যদ্যপি আমার গুরু-পতি : পতিপ্রেমের প্রতিপ্রেম ও অপ্রকাশিত সলিমুল্লাহ খাঁ
~~~
সলিমুল্লাহ খাঁ (১৯৫৮-) কে নিয়ে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শেখ তাসলিমা মুনের লেখা বই 'যদ্যপি আমার গুরু-পতি'। নামটি প্রথম দেখি সলিমুল্লাহ খাঁ এর ২০০৭ সালে প্রকাশিত 'সত্য সাদ্দাম হোসেন ও স্রাজেরদৌলা' গ্রন্থটির উৎসর্গে। সেখানে অবশ্য সলিমুল্লাহ লিখেছিলেন 'মুন শেখ তসলিমা'।
যশোরের মেয়ে শেখ তাসলিমা মুন। ভদ্রমহিলা আইনে পড়া, সলিমুল্লাহ'র এক সময়ের ছাত্রী, পরবর্তী সময়ের স্ত্রী ও প্রবাসে 'গরীবী সলিমুল্লাহ খাঁ' এর কষ্টের দিনগুলোর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীনী এবং একজন স্বঘোষিত নারীবাদী। অথচ খুবই সচেতনভাবে সাবেক 'ছার'কে 'গুরুপতি'ও বলছেন।
বইয়ের নাম ছফা'র 'যদ্যপি আমার গুরু' থেকে কর্যকৃত হলেও 'পতি' সংযোজন নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ৯৫ পৃষ্ঠার বইয়ের দাম ২০০ টাকা হলেও রকমারি থেকে আমি ১৫০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। বইটি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে এতে সলিমুল্লাহ খাঁ এর জীবনের অনেক অজানা অধ্যায় উঠে এসেছে এবং আজ ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত খাঁ সাহেব এ বইয়ে উত্থাপিত অভিযোগ, অনুযোগ বা ঘটনার ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ জানাননি। ফলে পুস্তক, একাডেমিয়া, টকশো, সেমিনার, ক্লাসের বাইরের সলিমুল্লাহ খাঁ কে জানতে এ বইটি আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
বইয়ের সার-কথা
এ বইটি মোট ১৪ টি পর্বে বিভক্ত। সম্পূর্ণ বইটি যশোরের মেয়ে শেখ তাসলিমা মুনের বয়ানে সলিমুল্লাহ খাঁ এর সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ-আলাপ-প্রণয় ও বিচ্ছেদকে নিয়ে। প্রধান চরিত্র মুনের আগের ঘরের সন্তান হৃদম, স্বয়ং মুন, সলিমুল্লাহ খাঁ + মুনের সন্তান অর্থ এবং উস্তাদ খাঁ সাহেব নিজে। ঘটনার প্রয়োজনে আরো কিছু চরিত্র এসেছে যেমন--জনৈক ড. শাহ আলম, ফরহাদ মজহারের সাবেক স্ত্রী সাকি সেলিমা প্রমুখ।
এ গ্রন্থে, ছাত্রী অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ক্লাসের গুরু সলিমুল্লাহ পরিচয়ের ১৮ বছর পর কীভাবে পতি সলিমুল্লাহ হলেন সেই বিষয়টি উঠে এসেছে। তাদের প্রেম, প্রণয়, অর্থর জন্ম, নিউইয়র্ক থেকে স্টকহোম যাত্রা, সেখান থেকে লন্ডনে আসা, লন্ডনে এসে সলিমুল্লাহ কর্তৃক হৃদমের গায়ে হাত তোলার ঘটনা ও এর রেষে বিয়ে বিচ্ছেদ এসবই বইয়ে এসেছে।
১৯৯৯ এর জুলাইয়ে হওয়া বিয়ে ২০০৩ এর ৩০ ডিসেম্বর বিচ্ছেদে পরিণত হলেও ২০১৩-১৪ তে কীভাবে ফের দুজন এক হতে গিয়েও হলেন না, কীভাবে সলিমুল্লাহ ফের তার আদরের মুনকার (সলিমুল্লাহ এ নামে ডাকতেন মুনকে) মন ভাঙলেন সেসব নিয়ে সর্বশেষ আলাপ রয়েছে।
গ্রন্থের গভীরে
বইটিকে মুন বলছেন তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষার ফসল (ভূমিকা, পৃষ্ঠা ৮)। একই সঙ্গে এটিকে তিনি ফিকশন না বলে বলছেন 'ডকুমেন্ট' (পৃষ্ঠা৮)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসই সলিমুল্লাহ খাঁ এর সঙ্গে দেখা ও দেখার ১৮ বছর পর বিয়ে(পৃ-৯) হওয়ার নাটকীয় বর্ণনা আছে। লেখিকা চেষ্টা করেছেন সুবিচার করে লিখতে (পৃ-১০)। ১০ নং পৃষ্ঠায়ই সুবিচারের কথা বলে যদিও বিচারকের ভূমিকায় সলিমুল্লাহ খাঁকে নিয়ে মুন লেখেন:
কিন্তু একাডেমিক জীবনে যতটা মেধাবী ব্যক্তিগত জীবনে প্রেম এবং বৈবাহিক জীবনে তিনি ততটাই বিফল।
মুনের জনৈক বন্ধুর মাধ্যমে খাঁ সাহেব এর নাম্বার পান ও টেলিফোনে পরিচয়। পরিচয়ের পর টেলিফোনেই কথোপকথন ও টেলিফোনেই লালনের গান শোনানো এবং সলিমুল্লাহ কর্তৃক সরাসরি মুনের ভাষায় 'দুম করে' বিয়ের প্রস্তাব (পৃষ্ঠা ১৬) আসে।
সলিমুল্লাহ টেপরেকর্ডারে গান শোনান। 'পাবে সামান্যে কি তার দেখা' এবং এ গান শোনাতে মুনকে আকুতি করে বলেন, 'একটিবার। কেবল একটিবার'!
এরপর দ্রুত সম্পর্ক বিয়েতে যায়। বিয়ে হয় নিউইয়র্কে। গীর্জায়, কেবল যিশুর নাম ছাড়া ইংরেজিতে 'আই ডু' বলে কবুল বলেন মুন-সলিম। সেখানে তাদের বেশ মধুর সময় কাটে।
এ সময়ের ঘটনা বর্ণনায় মুন আমাদের জানান, সলিমুল্লাহ ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দামী বৃত্তিতে মার্কিন মুল্লুকে পড়তে যান এবং সেখানে গিয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রস্তাবনা বা থিসিস বা একাডেমিক কাজ করতে চাইছিলেন যা তার অধ্যাপকরা পছন্দ করছিলেন না। এ কারণে তিনি পিএইচডি শেষও করতে পারছিলেন না। তার স্কলারশিপ শেষ হয়ে যায়, সময় মতো দেশে না আসায় দেশের চাকরিটাও চলে যায় এবং তিনি আমেরিকায় খণ্ডকালীন শিক্ষকতা বা শিক্ষকতায় সহযোগিতা করে খুবই অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন।
এ বিষয়গুলো সলিমুল্লাহ তার টকশোতে আমাদের জানান না। তিনি কেবল জানান, তিনি ছিলেন আইনের শিক্ষক কিন্তু মার্কিন দেশে গিয়ে পড়েছেন অর্থনীতি ইত্যাদি।
যাহোক, এ সময়ে সলিমুল্লাহ মার্কিন মুল্লুকে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। মুন লেখেন, নিউইয়র্ক থেকে স্টকহোমে যাওয়ার আগে প্রায় ১১০ টির মত বাক্সে প্রায় ৪ হাজার বই প্যাক করতে হয়।
যাহোক, অনেক কষ্ট করে সম্ভবত ব্রিটিশ ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর সলিমুল্লাহ তার পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এই ১৫ বছর মানুষটির মেধাকে আমরা পাইনি ভেবে খারাপ লাগে৷ এ ১৫ বছর তিনি দুহাত খুলে লিখতে পারেননি পিএইচডি না শেষ হওয়ায়, পারিবারিক দায়িত্ব পালনে কাজ করতে থাকায়, জীবনের উপযুক্ত সঙ্গীহীনতায়, জীবীকার চিন্তায়! মনটা খারাপ হয়! এমন 'সলিমুল্লাহ সিন্ড্রোম' আমাদের মধ্যে অনেকেই নীরবে বহন করছেন, নয় কি?
মুনের ভাষ্যে, তিনি চেয়েছেন সলিমুল্লাহ লিখুন। পুরো বইয়ে মুনের উদারতার নানা প্রকাশকে একপাক্ষিক মনে হতে পারে। সলিমুল্লাহ খাঁ এর পিছনে অনেক খরচ করেছেন মুন এ জাতীয় আলাপ আছে। বিষয়টিতে মুনের খোটা দেওয়া 'ছোট আমিত্ব' কিছুটা প্রকাশ পেলেও যেহেতু সলিমুল্লাহ খাঁ এর প্রতিবাদ জানান নি তাই মুনের বয়ানকে সত্য ধরে নেওয়া যায়।
যাহোক, মুন-সলিমের দারুন প্রেম ও সংসার শুরু হয়। এ রকম চমৎকার একটি সংসার ভাঙন ধরে মুনের আগের ঘরের সন্তান হৃদমকে সলিমুল্লাহ কর্তৃক প্রহার করার কারণে। এ অংশটি পড়তে এবং পড়ে আপনাদের জানাতে আমার নিজেরও অস্বস্তি লেগেছে। সলিমুল্লাহ খাঁ এতো বড় মানুষ কিন্তু তার মধ্যে এতো সংকীর্ণতা!
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, মনে হয় বিচ্ছেদের কারণে মুনের একপাক্ষিক অভিযোগ! আবার এটাও বিশ্বাস করি, এ অভিযোগ অসত্য হলে সলিমুল্লাহ তার প্রতিবাদ জানাতেন, কারণ বই যে ঐতিহাসিক দলিল সেটি খাঁ সাহেব ভালো করে জানেন। সে জন্য সলিমুল্লাহ 'তার স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তানকে ঠাস করে চড় মারেন'; 'আগের ঘরের সন্তানকে বোঝা মনে করেন'; 'সৎ সন্তানকে নিজের সন্তানের থেকে দূরে রাখতে চান'; ' সৎ সন্তান তাকে ছোবল মারবে বড় হয়ে এ কথা মা বলেছেন' এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও এর কোনো জবাব তিনি দেননি৷
বইয়ে স্পষ্ট করে মুন লিখেছেন যে,তার গুরুকে তিনি 'সিঙ্গেল মাদার' এটা জানিয়েই 'পতি' করেন এবং এ 'গুরু-পতি' নিজের সন্তান হওয়ার সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সৎ সন্তান তথা মুনের আগের ঘরের সন্তান হৃদমকে নিজ সন্তান হিসেবে বড় করবেন--সে কথা দৃঢ়চিত্তে বলেন।
এখানে, নিজেকে নারীবাদী পরিচয় দেওয়া মুনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। তিনি পতিপ্রেমে হাবুডুবু খেয়ে নিজের সন্তান হৃদমের মানসিক নিপীড়িত হওয়াকে দীর্ঘদিন সহ্য করেন। বইটি পড়লেই আপনারা বুঝবেন কীভাবে সলিমুল্লাহ খাঁ এর রূঢ় ব্যবহারকে প্রশ্রয় দিয়েছেন শেখ তাসলিমা মুন। ফলে বইয়ের কিছু ঘটনা সলিমুল্লাহ এর নেতিবাচক রূপ তুলে ধরলেও বিশাল অংশ নিয়ে সলিমুল্লাহ খাঁ এর স্তুতিই পাবেন। সেটি অন্যায় নয়। কিন্তু একদিকে নিজেকে নারীবাদী বলবেন, আরেকদিকে পুরুষতান্ত্রিক পতির সাত খুনকে শিল্পসম্পদ হিসেবে তুলে ধরবেন--এমনটি হওয়া উচিত নয়।
যাহোক, সন্তানকে প্রহার করার কারণেই তাদের তালাক বা বিচ্ছেদ হয়। গ্রন্থের ৬৮ পৃষ্ঠায় মুন যে বর্ণনা দিয়েছেন তা পড়লে ভীষণ খারাপ লাগা আসতে বাধ্য হবে। মুনের বর্ণনায় শিশু প্রহারকারী সলিমুল্লাহ খানকে দেখুন:
'স্পুকি লাগে, স্পুকি লাগে? আবার বল! আবার বলে দেখো!' বলেই যে হৃদমের গালে এক চড় লাগালো। তারপর একে একে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, এবং ষষ্ঠ।
আমার শরীরের সমস্ত শক্তি কে যেন শুষে নিয়েছে। আমার বাকশক্তি কেউ কেড়ে নিয়ে গেছে। অর্থ চিৎকার করে হৃদমের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওর বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাইয়াকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এখনও চোখের সামনে ভাসছে, হৃদম দুহাত জোড় করে বলছে, স্যরি, আর বলব না, আর বলব না, আর না।
ভিখারির মতো হাত জোড় করে হৃদম বারবার বলছে,'আর বলব না। আর করব না। আমাকে আর মেরো না, আর মেরো না।'
ঐ মুহুর্তে কী ভয়ানক এক শিশু প্রহারকারী আমাদের জনবুদ্ধিজীবী তা ভাবলে আমার খারাপ লাগে! এর ৮ দিন পর আবার চড় মারেন হৃদমকে। ৬৯ পৃষ্ঠায় এ বর্ণনা আছে। আগেরবার মুনের পতিপ্রেম উৎসরিত নীরবতার কারণে শিশু অর্থ এগিয়ে এলেও এবার মুন নিজেই এগিয়ে আসেন হৃদমকে রক্ষায়। মুনের লেখায় যাই:
ও (হৃদম) নিজের মনে খেলছে আর কোনো একটা বাচ্চাদের গান গাইছে। হঠাৎ দেখলাম ও (সলিমুল্লাহ খান) হনহন করে আসছে। হনহন করে করিডর পার হয়ে বসার ঘর পার হয়ে কিচেনের দিকে যাচ্ছে। ভাবলাম পানি খেতে যাচ্ছে। হৃদম তখনও গান গেয়ে যাচ্ছে নিজের মনে। হঠাৎ দুটি শব্দ 'ঠাস' 'ঠাস'।...আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। বাঘিনীর মত ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম।
তৃতীয় চড় পড়ার আগেই আমি তার (সলিমুল্লাহ'র) হাত ধরে ফেললাম৷ আমি আমার শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে বললাম, খবরদার! আমার ছেলের গায়ে আর একবার হাত তুললে আমি তোমার হাত ভেঙে দেব।
এই প্রতিবাদের পরেই (৭০ পৃষ্ঠা) সলিমুল্লাহকে ঘর থেকে বের করে দেন মুন। মুনের ভাষায়:
''গেট আউট। গেট আউট অব দিজ হাউস এখুনি, এ মুহূর্তে। "
এই পৃষ্ঠায় 'স্বামী কী এত দামি?" প্রশ্ন করে হিমালয় মাথায় নিয়ে দৌড়ানোর কথা বলে সলিমুল্লাহকে 'অমানুষ' বলে ঘর ছেড়ে যেতে বলেন তিনি। শেখ তাসলিমা মুনের বয়ানে :
...আমি তোমাকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিলাম । এর মধ্যে তুমি এখান থেকে চলে যাবে। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে, কার সাথে যাবে আমি কিছু জানিনা। আর নয় তোমার সাথে। আমি ২৪ ঘণ্টা পর ঘরে ফিরে যেন তোমাকে আর না দেখি।
এভাবেই শেষ হয় সলিমুল্লাহ খাঁ এর সংসার। যদিও আনুষ্ঠানিক তালাক আরো পরে হয় তথাপি ৭১ পাতায় মুন জানান, কেবল লন্ডনে নয় তার অগোচরে সলিমুল্লাহ খান স্টকহোমেও হৃদমকে প্রহার করেন।
৭৭-৭৮ পৃষ্ঠায় সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে অন্য আরেকটি মেয়ের বন্ধুত্ত্বের কথা লেখেন মুন। এই মেয়ের ভাই সলিমুল্লাহ এর সঙ্গে বোনের কথাবার্তাকে ভালোভাবে না নিয়ে সলিমুল্লাহকে 'ভয়-ভীতি'ও দেখায় বলে মুন লিখেছেন৷ মেয়েটি ও মুন--সলিমুল্লাহ দুজনের কাছে ভিন্নভাবে আসলেন দুজনের কথাবার্তায় (পৃষ্ঠা-৭৮)।
তালাকের পর ২০০৫ সালে মুন জানতে পারেন সলিমুল্লাহ ও তার ভালোবাসার ফসল ছেলেটি যার নাম অর্থ সে অটিজমে আক্রান্ত। এরপর তার অন্যরকম সংগ্রাম দুই সন্তান নিয়ে। সলিমুল্লাহ দেশে মনোযোগ দেন। ৮৩-৮৪ পৃষ্ঠায় মুনের শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চে সম্পৃক্ততার পাশাপাশি সলিমুল্লাহ এর সঙ্গে ১০ বছর পর দেখার অনুভূতি বর্ণিত হয়েছে।
তারপর ফের যোগাযোগ, ফোনে কথা, ইউল্যাবে গিয়ে দরজা আটকে দেওয়া, পরিবারের সঙ্গে পুনঃপরিচয় করিয়ে দেওয়া, মুনের ফ্লাটে গিয়ে গল্প করা, রুটি খাওয়ানো, ড. শাহ আলম নামের একজনের মধ্যস্ততায় ফের এক হইয়াও হইলোনা ইত্যাদি পাবেন ৮০ পৃষ্ঠার পর থেকে শেষ পর্যন্ত।
সলিমুল্লাহ ইমেইল করে খুবই নিষ্ঠুরভাবে জানিয়ে দেন তিনি আর এক হতে চান না, আর মুন ইমেইল করে লেখেন:
আপনি কোনো দায় অনুভব করবেন না স্যার, দায় আমার।...বিশ্বাস না করে আমাদের উপায় নেই! আমি বিশ্বাস হারাই না জীবনে--কোনদিন হারাবো না। আপনিতো আমার স্বামী ছিলেন না, ছিলেন গুরুও! আমার গুরু-পতি।'
এর বাইরে ছোটখাটো তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এ বইয়ে এসেছে। তার একটি ফরহাদ মজহারের সাবেক স্ত্রী সাকী সেলিমার সঙ্গে সলিমুল্লাহ খাঁ এর সুসম্পর্ক। মুন লেখেন :
নিউইয়র্কে আর একটি মানুষ তাকে (সলিমুল্লাহ) বোঝেন। তিনি হলেন সাকী সেলিমা। ওর স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস তার মুখস্ত। বেছে বেছে সে জিনিসগুলো তিনি রেঁধে কনটেইনার ভরে দিয়ে যান।...এক-দুদিন নয়, ১৫ বছর ধরে উনি সেটি করেছেন। তাকে না জানিয়ে আমাকে বিয়ে করায় তিনিও চরম আঘাত পেয়েছেন। এর সবই আমি পরে কিছু কিছু শুনেছি এবং বুঝে নিয়েছি তার অনেক বেশি।(পৃষ্ঠা-৩০)।
এখানে মুন 'তার অনেক বেশি' ঠিক কী বুঝে নিয়েছেন সে বিষয়ে পাঠক রহস্যাবৃত থাকবেন হয়তো। আমি কিছুই বুঝিনি।
সলিমুল্লাহ খান তার টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে আপ্লুত থাকেন, অর্থকে এসএমএস ইত্যাদি দিয়ে অনুষ্ঠানের সময়সূচি জানান এসবের উল্লেখ আছে।
টকশোতে সলিমুল্লাহ এর বদলে যাওয়া দেখে মুন লেখেন 'চৈনিক মতবাদ থেকে ও (খাঁ সাহেব) অনেক সরে এসেছে বুঝি' (পৃষ্ঠা-৮৮)।
অর্থাৎ আজকের সলিমুল্লাহ মাদরাসা শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে বয়ান দেওয়ায় যারা তাকে মুন্সিদের কাতারে নেন তাদের জানা দরকার তাঁর চীনপন্থী বাম অবস্থার কথা, অথবা মার্কিন মুল্লুকে তিনি কীভাবে লাকাকে নিয়ে ভেবেছেন, ভেবেছেন মৃতপ্রায় সমাজতন্ত্র নিয়ে।
পুঁজিবাদের বিরোধী হয়েও পুঁজিবাদের ভিত্তিভূমিতে বাস করে, সেখানে থাকার বাসনা করে রিযিকের ব্যবস্থা করতে ছুটে চলার হীনম্মন্যতা ও বেদনাবোধ তাকে আহত করতো।
১০ বছর পর দেখা সলিমুল্লাহকে নিয়ে শেখ তাসলিমা মুন লেখেন:
"সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ফরহাদ মজহারের বিপরীতে দাঁড়ানোর শক্তি তাঁর (সলিমুল্লাহ খানের) হয়েছে। এটি তাঁর জন্য সহজ ছিলোনা মাত্র ১০ বছর আগেও।"
এ লাইন থেকে বোঝা যায় সলিমুল্লাহ খাঁ ফরহাদ মজহারের মতই ভাবতেন এক সময় অথবা ফরহাদ মজহারের বিপরীতে ভাবার কথা ভাবতেন কিন্তু সেই বুদ্ধিবৃত্তিক বা পরিচয়শক্তি তার ছিলোনা, যেটি এখন হয়েছে। এটি একটি বিরাট স্বীকারোক্তি সলিমুল্লাহ খাঁ ও ফরহাদ মজহারের সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য।
বইটি বেশ সুখপাঠ্য লেগেছে সলিমুল্লাহ খাঁ এর কথা থাকায় যদিও মুনের লেখার শব্দশক্তি ততোটা সমৃদ্ধ মনে হয়নি। তবে তিনি ঘটনার পুঙখানুপুঙখ বর্ণনা হাজির করতে সমর্থ হয়েছেন। বিদেশের নানা জায়গার, নানা মানুষের বর্ণনায়, বা ঘরের নানা স্থানের অবস্থান বর্ণনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন৷
পুরো বইয়ে লঘু জায়গা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন মুন। ৮৩ পৃষ্ঠায় মুন সলিমুল্লাহ খাঁ এর আচরণের সঙ্গে অটিস্টিক সন্তান অর্থের আচরণের মিলের উল্লেখ করেন (সাইকোলজিস্টদের সঙ্গে আলাপ করেও)। মুন লেখেন:
"আমি জানি অর্থের বাবাকে হেল্প করার কোন ক্ষমতা আমার হাতে নেই। কিন্তু কিছু কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। অনেক রাগ, অনেক ক্রোধ থেকে আমি মুক্তি পাই। ঈশ্বর তুমি তাকে ভালো রেখো।"।
মুন কী বুঝিয়েছেন সচেতন পাঠক-পাঠিকা তা বুঝে নিতে পারবেন। সলিমুল্লাহ খাঁ মানসিকভাবে অসুস্থ এটাই কি তিনি বোঝাতে চাননি? আমি মনে করি, এটি সলিমুল্লাহ খাঁ এর প্রতি মুনের জুলুম। এ বই একটি দলিল হবে এবং সলিমুল্লাহ খাঁ একদিন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারেন এটি কি মুন ভাবেন নি?
এর আগে মুন বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লেখেন:
তার জন্য দরকার অনেক বড় প্রফেশনাল কাউন্সেলিং। যিনি ফ্রয়েড বিশেষজ্ঞ, জাঁক লাকা বিশেষজ্ঞ। শত সহস্র সেমিনার, লেকচার তিনি এ বিষয়ে দেন। তাকে আমি বলব কাউন্সিলিং-এর কথা? কিভাবে? তাকে অপমান করা হবে না?
এখানে মুন স্পষ্টতা 'সাইকিয়াট্রিস্ট' বুঝিয়েছেন বোঝা যাচ্ছে! সলিমুল্লাহ খাঁ এ বিষয়ে কোনো জবাব আজ পর্যন্ত দেননি। মুন ও সলিমুল্লাহ দুজনেই আইনের শিক্ষার্থী। তারা জানেন, একটি লিখিত বিবৃতি বা গ্রন্থের শব্দের ওজন বা গুরুত্ব। এই কারণেই এই বইটির মূল্য অধিক।
পুরো বই শেষ করে আপনার মনে হবে একজন নিরেট মেধাবী ভদ্রলোকের কাহিনী পড়ছেন। আমি বলবো, ৯৫% লেখা সলিমুল্লাহ খাঁ এর ব্যাপারে ইতিবাচক। যে ৫% নেতিবাচক বিষয় এসেছে তা পরিমাণে কম হলেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি এ ৫% কীর্তি সলিমুল্লাহ খাঁ এর জ্ঞানী, বিজ্ঞজন হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়না।
একইভাবে বইয়ে নিজেকে নারীবাদী পরিচয় দেওয়া মুন পতিভক্তিতে পুরুষতান্ত্রিক নারীদের ছাড়িয়ে গেলেও নারীমুক্তিতে শেখ তাসলিমা মুনের ইতিবাচক কোনো কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হবেনা।
বাংলাদেশের কন্টেম্পোররি নানা জাতীয় সংকটে সলিমুল্লাহ খাঁ সত্যের ফুল ছড়াবেন, অসত্যকে তাড়িয়ে সত্যকে জয়ী করবেন এ আশায় আজকের মত বিদায় নিলাম। বই পড়ুন। বই আপনার মুক্তির নিরবচ্ছিন্ন বিশ্বস্ত সঙ্গী।
কৈফিয়ত: সলিমুল্লাহ 'খাঁ' লিখছি আমি। যদিও 'সলিমুল্লাহ খান' লেখেন তিনি ও অনেকে। আমি বিশ্বাস করি, 'খাঁ' বাংলাদেশের আদিম শব্দ, অন্তত ইংরেজদের খানের আগের। ভূমিশব্দটিকে বিকৃত করে 'খান' (Khan) বলতো ব্রিটিশ দখলদাররা। আদি নাম খাঁ, যেমন-ঈশা খাঁ, মুসলিম লীগের নবাব সলিমুল্লাহ খাঁ ইত্যাদি। সলিমুল্লাহ খাঁ এর নামটিও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা থেকে নেওয়া ধরা যায়।
একইভাবে আমাদের ঠাকুরকে বিকৃত করে 'টেগর' বলতো দখলদার ইংরেজরা। এখন সলিমুল্লাহ খাঁ উপনিবেশবিরোধীতা করে নিজের নামটিকে ইংরেজ নিয়মে লিখলেও আমি আদি খাঁ হিসেবে তাঁকে চাই। আমাদের মুক্তির বাতি জ্বালতে একজন খাঁকে প্রয়োজন, ইংরেজদের খান বাহাদুর নয়।
পরিশেষে যাই লেখা থাকুক, সশ্রদ্ধ সালাম উস্তাদ সলিমুল্লাহ খাঁ এর প্রতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তিনি আমাদের জ্ঞানের নয়া চেরাগ হিসেবে আবির্ভূত। এ চেরাগ আরো দীর্ঘদিন জ্বলুক। সবাই ভাল থাকবেন।
0 Comments