সর্বশেষ

News from ju

অতিথি পাখীরা আসতে শুরু করেছে জাবিতে:পাখীর গানে মুখরিত ক্যাম্পাস
জাবি প্রতিবেদক,প্রাইমখবর
জাহাঙ্গীরনগর:একটি ছোট অতিথিকে বড়সড় এক অতিথি পানিতে চুবিয়ে ধরেছে।ঠিক তখনই অন্য অতিথিরা বাচ্চাটার সাহায্য এগিয়ে এলো।কিচিরমিচির শব্দ করে দূর্বলের উপর করা এই অত্যাচারের প্রতিবাদ জানালো।সেই কিচিরমিচির মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র লেকের সব অতিথিদের মাঝে।প্রতিবাদের ভাষা কিচিরমিচির এক নতুন সৌন্দর্যের আভা ছড়িয়ে দিল পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে!

কী ভাবছেন?এই অতিথিরা কারা?না,এরা মানুষ না,এমনকি মানুষের কাছাকাছি গোত্রেরও কেউ না।এরা পাখী।সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরসবুজ ক্যাম্পাসের আতিথ্য গ্রহন করেছে।এরা অতিথি পাখি।শীতকালীন অতিথি পাখী।
শীতের এই অতিথিরা ছোট ছোট দলে আসা শুরু করেছে অপার সৌন্দর্যেয় লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।সকাল-সন্ধ্যা এই অতিথিরা নির্মল আনন্দে মুখরিত করে রাখছে ক্যাম্পাসের সকল শিক্ষার্থী,শিক্ষক,কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দর্শনার্থীদের।প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।অনেকেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে রয়েছেন একটা ছবি তুলবেন এই আশায়।কিন্তু পাখীগুলো কারো ইচ্ছে পূরণ করছেনা।ওদের ইচ্ছেমত পানিতে ডুব দিচ্ছে,একে অন্যের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে।খুব বেশি হলে ছোট একটা ডানা ঝাপটা দিয়ে সামান্য জায়গা পরিবর্তন করছে।পানিতে যত প্রকার খেলা তার কোনটাই বাদ রাখছেনা পাখীগুলো।পানি ছিটানো,ডুব দিয়ে পানিতে কিছুক্ষণ থাকা,৪-৫ টি পাখি একসাথে উড়ে লেকের অন্যপাশে চলে যাওয়া এসব করে তারা সময় পার করছে।

জাবি ক্যাম্পাসে গত দুইবছর অতিথি পাখীরা আসেনি।এর কারণ পাখীদের বিচরণভূমি লেক ও পুকুরগুলোকে মাছ চাষের জন্য বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে লিজ দিয়েছিল প্রশাসন।এর ফলে মাছ চাষীরা পুকুরের শ্যাঁওলা,কচুরিপানা ও শাপলা নিধনের জন্য অতিরিক্ত পরিমান রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে।নষ্ট হয়ে যায় পুকুরের জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থানের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো।অতিরিক্ত পরিমান চুন ব্যবহার করার কারণে পুকুরের পানির রংও পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং পাখীদের খাদ্য ক্ষুদ্র অণুজীব ও কীটপতঙ্গ মরে যায়।এর ভয়াবহ ও বিরূপ প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যায় পাখীদের বিচরণাপযোগী লেক ও পুকুরগুলোর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য।এই কারণে বিগত দুই বছর ক্যাম্পাসে একটিও অতিথী পাখী আসেনি।প্রশাসনের এই বানিজ্যিক সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচন্য
হয় ক্যাম্পাসে,সংবাদ মাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগকারী মাধ্যমগুলোতে।এর পরপরই এ বছর টনক নড়ে প্রশাসনের।

এই বছর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অতিথি পাখীদের ব্যাপারে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন করে।ক্যাম্পাসে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ১৭ টি লেক আছে।এর মধ্য থেকে মাত্র দুইটি লেককে বেছে নেওয়া হয়েছে অতিথি পাখীর অভয়াশ্রমরূপে।একটি প্রশাসনিক ভবনের সামনের লেক,অপরটি পরিবহন চত্তরের পাশের অর্থাত্‍ জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হলের পিছনের লেক।এই দুইটি লেকেই এই বছর প্রশাসনের উদ্যোগে লাল শাপলা লাগানো হয়েছে।এছাড়া অক্টোবরের শেষ থেকেই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অতিথি পাখীদের নিরাপদ বিচরণের জন্য করণীয় কাজ ব্যানারে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।নিষিদ্ধ করা হয়েছে উচ্চস্বরে হর্ন বাজানো,পটকা বা আতশবাজি ফোটানো এমনকি উচ্চস্বরে কথা বলা পর্যন্ত।প্রশাসনের এই নিরলস পরিশ্রমের সার্থকতা দেখা যায় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই। দূর দূরান্ত থেকে ছোট ছোট দলে উপদলে উড়ে আসতে থাকে পাখীরা।উত্তরের শীতপ্রধান অঞ্চলগুলো ছেড়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে এরা যেন হাঁফছেড়ে বাচেঁ।

ঝাঁক ঝাঁক পাখীর কলতানে আর কিচিরমিচির শব্দে ক্যাম্পাসে এক অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।সকাল বেলা ঘুম খেকে উঠেই পাখীর নানা সুরের গান,আবার বিকালে সূর্য ডোবার সাথে সাথে লেকগুলোর নতুনরূপ,সন্ধ্যা নামতেই পাখীদের কিচিরমিচিরের শব্দ বেড়ে যাওয়া-এসবই যেনো স্বর্গীয় সৌন্দর্য তৈরি করেছে জাবি ক্যাম্পাসে।দর্শনার্থীদের হৃদয়ে সত্যিকারের আনন্দ নাড়া দিয়ে যাচ্ছে শীতের এই দিনগুলোতে।

জাবি ক্যাম্পাসে সাধারণত তিনটি সময়ে অতিথি পাখীরা আসে।অক্টোবর-নভেম্ভর,নভেম্ভর-ডিসেম্বর ও ডিসেম্বর-জানুষারি।এর মধ্যে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই সময়টাতে সবচেয়ে বেশি পাখীর আগমন ঘটে ।বাংলাদেশে আসা অতিথি পাখীর প্রায় ১০-১৩ ভাগই আসে জাবি ক্যাম্পাসে।এই ক্যাম্পাসে যত রকমের পাখী আসে তার অধিকাংশই হাঁসজাতীয়।পাতারি হাঁস,পাতিতারা,নোনাপাখী,গয়ার,সরালি,খঞ্ছনা,ধুপানি অতিথি পাখীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতগুলো প্রজাতির নাম।এছাড়া শীতের শেষের দিকে ক্যাম্পাসে বামুনিয়া,শামুকখোলা,ঈগল ইত্যাদি পাখী আসে।বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ ও প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফাহমিদা হক বলেন,হাঁস জাতীয় পাখীই বেশি আসে।এসব পাখী প্রচন্ড শীতের কবল থেকে বাঁচতে আমাদের নাতিশীতোষ্ণ যে অঞ্চলগুলোতে চলে আসে জাবি তাদের মধ্যে অন্যতম।

প্রতিবছর সুদূর বরফাচ্ছাদিত সাইবেরিয়া,নেপাল,ভুটান,মঙ্গোলিয়া এমনকি পার্শ্ববতী ভারত থেকেও উড়ে আসা পাখীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে বেছে নেয়।ছায়া সুনিবিড়,শব্দহীন ও ঘনবসতিহীন ও ক্যাম্পাস হয় অতিথি পাখীদের আবাসভূমি।আর জাবির সকল শ্লেণীর মানুষই সাদরে এদের গ্রহন করে নেয়।

পাখী দেখথে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রকৃতি ও পাখীপ্রেমিকের ছুটে আসে জাবি ক্যাম্পাসে।দিনের শুরু থেকেই দর্শনার্থীরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারে।তবে এবছর পাখী দেখার কতগুলো নিয়ম করে দিয়েছে প্রশাসন।যেমন,লেকের ভেতর নেমে ছবি তোলা যাবেনা,হাত তালি দিয়ে পাখীদের উড়তে বাধ্য করা যাবেনা,কাগজ অথবা কোমল পানীয়য়ের বোতল লেকের ভেতর ফেলা যাবেনা ইত্যাদি।পাখীপ্রেমীদের আনাগোনা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে জাবি ক্যাম্পাসে।এসব দর্শনার্থীদের মধ্যে অনেকে ঢাকার বাইরে থেকেও এসেছেন পাখী দেখতে।এমনকি বিভিন্ন দেশের বিদেশী পর্যটকেরাও কেউ কেউ ক্যামেরা হাতে চলে এসেছেন পাখী দেখতে।
ফরিদপুর থেকে সস্ত্রীক আফতাবুর রহমান এসেছেন।তিনি বলেন,'অনেক পাখী!লাল শাপলার মাঝে পাখীগুলোকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।'ঢাকার মগবাজার থেকে এসেছেন সোয়েবুর রহমন।সঙ্গে ছেলে,মেয়ে ও স্ত্রী।তিনি বলেন,পরিবার নিয়ে আসাটা বৃথা যায়নি।ক্যাম্পাসটা সুন্দর,পাখী এসে আরো সুন্দর করেছে।'ঢাকার পান্থপথ থেকে ফাহিমা খানম এসেছেন।'অনেক দিন থেকে শুনেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শীতের পাখীদের কথা,আজ দেখলাম।সত্যি ভালো লাগছে।'ফাহিমা খানম বলেন।ভ্যালেরিয়া নামের এক কানাডিয়ান এসেছেন তার তিন বন্ধুর সাথে।তারা ভীষণ অভিভূত ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যে।'এটা মনে হচ্ছে স্বর্গ,স্বগের উদ্যানে পাখীগুলো উড়ছে আর আমরা বসে বসে দেখছি।আমাদের পাখী হতে ইচ্ছে করছে।'আনন্দিত ফ্লোরা বলেন।

পাখীপ্রেমিক যে কেউ ঢাকা থেকে সহজেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে পারেন।ঢাকার গুলিস্তান,ফার্মগেট, নিউমার্কেট,উত্তরা,গাবতলী যেকোন বাসস্টপ থেকে সাভারগামী বাসে চড়ে চলে আসতে পারেন দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অনেক সময় দীর্ঘ যানজট থাকে।একারণে ঢাকা থেকে সকাল ৭ টার মধ্যে যাত্রা করলে যানজটমুক্ত ভাবে আসা যাবে এবং সন্ধ্যার আগে এখান থেকে রওনা হয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়া যাবে।

দর্শনার্থীদের জন্য জাবিতে খাবারেরও সুব্যবস্থা রয়েছে।সকাল বেলা ক্যাফেটেরিয়াতে খিচুড়ি,পরোটা,ডিম ইত্যাদি পাওয়া যায়।তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাবারের দোকানগুলো রয়েছে বটতলায়।এখানে নানা প্রকারের খাবার পাওয়া যায়।সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'পিঠাচত্ত্বরে' পুলি,পাটিসাপটা,আন্দাসা,চিতই প্রভৃতি শীতের পিঠা পাওয়া যায়।

ঢাকার কোলাহলময়,ঘনবসতিপূর্ণ ও দূষণময় জীবন থেকে একটু ক্ষণের জন্য প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শ পেতে চলে আসতে পারেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।সবুজের মাঝে লাল ইটের ভবনগুলো কিছু মুহূর্তের জন্য আপনাকে সত্যিকার জীবনের ছোঁয়া দিবে।সেই সঙ্গে শীতের নানা প্রকারের অতিথি পাখী আপনার মনোরঞ্জনের জন্য কিচিরমিচির সঙ্গীত করবে।এই পরিবেশ অন্য কোথাও নেই।অতিথি পাখী,লাল লাল শাপলা ও চিরসবুজ বৃক্ষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজিয়েছে অপার্থিব সাজে,যেন অনাবিল প্রশান্তি ক্ষণে ক্ষণে।।
এমআইআর
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments