 |
বিমান হামলায় হতাহত আলেপ্পোর সাধারণ জনত। ছবি/ এএমসি |
সিরিয়ার সর্ববৃহত্ শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী আলেপ্পোতে আসাদ ও রাশিয়া যে
বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তার ব্যাপারে বিশ্ব চুপ করে আছে কেন?সেই ২০১১
থেকে একটি দেশ জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে আর জাতিসংঘ তা বসে বসে দেখছে।এই
সংঘের অকার্যকারীতা সিরিয়া যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।এটির
বিলুপ্ত করে অন্য কিছু ভাবার সময় এসেছে বিশ্ব শান্তি রক্ষায়।রাশিয়া ও ইরান
সমর্থনপুষ্ট আসাদ সন্ত্রাসী এবং পশ্চিম,তুরস্ক ও আরবদের মদদপুষ্ট বিদ্রোহী
সন্ত্রাসীদের পারস্পরিক ক্ষমতার লড়াইয়ে নিরীহ মানুষ মরছে পাইকারী
হারে।মানবতার এতবড় অবমাননা দেখে ওআইসি আর জাতিসংঘ কিংবা এমনেস্টি কিভাবে
কিছু না করে স্থির রয়েছে?একটা শহর জ্বলছে,তার হাসপাতাল পর্যন্ত বিমান হামলা
করে ধ্বসিয়ে দেয়া হচ্ছে আর বিশ্বের মানুষ কিছুই বলছেনা।মানবতার
ফেরিওয়ালারা এতোটা সিলেকটিভ রেসিজম ধারন করে নিজেদের মানুষ বলে দাবি করতে
পারে কি?আমরা তখনই মানুষ হবো যখন সিনজারে মজলুম ইয়াজিদীদের বিপর্যস্ত
পরিস্থিতির মতোই আলোপ্পোর মজলুম জনতার জন্য কথা বলবো, তাদের দু:খে পাশে
দাঁড়াবো, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিন্দার ঝড় উঠাবো।পশ্চিমা ও এদেশের মিডিয়াও
কেমন নিরব আলেপ্পোর এ গণহত্যার ব্যাপারটিতে।
২।
আল জাজিরা ও
নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে প্রায় তিন শতাধিক সাধারণ মানুষ
আসাদের বোমা হামলায় হতাহত হয়েছে। ব্রিটেনভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর
হিউমান রাইটসের বিবৃতিতে এ সংখ্যা হাজারের অধিক বলা হয়েছে। আলেপ্পোর উপর
এই ভয়াবহ হামলায় আসাদ ও আসাদ বিরোধীদের দ্বন্দ্বে মারা পড়ছে জিম্মি সাধারণ
মানুষ। মজা পাচ্ছে অবৈধ ইসরাঈল। চুপ করে আসাদের আক্রমণকে সমর্থন করছে
ইরান।স্থল অভিযান চালাতে একমত হওয়া তুরস্ক ও সৌদি আরবও চুপসে
গেছে।যুদ্ধমঞ্চে আসাদের বর্বরতা দেখে সবাই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে কি?
 |
বাশার আল আসাদের বোমা হামলায় হতাহতের খবর আসছেনা রাশিয়া ও ইরানিয়ান মিডিয়ায় |
৩।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এই পাঁচ বছরে কমপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে।এর
মধ্যে সবচেয়ে বেশি মরেছে আলেপ্পো শহরের মানুষ। এর কারণ সুন্নী অধ্যুষিত এই
আলেপ্পে নগরীটি বাশার আল আসাদ ও তার পিতা কসাই হাফিজ আল আসাদের শাসনামলে
দামেস্ককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি কখনোই পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করেনি।
আরব বসন্তের শুরুতেও সিরিয়ার বিদ্রোহটি এই নগরের পথে পথে শুরু হয়েছে।
নিজস্ব স্বার্থ উদ্ধারে পৃথিবীর প্রতিটি শক্তি ইতিমধ্যে সিরিয়ায় নাক
গলিয়েছে।প্রত্যেকে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে।নিজেদেরে পুতুলের হাতে অস্ত্র ও
বোমা তুলে দিয়েছে। অনেকের মতে আমেরিকা ও রাশিয়া স্বল্প মাত্রার পারমাণবিক
যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবেও সিরিয়ার ব্যাটেলফিল্ডকে ব্যবহার করেছে,করছে।তাদের
অস্ত্রের বিনিময়ে তৈল ব্যবসা চলছে।আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে অবৈধ ইসরাঈল
দাঁড়িয়েছে।সুন্নী বনাম শিয়া রক্তাক্ত বিভাজন তৈরি করা হয়েছে।কেউ কিচ্ছু যেন
বুঝতেছেনা।কেন সিরিয়ার অভ্যন্তরে রাশিয়া ,আমেরিকা ,তুরস্ক,ইরাক,ইরান ও আরব
দেশগুলো নাক গলাতে আসলো?কেন এখন এ যুদ্ধ বন্ধে এরা সক্রিয় নয়?কচুসংঘের
শান্তিরক্ষা মিশন কি কেবল আফ্রিকার ঐ সরল সোজা গোবেচারাদের জন্য?হীরা ও
আকরিক সিরিয়াতে নেই বলে ওখানের ব্যাপারে নিরব পশ্চিমারা?নাকি জাতিসংঘের
প্রভু অবৈধ ইসরাঈলের নিরাপত্তার জন্য সিরিয়া যুদ্ধ চলমান রাখা জরুরী?
৪।
অবাক হয়ে দেখছি আলেপ্পোর উপর আসাদের গণহত্যার ব্যাপারে রাশিয়ার RT ও
ইরানের Press TV কেমন নিরব রয়েছে। এটি কিছুতেই বস্তুনিষ্ঠতা নয়।এমন
বায়াসনেসই আলেপ্পোর সাধারণ মানুষের জীবনকে আরো অনিরাপদ করছে।এটা মেনে নেয়া
কষ্টকর। আল জাজিরা Why Aleppo Matters নামের প্রতিবেদনে আলেপ্পোর
স্ট্র্যাটিজক গুরুত্ত্ব তুলে ধরেছে।আসাদ প্রয়োজনে তার পিতা কসাই হাফিজ যেমন
হামা গণহত্যা চালিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিল তেমন করে ঢালাওভাবে
মানুষ হত্যা করে হলেও আলেপ্পোকে নিয়ন্ত্রণে নিতে চেষ্টা করবে।সত্যি বলতে
আলেপ্পোতে Do or Die গেইম খেলছে আসাদ।
 |
বাশাল আল আসাদের বোমা হামলায় স্বজনহারা আলেপ্পোর এক শিশু |
এ নিয়ে আলেপ্পো পুনর্দখলের ডজনখানেক
অভিযান চালালো রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনপুষ্ট আসাদ।বিদ্রোহীরাও সাধারণ
মানুষকে নিয়ে এসব প্রতিহত করছে।অথবা সাধারণ মানুষ বাধ্য হচ্ছে।কারণ সশস্ত্র
যে বাহিনী একটি এলাকা দখল করছে কার্যত তারাই সেখানে অস্ত্র দিয়ে একটি
ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গঠন করে পরিচালনা করছে।আসাদের দখলকৃত অঞ্চল বা বিদ্রোহী
দখলকৃত অঞ্চল বলে কথা নেই,উভয় জায়গায় বলীর পাঁঠা আম জনতা।উভয় গোষ্ঠীর নীতিই
জর্জ বুশ নামের মহাসন্ত্রাসীর 'Either you are with us or you are with
the enemy'...!আলেপ্পো এবং তার সন্তানেরা আজ সকলের কমন এনিমি যেন! আসাদ মারছে তাদের, আইএস মারছে তাদের, নুসরা মারছে তাদের, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি মারছে তাদের। কি
নির্মম!কি নিদারুন! আলেপ্পোর মাটিতে তার সন্তানরাই বহিরাগতদের হাতে মরছে,
ওরা বুক চাপড়ে কাঁদছে। এয়ার স্ট্রাইক ও ভারী অস্ত্রের মুহুর্মুহু শব্দে সে
কান্না অবশ্য কথিত মেইনস্ট্রিম পৃথিবীতে একদমই আসছেনা।
৫।
 |
যুদ্ধের আগে আলেপ্পোর সেীন্দর্য |
আলেপ্পো
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সাজানো গোছানো সমৃদ্ধ শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও
পরিচিত।এর আরবী নাম হালাব।জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষের মত।এটি এসিরিও সভ্যতার
অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল।তুর্কি ওসমানীয় সাম্রাজ্যের তৃতীয় গুরুত্ত্বপূর্ণ
নগর ছিল হালাব।জগত্খ্যাত সিল্করোডের একটি ট্রানজিট এই শহরে এখনো আছে।শহরটি
খ্রীস্টের জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে থেকে মানব বসতিপূর্ণ।মেসোপটেমিয়
সভ্যতার কিউনিফর্মেও আলেপ্পো শহরের নাম আছে।এখানে তেল মারদিক বা ইংরেজিতে
Elba নামের স্বাধীন রাজত্ত্ব ছিল।কানাডার McGill University এর সহযোগী
অধ্যাপক Karl Moore আলেপ্পোর প্রাচীন রাজ্য তেল মারদিক বা ELBA কে বলেছেন
'First Recorded World Super Power' ।প্রাচীন ব্যাবিলনীয় যুগে ইয়ামহাদ
রাজ্য (Kingdom of Yamhad-c1800-1525 BC)ছিল নিকট প্রাচ্যের সবচেয়ে
ক্ষমতাধর রাজ্য।আলেকজান্ডার বহুকষ্টে নিয়ন্ত্রণে নেয়া এ শহরকে Beroea
বলতেন।বিখ্যাত সালাউদদিন আইয়ূবী ১১২৮ এর পর এটিকে আয়ূবী শাসনাঞ্চলে যুক্ত
করেন।১২৬০ সালে বর্বর মঙ্গলদের হাতে আলেপ্পোর পতন ঘটে।এ শহরে পর্যায়ক্রমে
রোমান,পারস্য,তুরস্ক,ফ্র্যান্স আগ্রাসন চালায়।এ নগরের সাথে
লন্ডন,ভেনিস,আমস্টারডামের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল চালুর
পর আলেপ্পোর ব্যবসায়িক গুরুত্ত্বের সাথে দামেস্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু
করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ভাগ বাটোয়ারায় ফ্র্যান্স
সিরিয়ার এই অংশ পায়।সেখানে আলেপ্পোর একটি অংশ তুরস্কে,একটি বর্তমান সিরিয়ায়
এবং কিছু অংশ ইরাকে পড়ে।সাম্রাজ্যবাদী ফ্রেন্চ ম্যানডেটের আলোকে আলেপ্পো
১৯২০ এর দিকে একটি স্টেটও ছিল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই আলেপ্পো
ফ্র্যান্স ও দামেস্কোর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে মিশর ও ইরাকের সাথে একত্রিত
হতে চায়। তবে তা হয়ে ওঠেনি দামেস্ককে কেন্দ্র করে গড়া ওঠা সংযুক্ত সিরিয়ায়
বিশ্বাসীদের প্রবল বাধায়। তবে দামেস্ককে রাজধানী করে সিরিয়া গঠনে
বিক্ষুব্ধ আলেপ্পোবাসী পরবর্তী কয়েক দশক আলেপ্পোকেই রাজধানী বলতো।মনেপ্রাণে
সিরিয়ায় আলেপ্পো থেকে দামেস্ককে অধিক গুরুত্ত্বারোপ কখনোই আলেপ্পোবাসী
মেনে নিতে পারেন।বাশার আল আসাদের বাথ পার্টির সাথে আলেপ্পোর সম্পর্ক কখনোই
ভাল ছিলনা।
 |
যুদ্ধে আহত আলেপ্পোর এক নারী |
১৯৭০ সালে বাশার আল আসাদের পিতা কসাই হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতায় এসে
আলেপ্পোকে সিরিয়ায় অবহেলিত ও একপেশে করে ফেলেন। একসময়ের কালচারাল, ইকোনমিক ও
রিজিওনাল পাওয়ার আলেপ্পো দিনেদিনে সিরিয়ার নয়া ক্ষমতা কাঠামো থেকে দূরে
সরে যেতে থাকে। এই চাপা ক্ষোভ নিয়ে বছরের পর বছর প্রজন্মের পর প্রজন্ম
আলেপ্পোর সাধারণ মানুষ সিরিয়ায় বাস করে এসেছে।
 |
আলেপ্পো নগরীর একাংশ |
একারণেই কথিত আরব বসন্তে
আলেপ্পোই আসাদ বিরোধী অবস্থানের কথা প্রথম জানিয়ে দেয়। আসাদের হাত থেকে
ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ইত্যাদি বিদ্রোহীদের কাছে তাই প্রথম দিকে যে সকল শহরের
পতন ঘটে আলেপ্পো তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান গুরুত্ত্বপূর্ণ ও কেীশলগতভাবে
বিদ্রোহীদের জন্য সাফল্যজনক ঘটনা।তার ফলাফলই এখনকার চলমান গণহত্যা !সেই
২০১১ থেকে এক সময়ের রাজ্য,রাষ্ট্র,রাজধানী ও নগর আলেপ্পো এখন পুড়ছে, পুড়ে
যাচ্ছে আলেপ্পোর অধিবাসীরা!নির্বিচারে খুন হচ্ছে আলেপ্পো ও তার
সন্তানেরা...!পৃথিবী নির্বাক, একদম নির্বাক!আমরা ভুলেই গিয়েছি আলেপ্পোতে যেমন টেররিস্টরা রয়েছে তেমনই সেখানে
মডারেট ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ও অন্যান্য সিরিয় মুক্তিকামীদের অবস্থান রয়েছে।সিরিয়া যুদ্ধের ভয়াবহতা আরো কত
নয়া অমানবিকতা দেখায় তা এখনই বলে দেয়া সম্ভব না। পৃথিবীর সকল নিপীড়িত
মানুষের মুক্তি আসুক। পতন হোক সব অত্যাচারীদের। মানুষের রক্তে আর যেন পৃথিবীর এক
ইঞ্চি ভূমিও রঞ্জিত না হতে পারে সেজন্য সকল মানবতাবাদী ও শান্তিকামীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে...।
পুনশ্চ: সোস্যাল মিডিয়ায় অনেক মানবাধীকার কর্মী ফেসবুক ও টুইটারকে রক্তাক্ত করতে আন্দোলন করছে। তারা আলেপ্পোর জন্য পৃথক সেইফটি নোটিফিকেশন চালুরও দাবি করেছে।
#AleppoIsBurning #AleppoMassacre
হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে আলেপ্পর পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য বিশ্ব বিবেককে এক হওয়ার বিশ্ব আহবান জানাচ্ছে।যদিও এ ব্যাপারে ফেসবুক এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
0 Comments