১০ মহররম। ৬১ হিজরি। ৬৮১ খ্রীস্টাব্দ। আশুরা। ইতিহাসের করুণতম দিবস। পৃথিবীর সব মানুষের প্রিয় মানুষ মুহম্মদ স এর দৌহিত্র হোসাইনকে অন্যায়ভাবে স্বপরিবারে হত্যা করে অভিশপ্ত ইয়াজিদের অনুগত সেনাবাহিনী।সেই থেকে শিয়া ও সুন্নী স্পষ্ট বিভাজন।আজো তা চলছে। অত্যাচারী ও অত্যাচারিত'র এই অসম লড়াইয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে কথা হচ্ছে । সবকথার শেষ কথা এটাই যে, হুসাইন বা হোসেনই মানবতা ও সুশাসনের পক্ষে লড়েছেন । তাঁর বিপ্লব ছিল ন্যায়সঙ্গত ।
২।
যে অবিচার আলী রা এর উপর উমাইয়ারা মুয়াবিয়ার নেতৃত্ত্বে করেই গিয়েছে তার ধারাবাহিকতায় একাধিক যুদ্ধ করে অজস্র মানুষ হত্যা করে মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান হওয়া মুয়াবিয়া গ্রুপ।এমন কি মুয়াবিয়ার সময় খুত্বায় আলী রা, ফাতিমা রা ও মহানবী স এর পরিবারের অন্যদের গালি দেয়া হত!কি জঘন্য মুয়াবিয়ার শাসনকাল!উসমান হত্যাকে রাজনৈতিক এজেন্ডা করে ধান্ধার মাধ্যমে খলিফা হওয়ার বাসনায় আলীর সাথে যুদ্ধ করে মুয়াবিয়া।এই চক্রান্ত আলী খুন হওয়া পর্যন্ত চলে।আলীর ছেলে হাসান বৈধ খলিফাস্বত্ত্ব দ্বন্দ্ব সংঘাত এড়াতে মুয়াবিয়ার কাছে ছেড়ে দেয় এই শর্তে যে , সে মরে গেলে ইমাম হোসেন রা হবে খলিফা।মুয়াবিয়া এতে রাজি হয়।অথচ এই মুয়াবিয়া মৃত্যুর আগে নিজের দুশ্চরিত্র, মদ্যপ , বিবেকবোধহীন ছেলে ইয়াজিদের কাছে ক্ষমতা দিয়ে যায়।সেই যে খিলাফাতের গায়ে স্বজনপ্রীতি লাগালো মুয়াবিয়া সেখান থেকে ক্ষোভের শুরু সাধারণ মুসলমানদের।
৩।
এই অত্যাচারী অযোগ্য ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষেপে উঠলো। তারা হোসেনকে খলিফা হিসেবে পেতে চায়।ইরাকের কূফা নগরীর জনগণ কূফাবাসীকে ইয়াজিদের অপশাসন থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য হোসেনকে আমন্ত্রণ জানায়।কূফা ছিল আলী রা এর অনুসারীদের ঘাঁটি।হোসেন সেই আশায় ৭২ জন পরিজনসহ কূফার উদ্দেশ্যে রওনা হন।পথিমধ্যে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক স্থানে ইয়াজিদের অনুগত বর্বর বাহিনী হোসেনের কাফেলাকে অবরোধ করে।তাদের খাদ্য রসদ বন্ধ করে দেয়।ফোরাতের পানির উপরও অবরোধ আরোপ করে নরপিশাচেরা।
৪।
দশ মহররম এ অসম যুদ্ধ শুরু হয় । নবী পরিবারের উপর আক্রমণ করে ইয়াজিদের গোলাম ওবায়দুল্লা , জিয়াদ , শিমরেরা।একে একে নবী বংশের বাতি নিভিয়ে দিতে , সামান্য কিছু মোহরের লোভে কূফার গর্ভণর কারবালার প্রান্তরে প্রায় সকল পুরুষকে হত্যা করে । তাঁরমধ্যে হোসেনের শিরশ্ছেদ করতেও ঐ রক্তপিপাসু জালিমদের মধ্যে এতটুকু ভয় কাজ করেনি । বীরের মত যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিলেন ইমাম হোসেন । মজলুমের জননেতা । অত্যাচারীর প্রকম্পন । শোষকের চোখের বিষ । বিশ্বমানবতার মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নায়ক।
৫।
সেদিন ইমাম হোসেনের বিরুদ্ধে কারা যুদ্ধ করছিল?কারা নবী পরিবারকে নির্ব্বংশ করতে চেয়েছিল?ইহুদীরা?খ্রীস্টানরা? না , তারাও মুসলমান পরিচয়ধারী ছিল।তারাও নিজেদের কুস্বার্থে 'আল্লাহু আকবর' বলেই আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে হত্যা করেছিল।আজকেও ইয়াজিদের সেই প্রেতাত্মারা রয়েছে । এই ওয়াহিবীরা সেই প্রেতাত্মা যারা মক্কা ও মদিনায় মহানবী স ও তার সাহাবাদের কবরকে অসম্মান করেছে । আজকের এই আইএস সেই ইয়াজিদের কুখ্যাত ভাড়াটে খুনী যারা আল্লাহু আকবর বলে সিরিয়া , ইরাক ও পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় নিরীহ মানুষ হত্যা করছে।আজ মজলুম ইয়েমেনীদের জানাজায় যারা বোমা হামলা চালায় তারাই ইয়াজিদের আধুনিক রূপ।আল সৌদ পরিবার সিফফিন ও জামাল যুদ্ধে সত্যের পথে থাকা আলী রা এবং অসত্যের পথে থাকা মুয়াবিয়া গংকে 'এক রকম সত্যপন্থী' প্রমাণ করতে কোটি কোটি তৈলডলার খরচ করছে।এর রাজনৈতিক অর্থনীতি সুগভীর।মুয়াবিয়া ও ইবনে ওয়াহাব এবং আল সৌদ ও ইয়াজিদ ইতিহাসের কাঠগড়ায় একই চরিত্রের চারটি অভিন্ন প্রতিমূর্তি। হোসেনের বিপ্লবকে প্রমোট না করে ওয়াহাবী ,সালাফি,খারেজিরা দলবেঁধে ইয়াজিদকে নিরপেক্ষ করতে উঠেপড়ে লাগে। ইনটেলেকচুয়াল ভন্ডামীর মাধ্যমে জাকির নায়েক পর্যন্ত খচ্চর,বদমাশ, খুনী ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নামের সাথে 'রাজিআল্লাহ' বলে।আল্লাহ একারণেই জাকির নায়েককে অপদস্থ করছেন , আরো করবেন এবং ইয়াজিদের বাচ্চা আইএস নিব্রাসদের লাশ নিতে অস্বীকার করে পরিবার পর্যন্ত ।এটাই ইতিহাসের প্রতিশোধ।
৬।
আজকে যে সিরিয়া ইরাক জ্বলছে এটাও ইতিহাসের প্রতিশোধ । এই ইরাকের কারবালায় নবী পরিবারকে হত্যা করেছে সিরিয়া থেকে নির্দেশ দেয়া ইয়াজিদের অনুসারী ইরাকীরা । কূফার বেঈমান জনপদ দাওয়াত দিয়ে তাঁদের মক্কা-মদিনা থেকে ডেকে এনে একফোঁটা সহায়তা করতে এগিয়ে যায়নি।সেই কূফা ,সেই কারবালা আজো আছে ইরাকের বুকে । আজো জ্বলে ওঠে বিপুল ক্ষোভে তা । ফুরাতের পানি যারা হোসেনের রক্তে রঞ্জিত করেছিল তাদের রক্তের মূল্য এখন পানির চেয়েও কম দামি । পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক অসততার ঘানী টানছে আজকের ইরাক।
৭।
ইতিহাসের সত্য এটাই যে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু ব্রাহ্মণ পর্যন্ত হোসেনের পক্ষে লড়াই করেছে। আর নামে মোছলমান ,গরু খাওয়া মোছলমান ব্যস্ত ছিল হোসেনের মস্তক ছেদনে। হোসেন বলেছিল , তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই? তারা চুপ করেছিল । কথিত আছে হুসেনকে দ্রুত হত্যা করে নামাজ পড়তে যাওয়ার কথাও ঐ উমাইয়া আরব অসভ্য খুনী , লোভী, অমানুষ বদমাশগুলো বলেছিল । আজকের ইহুদীবাদি আইএস, আল কায়েদা, ওয়াহাবিরাও নামাজ পড়ে, তাদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ ’ভাল’ মুসলমান না । আর তারা এতই ভাল যে এখনো ইমাম হোসেনের শোকে কাতর শিয়া মুসলমানদের হত্যা করা পূণ্য মনে করে । এই ওয়াহাবি-সালাফিরা ইয়াজিদের আধুনিক প্রেতাত্মা ছাড়া কি?
যা বলছিলাম , বর্তমানে ভারতের পাঞ্জাব ও পুনের হোসাইনি ব্রাহ্মণ পরিচয়ধারীদের এক পূর্বপুরুষ #রাহাব দত্ত ইমাম হোসেনের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন বলে ইতিহাসখ্যাত । এই রাহাব দত্তের বংশধররা গৌরবের সাথে নিজেদের হোসাইনী ব্রাহ্মণ পরিচয় দেয় । তাদের নামের সাথে বখশ , খাঁ , হোসেন ইত্যাদি রাখে এবং মুসলমানদের সাথে একসাথে আশুরা পালন করে । নিজস্ব তাজিয়া মিছিল বের করে । বর্তমানে শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সাথে ভারতের সুসম্পর্কের থিওলজিক্যাল রিজন এটা হতে পারে। হোসাইনী ব্রাহ্মণগণ আধা হিন্দু আধা মুসলমান । সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক দারুন উদাহরণ । তাদের ত্যাগের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আমাদের । কথিত আছে, যখন অসভ্য, বর্বর শিমার ইমাম হোসাইনের কাটা মস্তক অসম্মান করতে করতে নিয়ে যাচ্ছিল তখন এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নেয় । সেই ব্রাহ্মণ নিজের সাত পুত্রের মাথা কেটে দিয়েও ইমাম হোসেনের পবিত্র মস্তক নিতে পারেনি । এই মহান ব্যক্তির উত্তরপুরষরা হোসাইনী ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত । ভারত, পাকিস্তান , আফগানিস্তানে এদের বসবাস ।
কারবালার করুণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে । অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে শিক্ষা হোসাইন আমাদের দিয়ে গেছেন তা হৃদয়ে ধারন করে আশুরার শোকাবহ উদযাপন সফল হোক । ইয়াজিদের স্তুতিকারীদের ধ্বংস হোক । পৃথিবীতে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হোক । কারবালায় শহীদ হওয়া নবী পরিবারের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সালাম ।
আসলামু আলাইকা ইয়া আহলুল বায়াত ।
#আশুরা #কারবালা
0 Comments