সর্বশেষ

আজ সেই দিন অথচ আমি কত স্বাভাবিক ও সমকাল

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ।
ঢাকা কলেজ উত্তর ছাত্রাবাস । কক্ষ নম্বর ৩১৩ ।
এখন যেমন আমি ঘুমাই এর থেকে কয়েক মাত্রা বেশি ঘুমাতাম আমি । সেদিন সকাল সাড়ে ৮ টায় ঘুম থেকে উঠলাম । গত কয়েকদিন থেকেই পিলখানা থেকে সামরিক গর্জনে ঘুম ভাঙতো । কোন এক তীব্র জোয়ানের সে কী বজ্রকন্ঠ । অস্ত্র ওওও....
সেদিনের সে সকালে সেই জোয়ান চিত্‍কার করেনি । তবুও ঘুম ভেঙে গেল ।
৮ টা ৪৫ মিনিটে হলের(ছাত্রাবাস গুলোকে আমরা হলই বলতাম, এটা শুধু ঢাকা কলেজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ) তৃতীয়তলায় ব্রাশ নিয়ে দাঁত মাজছিলাম । হঠাত্‍ বিকট গোলাগুলির শব্দ ! দেখলাম বিশ্বাস বিল্ডার্সের বিশাল বহুতল ভবনের ওপর ভেসে আসছে ধোঁয়া । কলেজ ক্যাম্পাসের সব কাক এক সঙ্গে কা কা করে উড়ে গেল নিউমার্কেটের ওপর দিয়ে ।

তখন পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক, ব্রাশটাকে নানা স্টাইলে মুখে দিচ্ছিলাম । তখন পর্যন্ত আমরাও স্বাভাবিক, 'ওই তাইজুল, শালা মাদারিপুরের বদ অথবা ঐ সোহেল, এবার কী মঙ্গায় পীড়িত হয়েছিস" বলে ঠাট্রায় ব্যস্ত । কেউ এসে হঠাত্‍ই 'ঢিসা ঢিসা ' বলছে ।
কেউ কী জানতো স্বাধীন বাংলাদেশের নৃশংসতম হত্যাকান্ড চলছে পশ্চিম ছাত্রাবাসের পিছনে ।

সকাল ৯ টা ১৫ ।
কে যেন দোতলার টিভি রুম থেকে দৌড়ে এসে বললো,'বিডিআর রাইফলস স্কোয়ার মার্কেট দখল করে নিছে । পিলখানায় আর্মি আর বিডিআর মুখোমুখি গোলাগুলি হচ্ছে !'

আতঙ্কে স্থির হয়ে রইলাম । এ কী হলো ! মাথার ভেতর প্রশ্ন আর প্রশ্ন ! কেন বিডিআর জোয়ানরা তাদেরই মার্কেট দখল করে নিবে ?
কেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিডিআরের সংঘর্ষ বাঁধবে ?
বাংলাদেশে কী গৃহযুদ্ধ শুরু হবে ?
আর ভাবার সময় পেলাম না । শতশত গুলিবর্ষণে আর আকাশ বাতাস কাঁপানো বিভংস শব্দে মুষড়ে পড়লাম ।
দৌড়ে চলে গেলাম টিভি রুমে । এমনভাবে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সংবাদ প্রচার করছিল যে সেনাবাহিনী এ দেশের বোঝা, এদের মেরে ফেলানোটা উত্তম ইত্যাদি ।
দেখেছিলাম মুন্নী সাহা নামের এক সাংবাদিকের সে কী উজ্জ্বল উপস্থিতি ! তখন বুঝিনি, এখন বুঝি ।

তারপরের ইতিহাস আর ইতিহাস বিকৃতি ও ধামাচাপা দেওয়ার ইতিহাস আমাদের সবার জানা ।
দেশের তরতাজা ৫৭ জন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার শহীদ হলেন । ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯ টায় শুরু হলো দরবার হল থেকে পৈশাচিক এই হত্যাকান্ড, সারাদিন ধর্ষণ , লাঞ্ছনা আর লুটপাট চললো । রাতভর লাশগুমের কাজ, কারো লাশ পুড়লো, কারোটা মাটির অনেক নিচে চাপা পড়লো, কী যে সে অবস্থা !

এরপর চলল অপরাধের মূল হোতা ও উস্কানীদাতাদের আড়াল করার অপ্রকাশ্য লীলাখেলা ।
নন্দঘোষের মত সব দোষ পড়লো জোয়ানদের ওপর ।
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ঠেকাতে বিডিআর এর মধ্যে যে গোয়েন্দা রয়েছে তাদের ব্যর্থতা অথবা নিশ্চুপ অবস্থা এড়িয়ে যাওয়া হয় ।
হত্যাকান্ড শুরু হয় ৯ টার দিকে, এর সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় গণমাধ্যমে বিডিআর মহাপরিচালক শাকিলের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে প্রচার করা হয় । এই ঘটনা পরে আর আলোচিত হয়নি ।

যে ৫৭ জন অফিসার নিহত হয় , কথিত আছে এরা সকলেই ছিল ট্রানজিট প্রদানে বিরোধী ।
হত্যাকান্ড শুরুর সঙ্গেই কেন কাউন্টার এটাকে যেতে দেওয়া হলোনা সেনাবাহিনীকে সে ব্যাপারটার সোরাহা এখনো হয়নি ।

২৫ ফেব্রুয়ারিই যদি অস্ত্র সমর্পনের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো যেত তবে অবশ্যই রাতে পিলখানার বেড়া ডিঙিয়ে মূল খুনীরা পালাতে পারতোনা । এছাড়া দুইদিন পরে ঘটনাস্থলে র্যাব ও সেনাবাহিনী প্রবেশের পূর্বেই অনেক আলামত নষ্ট করে ফেলার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ পেয়েছে বলেই মনে হয় ।

পরবর্তীকালে যেটা করা হয়েছে সেটার তাত্‍পর্য আজো বুঝিনাই । স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বাংলাদেশ রাইফেলস নামটির দিকে নজর পড়লো নির্ধারকদের । তারা বিএসএফ এর আদলে বিজিবি নামকরণ করলো ঐতিহ্যবাহী এই সামরিক বাহিনীটিকে ।

এখনো মনে আছে, তিন কিলোমিটার এলাকা খালি করে পাল্টা অভিযানে নামার ঘোষণা দিয়েছিল সেনাবাহিনী । অথচ অজ্ঞাত কারণে সেই অভিযান পরিচালিত হয়নি ।

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
চার চারটা বছর কেটে গেছে । যে অপূরণীয় ক্ষতি এই জাতির হয়ে গেছে তা পূরণ হবার নয় । কর্ণেল গুলজারকে এখনো মনে পড়ে । কয়েক মাসেই যে সন্ত্রাসীদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন ।

পিলখানার সকল শহীদদের বিনম্র শ্রদ্ধা ।

আজকের দিনটাতেও আমি এই দেশ, এই কাল ও এই সময় নিয়ে ভাবতে পারলামনা । সমকাল বড় দুঃসহ, সময়ের ক্রান্তিকালে পৌঁছে গেছি আমি, আমার চিন্তা, আমার কর্ম, আমার সৃজনশীলতা এখন রুদ্ধ ।

অনেক কিছুর পর জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রের করুন পরিস্থিতি বর্ণনায় হায়দার হোসেনের একটি গানের দুইটি লাইন উত্‍সর্গ করলাম যে বা যারা এই লেখা পড়ছেন তাদের উদ্দেশ্যে :
আমি চিত্‍কার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিত্‍কার,
বুকের ব্যথা বুকে জমায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার ।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments