সর্বশেষ

পাক-ভারত চলমান যুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইক ( Surgical Strike ) কি ?

Indian army claimed Surgical Strike crossing the line of control. Photo/ Internet
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ থেকে পৃথিবীর দুই পারমানবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত পর্যায়ের যুদ্ধ শুরু হয়েছে । ভারতের উরী সেনাঘাঁটিতে মিলিট্যান্টদের আক্রমণে ১৭ সেনা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ভারত পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে ৩৮ জন সন্ত্রাসী ও ২ জন পাক সেনাকে হত্যা করেছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যম NDTV সংবাদ দিয়েছে । এর জবাবে পাকিস্তান ১৩ ভারতীয় সেনাকে হত্যা ও একজনকে আটক করার দাবি করেছে বলে পাক সংবাদপত্র dawn জানিয়েছে । উভয় দেশ পরস্পরের দাবিকে নাচকও করেছে। এ হিসেবে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে । কিন্তু কি এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক যা নিয়ে মিডিয়া ও সামরিক অঙ্গন তোলপাড় ?

 ২।

সার্জিকাল স্ট্রাইক ( Surgical Strike ) একটি সামরিক প্রতিশব্দ । এর মাধ্যমে যে সামরিক অভিযান চালানো হয় তাতে নৌ , বিমান ও স্থল তিন বাহিনী অংশগ্রহণ করতে পারে অথবা যে কোন এক বা একাধিক বাহিনী এটি পরিচালনা করতে পারে । তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও এ বিষয়ক পড়াশোনা যা আছে তা থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে , একটি সফল সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের জন্য এয়ারফোর্স তথা বিমান বাহিনীর উপস্থিতি আবশ্যক । কেন তা পরে বলছি । আগে আরেকটু এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারনা প্রদান করছি ।



সহজ করে যদি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সংজ্ঞা দিই তবে বলা যায়, সার্জিকাল স্ট্রাইক ( বহুবচনে সার্জিকাল স্ট্রাইকস ) হচ্ছে বিশ্বের সবকটি দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রচলিত অভিন্ন অভিযানের নাম যার মাধ্যমে সবচেয়ে কম বেসামরিক জানমালের ক্ষতি করে সামরিক টার্গেটকে নিশ্চিহ্ন করা হয় । অর্থাৎ সামরিক অভিযান চলবে তবে বেসামরিক মানুষ হতাহত হবেনা। যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্রগ্রামের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সার্জিকাল স্ট্রাইক জাতীয় অপারেশন চালিয়ে থাকে যার কারণে পার্বত্য চট্রগ্রামে সামরিক অভিযানে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা শূন্যের কোটায় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে অবৈধভাবে আক্রমণ চালিয়ে প্রথমে সরকারী ও সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আঘাত করে । এটিকে আমি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সার্জিকাল স্ট্রাইক হিসেবে দেখি । আবার ২০১৬ এর মাঝামাঝি সময়ে ভারতীয় প্যারা কমান্ড মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঢুকে ৩৮ জন নাগা স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের হত্যা করে আসে । এটিও সার্জিকাল স্ট্রাইক । কেনিয়ার সেনাবাহিনী ২০১১ সালে Operation Linda Nchi নামে সোমালিয়ার অভ্যন্তরের আল শাবাব সন্ত্রাসীদের উপর সার্জিকাল স্ট্রাইক চালায় । বিশ্বজুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চলচ্চিত্রগুলোয় এই ধরনের অভিযান দেখা যায়। আবার ভিডিও গেমসেও সার্জিকাল স্ট্রাইক প্রতিশব্দটি ব্যবহৃত হয়।


৩।
সামরিক অভিযানকে সার্জিকাল স্ট্রাইক বলতে হলে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে । এগুলো হলো:-


ক. অভিযানের একটি সুনির্দিষ্ট টার্গেট থাকবে

খ. দ্রুত সময়ে টার্গেটকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সফল অভিযান নিশ্চিত করা হবে

গ. কোন ধরনের বেসামরিক প্রাণ মরবেনা , বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস হবে না

ঘ. দু’দেশের মধ্যে সংঘর্ষ হলে অবশ্যই শত্রুরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অভিযান পরিচালিত হবে । এক্ষেত্রে আকাশপথে প্রবেশ করে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ফের ফিরে আসা সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি
এবং

ঙ. অভিযান পরিচালনাকারী সামরিক বাহিনীর অক্ষত অবস্থা বিরাজ করবে অর্থাত্‍ সেনাদল নির্দিষ্ট টার্গেটকে নিশ্চিহ্ন করে নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে আসবে ।


সার্জিকাল স্ট্রাইক প্রতিশব্দটি আসলে চিকিত্‍সাবিজ্ঞান ও সমরবিজ্ঞানের সম্মিলিত রূপ । চিকিত্‍সাবিজ্ঞানের Surgery থেকে Surgical তথা সার্জিকাল এবং সমরক্ষেত্রের স্ট্রাইক বা Strike নিয়ে Surgical Strike । সার্জারি মানে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে অস্ত্রপচার করে রোগমুক্তি যাতে অন্যান্য স্থানের কোন ক্ষতি না হয় । সার্জিকাল স্ট্রাইকও অনেকটা সমরক্ষেত্রের অস্ত্রপচার যাতে কোন সাধারণ মানুষ ও বেসামরিক জানমালের ক্ষতি না হয় ।


৪। 
কেন এমন নাম ? ( কাউন্টার ডিসকোর্স )

সার্জিকাল স্ট্রাইক শূন্য অথবা সবচেয়ে কম Collateral Damage অর্থাত্‍ বেসামরিক হতাহত অবস্থা তৈরি করে যুদ্ধাবস্থায় । সার্জিকাল এয়ার স্ট্রাইককে বলা যায় , সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞতার বৈধতা প্রদানের এক ধরনের মানবিক কৌশল । অর্থাত্‍ সামরিক তথা নৌ , সেনা ও বিমান বাহিনীর অভিযানের সময় সেনাদের অপরাধ ঢাকার ও অপরাধবোধকে অবদমন করার মনস্তাত্ত্বিক উপায় হিসেবে সার্জিকাল স্ট্রাইক ধারনার উদ্ভব হতে পারে ।  এছাড়াও বিশ্বরাজনীতির কূটনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতেও যুদ্ধরত বা আগ্রাসী শক্তি এই প্রতিশব্দ ব্যবহার করে আক্রমণ চালাতে পারে । আবার ভারতের মত পূর্বের আক্রমণের প্রতিশোধ নিতেও সার্জিকাল স্ট্রাইক হতে পারে । সন্ত্রাসী লাদেনকে হত্যায় আমেরিকান বর্বর রাষ্ট্র পাকিস্তানে নেভি সিলের অভিযানকেও সার্জিকাল স্ট্রাইক বলা যেতে পারে । আবার সম্প্রতি সিরিয়ার আলেপ্পোতে সন্ত্রাসীদের উপর চালানো রাশিয়ান এয়ার স্ট্রাইকও সার্জিকাল স্ট্রাইক যদি তা বেসামরিক হতাহতের কারণ না হয় । মোটাদাগে বলা যায় , সার্জিকাল স্ট্রাইকের বহুরূপী ব্যবহার হতে পারে । আর তা অবশ্য হয় মিডিয়ার হাত ধরে যা এখন চলছে ভারত ও পাকিস্তানের গণমাধ্যম জুড়ে।


৫। 

সমর সংশ্লিষ্টরা কি বলছেন ?



ভারতের অবসরপ্রাপ্ত লেঃ জেঃ শঙ্কর প্রসাদের মতে, '' সার্জিকাল স্ট্রাইক এক ধরনের জটিল সামরিক অভিযান যাতে দুর্গম স্থলে দ্রুত গতিতে অভিযান চালিয়ে আক্রমণ করে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসা হয় । এটি পরিচালনায় বুকের পাঁটা থাকা লাগে ।'' (এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাত্‍কারে ।)
পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল শাহাজাদ চৌধুরী ডনকে বলেন, '' সার্জিকাল স্ট্রাইক হচ্ছে এক ধরনের ঝটিকা অভিযান যাতে একটি সামরিক দল তার কাজ করে আবার ফিরেও আসে এবং কোন 'কোলাটরাল ড্যামেজ' হয়না । ''

এই দুই সাবেক সামরিক কর্মকর্তার সংজ্ঞা থেকেও আমরা পূর্বে আলোচিত সংজ্ঞায়নের সমর্থন পাই ।

৬।
সর্বশেষ সার্জিকাল স্ট্রাইকঃ

এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বশেষ সার্জিকাল স্ট্রাইক পরিচালনা করেছে ভারত । ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক সীমারেখা Line of Control ( ইন্দো-পাক মিডিয়ায় এটি LoC নামে আসে ।) বা নিয়ন্ত্রণরেখা ।
এর একপাশে ভারত , আরেক পাশে চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান । এই রেখা ডিঙিয়ে সার্জিকাল স্ট্রাইক চালিয়েছে ভারতীয় সেনারা এই তথ্য দিয়েছেন ভারতের ডিজিএমও লেঃ জেঃ রণবীর সিং ।
Pakistan's counter claim of killing 8 Indian soldiers
এদিকে পাকিস্তান স্বীকার করছেনা এটি সার্জিকাল স্ট্রাইক । কারণ তাতে পাকিস্তানের 
সামরিক বাহিনী বিশেষ করে বিমান ও সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর দূর্বলতা প্রকাশ পায় এবং জননিরাপত্তায় তাদের ব্যর্থতা প্রমাণিত হয় । আবার ভারতীয় সেনাবাহিনী এটি দাবি করে সত্যতা প্রমাণ করলে তাতে ভারতীয়দের বিজয় হবে - সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক । তবে সার্জিকাল স্ট্রাইক বিষয়ে সেনাবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন করার সময়ে কোন সংবাদকর্মীকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয়নি ( বিবিসি বাংলা ) বলে সফল সার্জিকাল স্ট্রাইক বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে ।
 
Press conference of India e where journalists coudn't ask anything

আর পাকিস্তান তো নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে সার্জিকাল স্ট্রাইককে অস্বীকার করছে । পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক হাসান আসকারী বলেন , '' ওটা ছিল স্থল আক্রমণ , সার্জিকাল স্ট্রাইক না । ভারতীয় সেনারা তাদের এলাকা থেকে গুলি করেছে । '' পাকিস্তানের লেঃ জেঃ ওয়াশিম বাজওয়া বলেন ,'' এটি ছিল সীমান্তে দুপক্ষের ক্রশফায়ার যেখানে হালকা অস্ত্র ও মর্টার ব্যবহৃত হয় । সার্জিকাল স্ট্রাইক একটি ভারতীয় অপপ্রচার ছাড়া কিছু না ।' পাকিস্তানীদের এই অস্বীকার প্রমাণ করছে সার্জিকাল স্ট্রাইক সামরিক এক বড় ধরনের সফলতা । ভারত যেটি করেছে তা সার্জিকাল স্ট্রাইক কি না তা ইতিহাসই বলে দেবে । এই মুহূর্তে পাক-ভারত উভয়ে চোর পুলিশ খেলবে বলেই মনে হচ্ছে ।



                                                                 শেষকথা
We don't wanna see bloody battlefields like this in our subcontinent. We just want peace.

সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে আর কথা হবে না , অনেক হয়েছে । আমরা যুদ্ধ চাইনা । শান্তি চাই । দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে , ঘটতে পারে মানবিক ও পরিবেশগত ভয়াবহ বিপর্যয় । তাই দুইশ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে ভারত ও পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের প্রতি আবেদন রইলো । সেই সাথে বাংলাদেশকে অনেক ভেবেচিন্তে এই দুই দেশের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে । আমরা পক্ষ না নিয়ে মধ্যস্থতাও করতে পারি যেটি বঙ্গবন্ধু আমাদের Non-Aligned Movement-NAM এ যোগ দিয়ে শিখিয়ে গিয়েছেন। তারপরেও সময়ের সাথে জাতীয় স্বার্থে সতর্ক দৃষ্টিতে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির জটিল অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে ।



যুদ্ধ নয় , শান্তিই হোক আমাদের কামনা । আমাদের ধ্যান ও ধারনা । শান্তিই হোক আমাদের প্রার্থনা ।
 

********************************************************************************
আমি -
মঈনুল রাকীব
মুক্ত সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী
সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments