সর্বশেষ

বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তি এবং গান বা সংগীতকে সাহিত্য বলা না বলার তর্ক



১।
যেসব ফেসবুক উজবুক বব ডিলানের সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তি দেখে নাক সিঁটকায় এরা কি জানেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে অনুষ্ঠিত Concert For Bangladesh এ গেয়েছিলেন আমাদের ও পৃথিবীর সকল বিপ্লবীদের বন্ধু এই বব ? এরা কি ভাবে সাহিত্য শুধু পাতায় লিখিত অক্ষর? কি করুণ ও দরিদ্র এদের চিন্তা-ভাবনা । এরাই সাংবাদিকতা ধাঁচের লেখায় নোবেল দেয়ায় কিছুকাল আগে গোঁস্যা করেছিল । এই অসুস্থ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণ কি ?
২।
কারণ আসলে প্রচলিত খাতাবাজি, প্রকাশনাবাজির দিন এখন শেষ হতে চলেছে সেটা মেনে না নেয়ার গোঁড়ামীপূর্ণ প্রবণতা । এই ইন্টারনেট যুগে সামান্য কয়েক সেকেন্ডের একটা ভিডিও বা মিউজিক ভিডিও ও বিরাট বইয়ের চেয়ে বিনোদনমূলক, শিক্ষামূলক, মানবকল্যাণমূলক হতে পারে । কিছুদিন আগে মধু হই হই আরে বিষ হাওয়াইলা এর সেই জাহিদকে কিন্তু গানেই তুলে এনেছে , এনেছে অকাগুজেপ্রকাশনা গান ।
  গান গেয়ে মানবতার জন্য কাজ করা কঠিন এবং প্রভাবশালী । প্রতিটি বিপ্লবকে গতিশীল করে গান । ১৯৭১ সালের সেই  ‍মুক্তির গানগুলো ভুলে গেছেন? ব্রিটিশানুরাগী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যে গানের পান্ডুলিপিতে নোবেল পেয়েছেন তা জানেন তো? জেনে বব ডিলানের সমালোচনা করছেন তো? নাকি কাব্যগ্রন্থ ও গল্পগ্রন্থ বা উপন্যাস বা সমালোচনাহগ্রন্থ না বেরোলে সাহিত্যের মাঠে খেলতে নেবেন না আপনারা? চলচ্চিত্র যে সাহিত্যর সবচেয়ে বৃহৎ ক্ষেত্র হতে চলেছে অথবা হয়েছে তার খোঁজ নিচ্ছেন তো হে খাতাবাজি/বইবাজি/গ্রন্থবাজি/প্রকাশনাবাজি করা লোক/লেখক? এখন দিন বদলাইছে । এখন ভিডিওবাজি, ইনফোগ্রাফিক্স, ফটোস্টোরি, মিউজিক্যাল মুভির যুগ । গানকে বাদ দিয়ে আর কিছুই হবেনা এ যুগে মনে হয় । অন্ততপক্ষে ব্যাকগ্রাউন্ড-এ মিউজিক বা সাউন্ড দিয়ে হলেও কবিতা আবৃত্তিও চলছে । এই তো শুরু ফের গানের জোয়ারের । গান লিখুন । গান গান (মানে গান গাহেন ওগো বব ডিলানবিদ্বেষী । হাহাহা ।)।
৩।
সুতরাং গানকে সাহিত্যের বাইরে ফেলে এরা, এই সব বই প্রকাশনা নির্ভর সাহিত্যের সার্টিফিকেটধারী অসুস্থরা কোন চিন্তায়? গান তো কবিতা-গল্প-উপন্যাসেরই প্রকাশ । গানেরই বিবর্তিত অথবা বিকৃত রূপ কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক । গানই মাতা । গানই সাহিত্যের মা হে, গানকে নোবেল দেয়ায় আকুপাকু করা অসুস্থ উজবুকপাল । বাংলাদেশে আপনার জানা ইতিহাসের সাহিত্য শুরু হয়েছে চর্যাপদ দিয়ে । খুবই করুণ আপনাদের জানার প্রতিনিধি । সহস্র বছর ধরে মানুষ মুখে মুখে গান গেয়েছে, ছড়ায় সুর করে গেয়েছে, পুঁথি সুর করে পড়েছে । কিছুদিন আগের লালনও আপনাদের মত খাতাবাজ ছিলোনা । তারে সাহিত্যিক বলতে কোথায় বাঁধা? এই জ্ঞানের দীনতার উৎস কি হে?
৪।
যা হোক, তিন শ্রেণীর লোক সংগীত শিল্পী ও গীতিকার বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার দেয়ায় বিক্ষুব্ধ মনে হচ্ছে । তারা হচ্ছেঃ
ক। সাহিত্যের ব্যাপ্তি ও পরিধি সম্পর্কে অজ্ঞরা- তা সে যতই বিরাট স্বঘোষিত কবি হোক না কেন
খ। প্রতি বছর নোবেল পুরষ্কার পাওয়াদের বই বাংলায় অনুবাদ করে বই মেলায় বা পত্রিকায় পয়সা কামানোরা
গ। যাদের কাছে সাহিত্য মানে নারী-পুরুষ সম্পর্কে নিয়ে লুতুপুতু কবিতা-চটিতা-গল্প লেখা ।

৫।
এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে । কারণ এরা ব্যাকরণের বাইরে এক ইঞ্চি চিন্তা করতে পারেনা । এদের জ্ঞান যতোটা প্রকৃতিপ্রদত্ত তারচেয়ে বেশি টেক্সটবুক হতে নেয়া । চিন্তা ভাবনা ইউরোপের বস্তাপঁচা পোস্টমডার্নিজম, মডার্নিজম ইত্যাদির চারপাশে ঘোরাঘুরি করে । একটি অলস, বাস্তবতাকে পাশ কাটানো ভীতু, রোমিন্টক পেসিমিস্ট বিকলঙ্গ প্রজন্ম এখন সাহিত্য চর্চা করে । তাতে সমাজ পরিবর্তনের চেয়ে নারীর শরীরের গঠন ও তা প্রাপ্তির কলাকেীশল প্রাধান্য পায় । আজকের মানব সমাজের পরিবর্তন, অসামঞ্জস্যতা, বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে কিছুই করছেনা এই সাহিত্যর ইজারা নেয়া গানকে নোবেল দেয়া মেনে না নেয়ারা । অথচ গানই সাহিত্যের একমাত্র শাখা যেটি সমাজের নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কৃষক-ছাত্র সবার কাছে সমান আবেদন নিয়ে যায়। গানের এই শক্তির কাছে আজকের কবিতা-গল্প-উপন্যাস একটি বিন্দু ছাড়া কিছুনা । যেসব কবিতা বিপ্লবে কাজে লেগেছে তাদেরও গানের রূপ ধরতে হয়েছে মানুষের কাতারে আসতে । অজ্ঞ, সংকীর্ণ কেউ ছাড়া কেউ গানকে সাহিত্য থেকে বের করে দিতে চায়না ।
৬।
বব ডিলানকে অভিনন্দন । ১৯৯৩ সালের পর এই প্রথম সাহিত্যে কোন মার্কিন নাগরিক নোবেল পুরষ্কার পেলো । বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তির রাজনৈতিক অর্থনীতি আলোচিত হতে পারে । বব ডিলান কিন্তু ইহুদী বংশোদ্ভূত ।  কিন্তু গান লেখা ও গাওয়াকে সাহিত্য থেকে বাদ দিতে চাওয়া বিকারগ্রস্তদের যন্ত্রণায় সেই আলোচনা করা সম্ভব না এই মুহূর্তে । পরে করা যাবে । আপাতত বাংলাদেশের বব ডিলান বিদ্বেষীদের সিম্পল কয়েকটা প্রশ্ন করি-
কজন আপনারা বই প্রকাশ হওয়া সাহিত্যিক সাধারণ নিয়ে ভাবেন? তাদের জীবন আপনাদের লেখায় কতটুক আসে? তারা আপনাদের লেখা কতটুকু পড়ে?
*মমতাজের গান যে সাবঅল্টার্ণ শোনে ও গায় তার কাছে যাওয়ার যোগ্যতা আছে আপনার হে বই বের করা সাহিত্যিক? অথচ আপনার বই ডিঙিয়ে মমতাজের ফাইট্রা যায় বা লোকাল বাস বাজে ঘরে ঘরে ।
* ফকির লাল মিয়া নামের একজন র‌্যাপ সংগীত শিল্পী “বিচার চাই” ও “একুশ” নামের দুটি গান গেয়েছেন । বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংষ্কৃতিক অধঃপতন এত নিখুঁতভাবে কেউ তুলে ধরেছে বলে মনে হয়না । আপনারা মেইনস্ট্রিম সাহিত্যিকরা কি করেন? একাত্তরেও গেয়েছে এই গায়কেরা । ফ্রেঞ্চ রেভ্যূলেশন থেকে সর্বশেষ আরব বসন্ত সব কিছুতে রয়েছে গান । আর আপনাদের গল্প-উপন্যাস সব জন্ম নেয় সংগ্রাম-বিপ্লবের পর । বিপ্লবকে জ্বালানী শক্তি দেয় গান । জেমসের “বাংলাদেশ” গানটি শুনেছেন? পুরো বাংলাদেশকে এভাবে জনতার কাছে পাঁচ মিনিটে আপনার গল্প-কবিতা- উপন্যাস-নাটক ও সেমিনার এবং টেক্সটবুক তুলে ধরতে পারবে?
(ফকির লালের বিচার চাই নামের সেই বিখ্যাত র‌্যাপটি )
* পপ মিউজিক যেখানে চলে গেছে তা অনেক দূরে । ফেসবুক, ইউটিউব এসে মিউজিককে দিয়েছে অন্যমাত্রা । আপনাদের কথিত সাহিত্যকে কি দিয়েছে? কজন পড়ে কবিতা-গল্প -উপন্যাস continue reading এ ক্লিক করে তা খোঁজ নিয়েছেন? অন্ধ লাইক দেখে ভাববেননা নতুন প্রজন্ম আগের ধাঁচের সাহিত্য খাচ্ছে । বহু আগেই তা নাকচ হয়ে গেছে । হুমায়ূন আহমেদ সেটি বুঝতে পেরেছিলেন । তাই চেষ্টা করেছিলেন তরুণদের ভাবনার কাছে আসতে । আপনারা কি করছেন ওগো , একেকটা সাহিত্যিক গানবিদ্বেষী?
৭।
Bob Dylan  ( ২৪ মে ১৯৪১ ) জীবন্ত কিংবদন্তী । যুদ্ধবিরোধী অবস্থা তাকে ইতিহাসে স্থান দেবে । জর্জ হ্যারিসন , রবিশংকরের পাশাপাশি বব ডিলানও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে গেয়েছিলেন গান । আমরা তা বিনম্রচিত্তে স্বীকার করি , স্মরণ করি । তারে ভালবাসি ।

"Like a Rolling Stone", Mr. Tambourine Man , The Times They Are A Changin', Blowing in the wind , Knockin' On Heaven's Door ও A Hard rains (বাংলাদেশের জন্য ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত কনসার্টে গেয়েছিলেন
A Hard rains) ববের এই গানগুলো শুনে তার সমালোচনা করতে আসার সততা আছে আপনাদের? যদি না থাকে আপাতত ভাঁড়ামী বাদ দেন । ববের গান শুনুন । তাঁর প্রায় ৬ টি চিত্রকলা রিলেটেড বই আছে । সেগুলোর খোঁজ নেন । তাঁরে কেন এওয়ার্ডের পর এওয়ার্ড দিয়েছে সেটা দেখেন । এটাই তার প্রথম এওয়ার্ড নয় । তারে কেন পুরষ্কার দেয়ার কারণ বলা হয়েছে “ having created new poetic expressions within the great American song tradition" সেইটা অনুধাবন করেন । আর না হয় তার গান অনুবাদ করতে বসে যান । তাতে বেচাবিক্রিও হবে আবার একটু জানাশোনাও হবে । কি বলেন?
পাঠ অনুভূতি