথ', তারা রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করেননা। সলিমুল্লাহ খান এই রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথকে— যিনি 'খুন' শব্দটি মুসলমানদের ব্যবহৃত শব্দ ভান্ডারে দেখা যায় বলে তা লিখতে চাননা (কিন্তু নজরুল তো 'বাঙ্গালীর খুনে ক্লাইভের খঞ্জর লাল' করে লিখেন)—পুনর্পাঠ করাতে চান৷ এ জন্য সলিমুল্লাহ খান সম্মানের যোগ্য। সলিমুল্লাহ খানের সব মতের সঙ্গে আমি একমত না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, সিরাজ, সাদ্দামের ব্যাপারে তিনি সহিহ। এই সলিমুল্লাহ সম্মানপ্রাপ্তির দাবিদার।
যদি না পারেন সম্মান দিতে সলিমুল্লাহ খানকে অসম্মান কইরেন না। অধ্যাপক আজফার হোসেন, সলিমুল্লাহ খান—ইনারা কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ। মনে রাইখেন, বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাসে সলিমুল্লাহ খান হবেন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।
সলিমুল্লাহ খান বলতে চান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'কী' আর 'কি' কে যে আলাদা করেছেন—যা বাংলা একাডেমিও যাচাই না করে অনুমোদন করেছে এবং হায়াত মামুদসহ অন্যান্য রাবীন্দ্রিক পণ্ডিতরা একে মেনে নিয়েছেন—তা ভাষার স্বাভাবিক গতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।এটাতো সত্য, আমরা কী আর কি একই উচ্চারণ করি এবং ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় করে নির্ধারণ করে কোনটি 'কি' হিসেবে। ভাষার ওপর অহেতুক মাতুব্বরি আর পাণ্ডিত্য করার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলা একাডেমি, প্রথম আলো, আমীন গং একই ভূমিকা পালন করছে যা ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করা সলিমুল্লাহ খান মেনে নিতে পারেন না। তিনি এদের বিরুদ্ধে এক অর্থে একাই লড়াই করছেন। প্রথম আলো থেকে লেখা বা প্রথমা থেকে তার বইও প্রকাশ তিনি করেননা এ কারণে। এটা বিশাল বিপ্লবী অবস্থান। এই যে, প্রথম আলোর বলয়ের বাইরে থেকে একজন জনবুদ্ধিজীবী হিসেবে সলিমুল্লাহ খানের উত্থান হচ্ছে এটাও প্রথম আলোর ভোক্তা নিখিল বঙ্গীয় সংকীর্ণ রাবীন্দ্রিক ঘৃণাজীবীদের সলিমুল্লাহবিরোধী রূপে হাজির করছে বলা যায়।
অবশ্য ঠাকুরের বেওয়ারিশ এই চ্যাঁলারা এটা মানতে নারাজ যে সলিমুল্লাহ খান জীবন্ত জ্ঞান কোষ এবং ঐভাবে রেফারেন্স দিয়ে কথার মধ্যে একাডেমিক ছাঁচ দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রেফারেন্স ছাড়া গালগল্প সবাই করতে পারে, কিন্তু শ্রুতিমধুর করে তথ্যনির্দেশ করা সলিমুল্লাহ খানের মৌলিক অবদানই আমি বলবো। রেফারেন্স দিয়ে অনেকেই বলেন বা বলতে চান, কয়জন সলিমুল্লাহ খানের মত সুপাঠ্য বা সুবাগ্মীরূপে মত প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন? আমি দেখিনা তার ধারেকাছেও কাউকে। এ কারণেই রবীন্দ্রমৌলবাদীরা সলিমুল্লাহ খানকে ভয় পায়। এদের পূর্বসূরী রবীন্দ্রচ্যাঁলা দ্বারা বিপ্লবী মহাকবি কাজী নজরুল ইসলামও আক্রান্ত হয়েছিলেন (অবশ্য তিনি কাঠমোল্লাদের দ্বারাও বিব্রত হয়েছিলেন)। কীভাবে ঠাকুরের মাৎস্যন্যায় কার্যকর ছিলো সে বিষয়ে 'ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়' (সলিমুল্লাহ খান, ২০২৩) গ্রন্থই সলিমুল্লাহ খান লিখে ফেলেছেন। নজরুল লিখেছিলেন 'বড়র পিরিতি বালুর বাঁধ'।
৪।
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান পিএইচডি-কে বুঝতে হলে আহমদ ছফাকে বুঝতে হবে। সলিমুল্লাহ আগাগোড়া ছফা দ্বারা প্রভাবিত৷ এমনকি ছফার খুবই নিম্নমানের মুসলমানবিরোধী রচনা 'বাঙালি মুসলমানের মন' নামের রাবীন্দ্রিকদের প্রিয় প্রবন্ধকেও 'আসমানী কিতাবের মত সত্য' ধরে আলাপ করেছেন সলিমুল্লাহ খান। আমি অবাক হয়ে যাই এতো রাজনীতি সচেতন একজন বুদ্ধিজীবী কীভাবে ছফার এই বাজে ও বাঙালী মুসলমানবিদ্বেষী নিম্নমানের লেখাটি ফেরি করেন! আমি বিশ্বাস করি, ছফার যেমন ১৯৯২ এর ৬ ডিসেম্বরের পর 'সজ্ঞান' ফিরেছে, সলিমুল্লাহ খানও 'বাঙালি মুসলমানের মন' যে একটি জাতিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী, ইসলামবিদ্বেষী টুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটি অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন। সে অন্য আলাপ। এই অর্থে রাবীন্দ্রিকরা ধরেই নিয়েছিল 'সলিমুল্লাহ তাদেরই মুসলমানবিদ্বেষী' রূপে চিরকাল থাকবেন। অনেকে শাহবাগের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা হিসেবেও তাকে পাঠ করেন, অভিযুক্ত করেন। শাপলার ইমাম ফরহাদ মজহারের হেফাজতসেনাদের বিপরীতে শাহবাগের শাহবাগীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইমাম হিসেবে সলিমুল্লাহকে সেই সময় মিডিয়ায়ও আনা হয়। আমার এক শিক্ষক তখন তাকে 'সেকুলার আইকন' হিসেবে তুলে ধরেন!
কিন্তু শাহবাগের বহু আগেই সলিমুল্লাহ সিরাজ উদ দৌলা, আদমবোমা ইত্যাদি চিন্তা শুরু করেন। ২০০৯ এ এইসব লেখা তার।
এ কারণে মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা বা অতীত ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর হওয়া জুলুমের প্রতিবাদ করা তাঁর বক্তব্যগুলো ভাইরাল হয়ে গেলেই 'বাঙালি মুসলমানের মন' পড়ে মুসলমানদের ছোট করতে অভ্যস্তদের গাত্রদাহ শুরু হয়। এর মধ্যে আবার শাহরিয়ার কবির, সুলতানা কামাল, খালেদ মহিউদ্দিনসহ সেকুলারদের মোটামুটি সমস্ত আইকনকে সলিমুল্লাহ বাতিল করে দিলেন মুখোমুখি আলোচনায়—ইতিহাস, তথ্য ও যুক্তি দিয়ে। মূলধারার বয়ান থেকে ইসলামবিদ্বেষীদের প্রায় উচ্ছেদই করে দিলেন সলিমুল্লাহ খান—মাদ্রাসার শিক্ষকদের সামনে ভার্সিটির শিক্ষকরা কথা বলে টিকতে পারবেনা—এ জাতীয় কথাও আছে যার সাথে আমি একমত নই সর্বাংশে। 'অযোগ্যতার দুষ্টচক্র' এর মাধ্যমে অথর্ব শিক্ষক বা শিক্ষিকা নিয়োগের কারণে শিক্ষকদের মান এমনিতেই নাই। এর মধ্যে সলিমুল্লাহ খান তাদের কাছা আরো খুলে দিলেন! এইভাবে সলিমুল্লাহ খান তাদের—সেকুলার নামে পরিচিত মুসলিমবিরোধীদের—সংকীর্ণ পকেট থেকে বের হয়ে পুরো বাংলাদেশের সবার হয়ে উঠলেন। আমার মনে হয়, সলিমুল্লাহ খানের গণবুদ্ধিজীবী হয়ে উঠার এই অভিযাত্রা ভীষণ সময়োপযোগী একটি গবেষণার যোগ্য বিষয়।
সলিমুল্লাহর গুরু ছফায় ফিরি। ছফা অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে নতুন কিছু অনুসিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেটি নিয়ে আহমদ ছফার স্মৃতিগ্রন্থ হিসেবে 'গরিবের রবীন্দ্রনাথ' (পরিমার্জিত ২০২৪) এ বছর বইমেলায় পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপে প্রকাশ হয়। এ বইটি সলিমুল্লাহ খানের সম্পাদনয়া মধুপোক . modhupok থেকে বের হয়েছে। এখানে দেখা যায়, ছফা প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অনুরক্ত হলেও শেষ সময়ে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের মতই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পুঁজিবাদীদের প্রতিনিধিই ভেবেছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন কেনো এতো বিস্তৃত সাহিত্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কোনো প্রধান চরিত্র মুসলমান নামের কেউ নাই, কেনো কোনো একটি পুরো বই মুসলমানদের নিয়ে নাই!
আমার মনে হয়, এই বিষয়গুলোও রবীন্দ্রমৌলবাদীদের সলিমুল্লাহ খানের প্রতি গোস্বার কারণ৷ কিন্তু এ দিয়ে তো সলিমুল্লাহ খানকে হারানো যাবেনা৷ তথ্যের সামনে, যুক্তির সামনে, বাস্তবতার সামনে নন্দনবিভ্রম(গুরু অধ্যাপক ড. আজফার হোসেন Azfar Hussain বর্ণিত 'নন্দনতাত্ত্বিক ঘোর') এর মধ্য থেকে উৎসরিত রাবিন্দ্রীক ঘৃণা কাজ করবেনা। অধ্যাপক আজফার হোসেনও—আমার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের এবং সত্যি বলতে, বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চিন্তক যিনি আদর্শচ্যূত হয়ে পুঁজির কাছে বিক্রি হননি—সলিমুল্লাহ খানের জ্ঞানের তারিফ করতে ভুল করেন না। আর এ কারণে আমিও সলিমুল্লাহ খানকে এড়িয়ে যেতে পারিনা।
৫।
সলিমুল্লাহ খানের ব্যাপারে আরেকটি অভিযোগ উনার স্ত্রী শেখ মুন তাসলিমার লেখা গ্রন্থ 'যদ্যপি আমার গুরু-পতি'তে উল্লেখিত কিছু ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে সলিমুল্লাহ খানের গুণকীর্তনই অধিক পাবেন। খুবই স্বল্প পরিসরে দুটি অভিযোগ আছে।-
ক) সলিমুল্লাহ খান মুনের আগের ঘরের সন্তানের ভরণপোষণ একটা সময় দিতে চাননি
খ) ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড বাচ্চাটিকে একদিন রাগের মাথায় গালে চড় মারেন
সলিমুল্লাহ খান এবং তার সাবেক স্ত্রী দুইজনেই আইনের শিক্ষার্থী। এ বইয়ের রিভিউ লেখার সময় আমি বলেছিলাম, লিখিত এ অভিযোগের ব্যাপারে সলিমুল্লাহ খান জবাব না দিলে এটি ইতিহাসে তার নিন্দুকরা ব্যবহার করবে। যারা তার বয়ানের সামনে দাঁড়াতে পারবেনা এড-হোমিনেম হিসেবে তারা এটাকেই আনবে। তাই আনছে। এ কারণে আমি মনে করি এ বইয়ে আনীত অভিযোগের ব্যাপারে উস্তাদ সলিমুল্লাহ খানের জবাব দেওয়া উচিত।
এ ছাড়া এ বইয়ে সলিমুল্লাহ খানের পিএইচডি করার সময়ের সংগ্রাম, মার্কিন ও ব্রিটিশ প্রফেসরদের সঙ্গে বাগড়া, অর্থ রক্ষায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ, ভাই-বোন-পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে অদ্বিতীয়সত্তা, সন্তান অর্থের সঙ্গে সম্পর্ক, সলিমুল্লাহর জ্ঞানের প্রতি অগাধ নিবেদিত থাকার কথাও আছে। কিন্তু ঘৃণাজীবীরা কেবল নেতিবাচক বিষয়টিকেই সামনে আনে। গোটা পৃথিবীর আজকের যে শিক্ষাব্যবস্থা এতে মুসলমানদের জ্ঞানতাত্ত্বিক অবদান আছে—এই কথা বলে সলিমুল্লাহ খান অন্যায় করেননি। ইউরোপীয় চেরাগায়ন অনেকটাই মুসলমানদের বিজ্ঞান ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত—এটা একাডেমিক্যালি প্রমাণযোগ্য সত্য। অনেকে প্রমাণ করেছেনও। এই যে পশ্চিমা টেকজায়ান্ট কোম্পানিগুলো—যা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাকে সেরা করেছে—এগুলো যে এলগোরিদম এর মাধ্যমে হয় তা এক মুসলমানেরই চিন্তার ফসল।
৬।
খান সাহেবের ব্যাপারে ৫ নম্বর এবং সবচেয়ে বড় অভিযোগ: 'সলিমুল্লাহ খানের নয়াতত্ত্ব নাই! তার নতুন বা মৌলিক চিন্তা কই?' এর উত্তর হচ্ছে, তত্ত্ব কী এটা তো তাকে নিয়ে যারা কাজ করে তারা জানবেন। আপনি তার বক্তব্য শুনে তো সব বুঝতে পারবেন না। অবশ্য বক্তব্য শুনলেও তার চিন্তার স্পষ্ট মৌলিক অবস্থান পাবেন।
এ কারণে, উনি যে তালাল আসাদের 'On Suicide Bombing' কে তর্জমা করে 'আদমবোমা' শব্দটি বাংলায় তৈয়ার করলেন এইটাও যে সলিমুল্লাহর মৌলিক ভাবনা এটা উনারা বুঝতে পারলেন না। কারণ, আদমবোমা তো ধরে দেখেননি কোনোদিন।
আবার, ইরাকের সাদ্দাম ও বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে যে উনি ইতিহাসে একই পরিণতি ভোগ করা ট্রাজিক হিরো হিসেবে ভাবছেন (যারা উভয়ই প্রোপাগাণ্ডা বা অপপ্রচার ও ডিজইনফরমেশনের শিকার)—এই যে কমপ্যারিজন এটাও যে তার মৌলিক ভাবনা এটাও বই না পড়ার কারণে অনেকে ধরতে পারছেন না৷ ২০০৯ সালে বের হওয়া 'সত্য সাদ্দাম হোসেন ও স্রাজেরদৌলা' সলিমুল্লাহ খানের শ্রেষ্ঠ কাজের একটি।
সিরাজকে কারা খলনায়ক বানায় এটা নিয়ে আমার একটি লেকচার আছে। আমার অভিমত, সিরাজকে বহিরাগত প্রমাণ করার পিছনে 'মুসলমানরা ভারতে বা বাংলাদেশে বহিরাগত' এই ভয়াবহ মিথ্যার বিষবাষ্প ছড়ানোর অভিলাষ কাজ করে। সলিমুল্লাহ সরাসরি এই কথা বলেননি, তবে ইংরেজদের বেতনভোগী দালালেরা যে সিরাজের চরিত্রহানী করেছিল এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররাও সেই ঘৃণা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে গিয়েছেন সেটি অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এর পুস্তকসহ বহু গবেষণা করে দেখিয়েছেন সলিমুল্লাহ খান৷ এটা আমরা যারা গবেষণা করি তারা বুঝতে পারতেছি যে কত বড় কাজ৷ কিন্তু কুশলকুশীলবদের এটা খারাপ লাগছে। কেনো লাগছে সেটি খুবই গভীর কারণ। আমরা অনেকেই বুঝি, কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনা।
আবার ধরেন, বাংলার রেনেসাঁস নিয়ে যারা বাগাড়ম্বর করে তাদের সেই রেনেসাঁ যে কলকাতায় মুসলমান নিধনের পরে আর থাকেনা এই কথাও তিনি 'উৎসর্গ' তে বলেছেন৷ বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ঘেঁটে অনেক প্রয়োজনীয় আলাপ সামনে আনেন। বই না পড়লে জানবেন কীভাবে?
সলিমুল্লাহ খানকে না পড়লে জানবেন কীভাবে যে উনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অপর দেশ আগ্রাসনের ব্যাপারে নিন্দা জানিয়ে গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার ছদ্মবেশকে 'স্বাধীনতা ব্যবসায়' নাম দিয়েছেন?
উনাকে না পড়লে আপনি জানবেন কীভাবে যে, যে কোনো জাতির স্বাধীনতা কীভাবে বেহাত হয়? হলে কার কাছ থেকে কার কাছে যায়? এটাই মৌলিক ভাবনা যা আপনারা স্বাধীনতার এই ৫৪ বছরেও কেউ তুলতে পারেননি।
একটি বক্তব্যে দেখলাম সলিমুল্লাহ খান বলছেন '...নোয়াম চমস্কি ভাষার ভ ও বোঝেননি...'—এই যে চমক্সিকে খারিজ করার হিম্মত, এটাই তার মৌলিক ভাবনা। আর কার আছে এই হিম্মত ভারতীয় উপমহাদেশে বলেন? এইটাই সলিমুল্লাহ খান৷ এই সলিমুল্লাহ খান নিজেই একটি মৌলিক প্রশ্ন। আর কী চান?
আবার, প্লেটোর রিপাবলিক পড়লে দেখবেন সক্রেটিসের বক্তব্যে পূর্ণ। এরিস্টটলের বইয়ে প্লেটো বা অন্যান্যদের রেফারেন্স। তো প্লেটো সক্রেটিসকে প্রচার করেও মৌলিক চিন্তার অধিকারী বলেই দর্শনের ইশকুলে পরিচিত। সলিমুল্লাহ খানও রাজ্জাক বা ছফা বা তালাল বা লাকা বা অক্ষয়কুমারকে চিনিয়ে মৌলিক চিন্তা করতে পারেন। কাউকে খণ্ডন করা বা কারো সাহিত্যকর্ম থেকে কিছু বের করে সমালোচনা করাও গভীর বিবেচনায় মৌলিক চিন্তাই, হে 'মৌলবাদী যৌগিক' অথর্ব নিন্দুকপাল!
লাকা আর দেরিদাকে উনি রেফারেন্স দেন কিন্তু তাদের ক্রিটিকও আছে উনার লেখায়। 'সত্য সাদ্দাম হোসেন আর স্রাজেরদৌলা' তে উনি সিরাজের বিরুদ্ধে যে ইংরেজদের দালালদের অপপ্রচার, সেটির কাউন্টার ন্যারেটিভ হাজির করার পাশাপাশি ওয়ার অন টেরর নামের 'সন্ত্রাসবাদ প্রকল্প' বিষয়ে দেরিদার কঠোর সমালোচনা করেন। এই শক্তিশালী চিন্তক সলিমুল্লাহকে আপনি জানেন না হে মৌলিকচিন্তানুসন্ধানী রবীন্দ্রমৌলবাদী। এর দায় সলিমুল্লাহ খানের নয়, আপনার পাঠ ও চিন্তার অক্ষমতার।
৭।
সলিমুল্লাহ খানের সীমাবদ্ধতাটা কি জানেন? উনি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। উনি ইউল্যাব, মানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমি বলছিনা ঐখানে মেধাবীরা নাই। আছে। কিন্তু একজন চিন্তককে আবালবৃদ্ধবনিতার নিকট পৌঁছে দিতে সরাসরি যে উদ্যমী ছাত্র-ছাত্রী, অনুসারী লাগে তা ঐখানে নাই৷ কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুনাফানির্ভর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত বয়ানের বিরুদ্ধে তোলা বা প্রশ্ন করা এবং সেই প্রশ্ন প্রচার করাকে উৎসাহিত করেনা। আবার যে শ্রেণির লোক সলিমুল্লাহ খানের ছাত্রছাত্রী সেই শ্রেণির মধ্যে ইতিহাস ও শ্রেণিচেতনার চেয়ে পুঁজি ও ক্যারিয়ার অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ কারণে সলিমুল্লাহ খান তার তত্ত্ব ও বক্তব্য ধারণ ও বহন করার উপযুক্ত পাত্রপাত্রী পেয়েছেন সেখানে সেটি আমার মনে হয়না।
সেই সক্রেটিস থেকে প্লেটো থেকে এরিস্টটল থেকে আলেকজান্ডার—এভাবেই জ্ঞানের প্রবাহ সামনে যায়। প্রাচ্যেও দেখেন—আল জুয়াইনি থেকে গাজ্জালি, থানভী থেকে শামছুল হক্ব। আধুনিক পশ্চিমে দেখেন—মার্ক্স থেকে লেনিন থেকে হার্ভি, লাঁকা থেকে জিজেক। সলিমুল্লাহ খানের জ্ঞানের সিলসিলা দেখেন—রাজ্জাক থেকে ছফা থেকে সলিমুল্লাহ। অর্থাৎ জ্ঞানের একটি প্রবাহ থাকে, জ্ঞান মশাল। একজনের হাত থেকে আরেকজন দক্ষ বাহককে সেই মশাল ধরে অন্যদের আলোকিত করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত অনুসিদ্ধান্ত—সলিমুল্লাহ খানের আলোর মশাল হাতে নেওয়া কেউ উনার আশেপাশে নাই। এটার কারণ হতে পারে—
(ক) উনি শিষ্য তৈরি করছেননা বা করতে পারেননি বিদেশে থাকার বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার কারণে,
অথবা (খ) আমার মতে, জ্ঞানের প্রতি অনুরাগী, নিবেদিত, উনাকে চিনতে পারার মত, উনার ভাবনাকে ডিকোড বা উন্মোচন করতে সক্ষম জ্ঞানপিপাসুদের সঙ্গে উনার সম্পর্ক তৈরি না হওয়া।
আমার বিশ্বাস, সলিমুল্লাহ আমাদের মত ৫-১০টি ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশে উনার কর্মচিন্তাকে ভাগ করে নিলে উনার বিরুদ্ধে এতো অপপ্রচার হওয়ার সুযোগ পেতো না। এ জন্য উনাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক করা অবশ্য দরকার ছিল। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই বলে উনার সঙ্গে তারুণ্যের দূরত্ব তৈরি কেন হবে? আমার মনে হয়, এই জায়গাটি নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের ভাবা দরকার। উনার জ্ঞানের মশাল কাউকে কি দিয়ে যেতে হবে না? কাকে দেবেন? উনার চারপাশে যারা আছেন তারা উনার বই বাজারজাতকরণের উপযোগী হতে পারেন, জ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে উনার চিন্তাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে পারবেন না—এ আমরা নিশ্চিত।
শেষকথা
আলোচনার একেবারেই শেষ সময়ে, শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। সম্প্রীতি সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্যের শব্দ 'অর্গাজম কম্পন' নিয়ে এক নারী স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেই স্ট্যাটাসের মত নিম্মমানের স্ট্যাটাসও লোকে শেয়ার করছে শ্রেণিঘৃণা থেকে। অথচ এই নারীর বিরুদ্ধে তার বাসার গৃহকর্মী নারী শারিরীক নিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন। সেই নিপীড়িত নারীর কান্নার ভিডিও অনলাইনে পাওয়া যাবে। এরকম একজন ব্যক্তি সলিমুল্লাহ খানের নামে কিছু লিখলে তার ক্রেডিবিলিটি থাকে?
জনৈক তানভীরের অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা ভাইরাল হয়েছে সলিমুল্লাহবিদ্বেষীদের নিকট। কিন্তু এর কিছুই সলিমুল্লাহ খানের বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুত্ব কমাতে পারছেনা। কারণ, আমরা—আমিসহ অনেকেই সলিমুল্লাহ খানের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক এই লড়াইটায় অংশ নিয়েছি।
বরং এখন এমন একটি বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে যে, সলিমুল্লাহ খানকেই আগামীর প্রজন্ম প্রধান বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণনা করবেন। তার সীমাবদ্ধতার পরেও আমি সেটি নিশ্চিত করতেই সলিমুল্লাহ খানের কাজ নিয়ে গবেষণা করছি। করবো না কেনো?
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে আগামী ও মধুপোক থেকে প্রকাশিত ' উৎসর্গ: পরিবার প্রজাতি রাষ্ট্র' গ্রন্থের 'স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা' নিবন্ধে উস্তাদ সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন:
নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তনের পথে প্রযুক্ত দ্বিতীয় উপায় আর কিছু নয়—যুগান্তরের সংগ্রামে আর মুক্তিযুদ্ধের ঔরসে পাওয়া নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা খর্ব করা। যুক্তিস্বরূপ বলা হইতেছে, ব্যক্তি তাহার নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা যত পরিত্যাগ করিবে ততই সে নিরাপদ হইবে। এক কথায়, নিরাপত্তার বাজারে স্বাধীনতার মুদ্রা দিয়া সওদা কিনিতে হইবে।
(সলিমুল্লাহ ২০২৩:১২৬)
যারা সলিমুল্লাহ খানের মৌলিক চিন্তা খুঁজে পাননা তারা এটুকু পড়েন। নিরাপত্তাকে রূপক হিসেবে বাজার ভাবা, স্বাধীনতাকে মুদ্রা ভাবার এই অভিনব চিন্তা আর কোন বুদ্ধিজীবী কবে করেছে? সলিমুল্লাহ খানের এই চিন্তাটা অনন্যসাধারণ।
আসলে, অন্ধবিদ্বেষ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়া থেকে আমাদের দূরে রাখে। সলিমুল্লাহ খানকে ছোটো করার আগে বড়, ছোটো, মাঝারি সমস্ত বনসই ও আগাছার আগে নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত—তারা সলিমুল্লাহ খানকে পাঠ করে তাঁর চিন্তা ও দর্শন বুঝতে পারছেন কী না অথবা তাদের সেই সক্ষমতা বা সলিমুল্লাহ খানের ব্যাপকতা ধারণ করার সাধ্য আদৌ আছে কী না।
জানতে হবে কল্যাণার্থে, ঘৃণার চাষাবাদের উদ্দেশ্যে নয়—এই বিশ্বাস রেখে প্রশ্ন করুন। আমি বিশ্বাস করি—বিশ্বাসই শক্তি আর প্রশ্নই উত্তর। এটাই আমার চিন্তা এবং আমি সলিমুল্লাহ খান নই, তবে সলিমুল্লাহ খানকে বিশ্বাস ও প্রশ্ন করি...।
0 Comments