সর্বশেষ

রবীন্দ্রনাথ বনাম বব ডিলানঃ দুজন কি এক?


নোবেল প্রাপ্তিতে
ডিলান বনাম রবীন্দ্রনাথ এবং ডিলানের নোবেলের বিপক্ষ-যুক্তি
মোজাফফর হোসেনঃ
(শিরোনাম দেখেই মন্তব্য না করার অনুরোধ রইল)
২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন জনপ্রিয় মার্কিন সংগীতশিল্পী ও গীতিকার বব ডিলান। তাঁর এই নোবেল জয়ের পর থেকেই পক্ষে-বিপক্ষে কথা হচ্ছে বিশ্বজুড়েই। বাংলাদেশে অনেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বব ডিলানের নোবেল জয়কে তুলনা করছেন। তাঁদের বক্তব্য হল, রবীন্দ্রনাথের পর গীতিকবিতায় নোবেল পেলেন ডিলন। তাঁদের এই বক্তব্যেই সঙ্গে আমি ভিন্নমত পোষণ করছি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বব ডিলানের স্পষ্ট পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথ গান লিখলেও ওগুলো ছিল প্রধানত কবিতাই। নোবেল কর্তৃপক্ষ সংগীত হিসেবে ওগুলো শোনেননি। গীতাঞ্জলি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। অর্থাৎ নোবেল পাওয়ার আগে এই গানগুলি বাংলাতেও সেই ভাবে গীত হয়নি। এরপর গীতাঞ্জলির ১৫৭টি গীতিকবিতার ভেতর ৫৩টি গান নেওয়া হয় সং অব অফারিংসে। বাকি ৫০টি রবীন্দ্রনাথ বেছে নিয়েছেন গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, কল্পনা, চৈতালি, উৎসর্গ, স্মরণ ও অচলায়তন থেকে।


গীতাঞ্জলির অনুবাদে কবিতার ভাবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথের সং অব অফারিংস-এর জন্য সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার কারণ উল্লেখ করে বলেছেন-- "...because of his (Rabindranath Tagore) profoundly sensitive, fresh and beautiful verse, by which, with consummate skill, he has made his poetic thought, expressed in his own English words, a part of the literature of the West".
গীতাঞ্জলির অনুবাদের একটা উদাহরণ টানা যায়: (গীতাঞ্জলি কাব্যের ১২৫ সংখ্যক গানটি উদ্ধৃত করা হল)
আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার
তোমার কাছে রাখেনি আর সাজের অহংকার।
অলংকার যে মাঝে প’ড়ে
মিলনেতে আড়াল করে,
তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার।
তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা–
মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা।
জীবন লয়ে যতন করি
যদি সরল বাঁশি গড়ি,
আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার।
রবীন্দ্রনাথের করা ইংরেজি অনুবাদে এটি হয়েছে :
"My song has put off her adornments. She has no pride of dress and decoration. Ornaments would mar our union; they would come between thee and me; their jingling would drown thy whispers."
"My poet's vanity dies in shame before thy sight. O master poet, I have sat down at thy feet. Only let me make my life simple and straight, like a flute of reed for thee to fill with music."
লক্ষ্য করার বিষয়, রবীন্দ্রনাথের নিজের অনুবাদেই বাংলা কবিতায় যে গীত বৈশিষ্ট্য সেটা ইংরেজি অনুবাদে অটুট থাকেনি। এটা তো ঠিকই যে, রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ কবিতা নয় গীতিকবিতার জন্য নোবেল দেওয়া হয়। গীতিকবিতার জন্য রবীন্দ্রনাথই একমাত্র নোবেল পাননি। ১৯৪৫ সালে গ্যাব্রিয়েল মিস্ট্রেলের নোবেল পাওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি উল্লেখ করেন : for her (Gabriel Mistral) lyric poetry which, inspired by powerful emotions, has made her name a symbol of the idealistic aspirations of the entire Latin American world. ১৯৫৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পান স্প্যানিশ কবি Juan Ramón Jiménez। তাঁর নোবেল পাওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি লেখেন : "for his (Juan Ramón Jiménez) lyrical poetry, which in Spanish language constitutes an example of high spirit and artistical purity". ইটালিও কবি Salvatore Quasimodo সাহিত্যে নোবেল পান ১৯৫৯ সালে। তাঁর ক্ষেত্রেও নোবেল কমিটি লেখেন : "for his (Salvatore Quasimodo) lyrical poetry, which with classical fire expresses the tragic experience of life in our own times" সুইডিশ কবি Nelly Sachs নোবেল পান ১৯৬৬ সালে। তাঁকে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি প্রায় একই কথা বলেন: "for her (Nelly Sachs) outstanding lyrical and dramatic writing, which interprets Israel's destiny with touching strength"
রবীন্দ্রনাথসহ উল্লিখিত গীতিকবিদের প্রায় সকলেই কমবেশি ভাববাদী কবি। রবীন্দ্রনাথের গান গীত হয়েছে অন্যদের হয়নি কারণ বাংলায় কবিতাকে সংগীতে রূপ দেওয়ার যে সংস্কৃতি বা চল আছে সেই সংস্কৃতি পৃথিবীর সবখানে নেই। যে কারণে বাংলায় অনেক কবিতা গীতিকবিতা না হয়েও শিল্পীরা গেয়েছেন এবং সেগুলো জনপ্রিয়ও হয়েছে বেশ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যদি বাংলাদেশের কবি হতেন নিশ্চিত করেই তাঁর অধিকাংশ কবিতা গাওয়া হত গান হিসেবে।
এখন আসছি বব ডিলানের প্রসঙ্গে। বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেছেন : "...having created new poetic expressions within the great American song tradition." অর্থাৎ ডিলন পরিষ্কারভাবেই সংগীতের মানুষ হিসেবে পুরস্কারটি পেয়েছেন। ডিলানকে বুঝতে হলে রবীন্দ্রনাথ নয়, বরং কিছুটা লালনের প্রসঙ্গ টানা যেতে পারে। লালনের মতো ডিলন জীবনবাদী বা মানবতাবাদী শিল্পী। নিজে গান লিখেছেন, নিজেই গেয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর লেখাগুলোকে সংগীত থেকে আলাদা করার উপায় নেই। সেগুলো লেখা হয়েছেই গানের কথারূপে। তবে লালন যতটা মরমী কবি, ডিলান আবার ততটা নয়। ডিলন পরিষ্কারভাবেই সংগীতের মানুষ। তিনি যতটা না গীতিকবি, তার চেয়ে বেশি গীতিকার। প্রখ্যাত গীতিকার। নিজের ফিল্ডে শিখরে আসীন তাঁর। সেই হিসেবে তিনি সংগীতের জন্য নির্ধারিত গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ১০ বারেরও বেশি। আরো ২০ বারের বেশি মনোনয়ন পেয়েছেন। পেয়েছেন সংগীতে গোল্ডেন গ্লোব ও অস্কার। বার বার এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর আছে, এমনই উচ্চমাপের গীতিকার ও সংগীতশিল্পী তিনি।

যে কারণে বব ডিলানের দেশের স্বনামধন্য পত্রিকায় আনা নর্থ Why Bob Dylan Shouldn’t Have Gotten a Nobel শীর্ষক মতামত কলামে উল্লেখ করেছেন : Yes, Mr. Dylan is a brilliant lyricist. Yes, he has written a book of prose poetry and an autobiography. Yes, it is possible to analyze his lyrics as poetry. But Mr. Dylan’s writing is inseparable from his music. He is great because he is a great musician, and when the Nobel committee gives the literature prize to a musician, it misses the opportunity to honor a writer.
উল্লিখিত গদ্যে আরো বলা হয়েছে: Instead, the committee gave the prize to a man who is internationally famous in another field, one with plenty of honors of its own. Bob Dylan does not need a Nobel Prize in Literature, but literature needs a Nobel Prize. This year, it won’t get one.
পৃথিবীজুড়ে সাহিত্যের পাঠক কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নোবেল কমিটি যেন বিশুদ্ধ সাহিত্যের বাইরে পা ফেলতে চাইছেন। তারা এই পুরস্কারের সঙ্গে ‘new cultural currency’ যুক্ত করতে চাইছেন। এর আগের বছর সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচকে নোবেল দেওয়া হল সাংবাদিকতার জন্য। তাঁর যে লেখা সেগুলোর সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক মূল্য আছে নিশ্চয়, কিন্তু সাহিত্যমূল্য কতখানি আছে সেটি ভাববার বিষয়। থাকলেও সেটি কি অ্যাডোনিসের কবিতা কিংবা কুন্দেরার গদ্যের মতো পাওয়ারফুল?

বিশ্বজুড়ে যখন বইয়ের পাঠকের সংখ্যা কমছে তখন অবশ্যই বিশুদ্ধ সাহিত্যের লেখকদের এই পুরস্কার দেওয়া উচিত। তাতে করে সাহিত্যের একটা ব্র্যান্ডিং হয়, পুরস্কৃত লেখকের বই বিক্রিও বাড়ে। এগুলো নোবেল কমিটির ভাবা উচিত।
এখন প্রশ্ন হল: গানের কথা, টেলিভিশন নাটক অথবা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য—এসবে
র কি সাহিত্যমূল্য নেই? নিশ্চয় আছে। সাহিত্যের বোধকে আর একটু বিস্তারিত করলে বলা যায়—চিত্রকলার ও যন্ত্রসংগীতেরও সাহিত্যমূল্য আছে। তাই এসব বিভাগে কেউ একজন সাধারণ স্তর ছাড়িয়ে গেলে তাঁকে সম্মানিত করা উচিত। এজন্য চাইলে নোবেল কমিটি ‘শিল্প-সংস্কৃতি’ নামে নতুন বিভাগ চালু করতে পারেন।
যে কারণে একজন কবি কবিতার জন্য, কিংবা কথাসাহিত্যিক উপন্যাসের জন্য (চিত্রনাট্য নয় কিন্তু) অস্কার পান না, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পান না, সেই কারণে আমি প্রত্যাশা করি না একজন গীতিকার সাহিত্যে নোবেল পাবেন। আমার এই বক্তব্য প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ বব ডিলনের বিপক্ষে নয়। এই বক্তব্য নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের বিপক্ষে।

বব ডিলান মহান শিল্পী। তিনি বাংলাদেশের বন্ধু। আমাদের স্বাধীনতা-যুদ্ধে রবি শংকরের আহবানে
সাড়া দিয়ে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশ নিয়েছেন। যে আমেরিকা এই যুদ্ধে বাংলাদেশ-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, সেই আমেরিকার মানুষ হয়েও তিনি বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধেও যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর এই যুদ্ধবিরোধী-মানবতাবাদী চেতনার কারণে তিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। নোবেল পুরস্কারকে তাঁর একটি অর্জন হিসেবে ভেবে আমি তাঁকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাই। সাথে এও উল্লেখ করি, নোবেল পুরস্কার যখন তিনি পেলেন তখন তিনি নিজেই এই পুরস্কারের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। এই পুরস্কারে কিছু অর্থ ছাড়া নতুন কিছু তাকে দিতে পারবে না। পৃথিবী তাঁকে চেনে, সম্মান জানাই-- একটুও কম না যে নোবেল তা বাড়িয়ে দিতে পারবে রাতারাতি। আবারো শুভেচ্ছা গানের কবি বব-ডিলানকে।
★★মোজাফ্ফর হোসেন
পাঠ অনুভূতি

Post a Comment

0 Comments